অভাবী পুরসভায় বহু ‘বাহুল্য’
জলযোগেই গলে গেল বাড়তি ৬ লাখ
টানাটানির সংসার সামলাতে জরুরি ব্যয়ে বজ্র আঁটুনি। অথচ বাহুল্যের ফস্কা গেরোয় লাখ লাখ টাকা গলে যাচ্ছে কলকাতা পুরসভার! উন্নয়নমূলক কাজে টাকা খরচে যারা ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি করেছে, তারাই মেয়র পরিষদের বৈঠকে স্রেফ খাবারের পিছনে ঢালছে কখনও ৩৪ হাজার, কখনও ২৬ হাজার!
১৫-২০ জনের একটা বৈঠকে খাবারেই এত টাকা?
কী হিসেবে?
যাচাই করতে নেমে পুরসভার অর্থ দফতর রীতিমতো তাজ্জব। তাদের বক্তব্য, মেয়র পরিষদের (মেয়র ও ডেপুটি মেয়র-সহ ১২ জন পারিষদ) বৈঠকে অফিসারদের ধরে টেনেটুনে হাজির থাকেন কুড়ি জন। কিন্তু প্রতিটি বৈঠকে খাবারের প্যাকেট আসছে গড়ে ৮০ থেকে ৯০ জনের জন্য! ফলে ফি বৈঠকে জলযোগ বাবদ বাড়তি ২০-২৫ হাজার টাকার বিল মেটাতে হচ্ছে। উপরন্তু আরও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন-আপ্যায়নে বিপুল পুর-ব্যয়ের নমুনা মিলেছে।
২০১০-এর জুনে পুরবোর্ডে পালাবদলের পরে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। সে বছরের জুলাই থেকে ২০১২-র এপ্রিল পর্যন্ত মেয়র পরিষদের ৩২টি বৈঠক হয়েছে। এবং হিসেব অনুযায়ী, তাতে শুধু খাবারের পিছনেই অন্তত ছ’লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে, যার কোনও আপাতগ্রাহ্য যুক্তি অর্থ-কর্তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। এমনকী, ভোজ-খরচের বহর শুনে তৃণমূলেরই এক কাউন্সিলরের মন্তব্য, “প্রতি সপ্তাহে মেয়র পরিষদের একটা বৈঠক হওয়ার কথা। সত্যিই সেটা হলে তো পুরসভার হাঁড়ির হাল হতো! প্রতি বৈঠকে বাড়তি ৬০-৭০ জনকে খাওয়াতে হচ্ছে কেন?”
দরাজ কোষাগার
তারিখ কোন খাতে খরচ কত খরচ*
২ অগস্ট ২০১১ গঙ্গাপাড় সৌন্দর্যায়নে অনুষ্ঠান ৫,০৮,৭৮১
১২ অগস্ট ২০১১ পার্ক সার্কাসে ইফতার পার্টি ৪১,৩৫,৫৯২
১৭ অগস্ট ২০১১ বিভিন্ন পুজো কমিটির সঙ্গে সভা ৪,৯০,০০০
২৪ অগস্ট ২০১১ টাউন হলে মুখ্যমন্ত্রীর সভা ১,১৬,২৩৩
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ মেয়র পরিষদ বৈঠকে খাবার (৮২ প্যাকেট) ২৫,৪৩৬
২৫ নভেম্বর ২০১১ মেয়র পরিষদ বৈঠকেখাবার (৯২ প্যাকেট) ৩৬,৭৬০
মে ২০১২ টাউন হলে পুর-রবীন্দ্রজয়ন্তী(চার দিনের) ১৫,৭০,০০০

*অঙ্ক টাকায়
কারণটা বুঝে উঠতে পারছেন না কলকাতার প্রাক্তন মেয়র, তথা রাজ্যের বর্তমান পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও। তিনি বলছেন, “আমি মেয়র থাকাকালীন পরিষদের বৈঠকে জলযোগ বাবদ হাজার-বারোশো টাকা খরচ হতো।” সুব্রতবাবু মঙ্গলবার জানিয়েছেন, বৈঠকে পারিষদেরা-সহ জনা পনেরো লোক থাকতেন। এর বেশি লোকের কোনও দরকারই নেই বলে তাঁর দাবি। বর্তমান মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি এই বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক তিনি ওয়াকিবহাল নন। তাঁর কথায়, “এত খরচ হচ্ছে! আমি জানি না তো! দেখছি, কেন হচ্ছে।”
তবে শুধু পরিষদের বৈঠক নয়। পুরসভার নথিতে আরও এমন কিছু খরচের হিসেব মিলছে, বর্তমান আর্থিক সঙ্কটের পরিস্থিতিতে যেগুলোকে নিছক ‘বাহুল্য’ বলে মনে করছেন পুর-কর্তাদেরই একাংশ। পুর-অর্থ দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালের শুধু অগস্ট মাসেই বিভিন্ন সভা, অনুষ্ঠানে পুরসভার প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে। এবং তার কয়েকটি আদৌ পুরসভার করার কথা নয়। যেমন?
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই আসছে গত বছর পার্ক সার্কাসে পুর-উদ্যোগে আয়োজিত ইফতার পার্টির কথা। যার পিছনে পুর- কোষাগারের ৪১ লক্ষ টাকা ঢালা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত ১২ অগস্টের ওই ইফতারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাজির ছিলেন। পুর-সূত্রের খবর, সেখানে প্রায় ৭৪০০ প্যাকেট খাবার সরবরাহের বরাত পেয়েছিল পার্ক সার্কাসের এক রেস্তোরা।ঁ প্যাকেটপিছু ২৮৫ টাকা দরে। পরিবেশন খরচ ও ট্যাক্স সমেত শুধু খাবারের বিল মেটাতে লেগেছে ২৩ লক্ষ টাকা। মঞ্চ ও আলোকসজ্জায় প্রায় ১৮ লক্ষ।
শহরের বিভিন্ন পুজো কমিটির কর্তাদের সঙ্গে একটি সভা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গত ১৭ অগস্ট নেতাজি ইন্ডোরে আয়োজিত সেই প্রাক-পুজো সভাতেও মুখ্যমন্ত্রী হাজির ছিলেন। হাজার পাঁচেক মানুষের সভার যাবতীয় খরচ জুগিয়েছিল পুরসভা। তাতে শুধু জলযোগের খরচ ছিল সওয়া দু’লক্ষ টাকা। পাশাপাশি গত ২ অগস্ট গঙ্গার সৌন্দর্যায়ন নিয়ে একটি অনুুষ্ঠান হয়েছিল মিলেনিয়াম পার্কে। পুর-কর্তাদের একাংশের মতে, প্রথা অনুযায়ী তার যাবতীয় খরচ কেএমডিএ-র বহন করা উচিত ছিল। কিন্তু সব ব্যয়ভার পুরসভাই নেয়। মঞ্চ ও খাবার নিয়ে লেগেছিল প্রায় ৫ লক্ষ টাকা। ওই মাসেই টাউন হলে সরকারি অফিসারদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় জলযোগ ও মঞ্চসজ্জা বাবদ পুর-ভাঁড়ার থেকে ১ লক্ষ ১৬ হাজার টাকা বার করতে হয়েছে।
পুর-কর্তাদের একটি মহলের দাবি, এ হেন ‘বেহিসেবি’ খরচ নিয়ে বার বার প্রশ্ন তুললেও বাহুল্যে রাশ টানা যায়নি। এক কর্তা এ দিন বলেন, “রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে ৫ মে থেকে টাউন হলে চার দিনের অনুষ্ঠান করছে পুরসভা। খরচ ধরা হয়েছে ১৬ লক্ষ টাকা।” যদিও উদ্যোক্তাদের অনেকের আশঙ্কা, আসল খরচ এর অনেক বেশি দাঁড়াবে।
মহানগরের সর্বত্র এখনও পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দিতে পারেনি পুরসভা। গরম পড়তেই নানা জায়গায় জলকষ্ট দেখা দিয়েছে। বস্তি উন্নয়নের কাজ থমকে। রাস্তাঘাট মেরামত হচ্ছে না, কারণ অর্থাভাবে বিটুমিন কেনা যাচ্ছে না। নিকাশির কাজও আটকে রয়েছে কিছু জায়গায়। এই পরিস্থিতিতে এমন ‘অনুষ্ঠানিক’ খরচ কি একান্ত প্রয়োজনীয়? যাদের মাধ্যমে খরচগুলি হয়ে থাকে, সেই পুর-সচিবালয়ের এক পদস্থ অফিসার বলেন, “এগুলো অপ্রয়োজনীয় কি না, বলতে পারব না। বিভিন্ন সভা ও অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের যা করতে বলা হয়, আমরা তা পালন করি।” যে আধিকারিকের অনুমতিতে বিলগুলি পাশ হয়, পুর-কমিশনার সেই অর্ণব রায়ের বক্তব্য, “এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না। যা জিজ্ঞাসা করার, মেয়রকে করুন।”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.