গরমে বিধ্বস্ত শিশু স্কুল থেকে বেরোতেই মা হাতে ধরিয়ে দিলেন নরম পানীয়ের বোতল। সন্তান যত বার আয়েসে চুমুক দিচ্ছে, তত বার মায়ের মুখে ফুটে উঠছে তৃপ্তির হাসি।
শুধু স্কুলের গেটে নয়। রাস্তায়, বাসে, মেট্রোয় এ পরিচিত দৃশ্য। বাড়ি ফিরেও ভাত/রুটি-ডাল-সব্জি-মাছের চেনা মেনুতে স্কুলপড়ুয়াটির মন ভরছে না। তখন চলে আসছে রোল, বার্গার, পিৎজা, চাউমিন। আবার স্কুল যাওয়ার আগে খাবার যাতে চটজলদি গলা দিয়ে নামে, তাই মাখন-আলুসেদ্ধ দিয়ে গলা ভাত। পাশাপাশি ‘স্বাস্থ্যকর পানীয়ের’ নিয়মিত জোগান। অভিভাবকদের অনেকের ঘোষণা, ছেলে-মেয়েকে তাঁরা এমন ‘হেল্থ ড্রিঙ্ক’ খাওয়ান, যাতে বুদ্ধি-বৃদ্ধিতে ‘জোয়ার’ আসে!
অতএব মা-বাবা খুশি। আপাতদৃষ্টিতে সন্তানও সুস্থ। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কপালে ভাঁজ বাড়ছে কেন?
কারণ ওঁরা বলছেন, এই ‘ভুল’ খাদ্যাভ্যাসই শিশু-কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্কদেরও স্বাস্থ্যের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। ডেকে আনছে স্থূলত্ব, ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, এমনকী ক্যানসারের মতো মারণ রোগ। সম্প্রতি বেঙ্গালুরুতে এক সম্মেলনে বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসকেরা চারপাশের বেশ কিছু চেনা ছবি তুলে ধরে এই বিপদ সম্পর্কেই সতর্কবার্তা দিলেন। জানালেন, বিশেষত আধুনিক শহুরে সমাজে ‘পুষ্টিকর’ খাদ্যের নামে বাচ্চাদের যা খাওয়ানো হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ঠিক নয়। মা-বাবা বিজ্ঞাপনের মোহে ভুলছেন। আবার বড়দের অনেকে খাওয়া কমিয়েও ওজন কমাতে পারছেন না। কেননা ওঁরা যেটুকু খাচ্ছেন, সেটুকুই ‘ভুল।’
তা হলে ঠিক কোনটা?
এন্ডোক্রিনোলজিস্ট শশাঙ্ক জোশীর দাবি, “আমাদের মা-ঠাকুমারা যেমন খাওয়াতেন, সেটাই আদর্শ সুষম আহার। ভাত/রুটি-ডাল-সব্জি-দুধ-ফলের যোগফলে তৈরি। আলাদা করে ‘হেল্থ ড্রিঙ্ক’ খাইয়ে শরীর বা মনের শক্তি বাড়ানো যায় না। বরং বহু ক্ষেত্রে তার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশি। এ সব খেয়াল না-রাখলে পরে ভুগতে হবে।” ‘গ্লাইসেমিক ইনডেক্স’টা কী?
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট খাওয়ালে রক্তে শর্করার মাত্রা যে ভাবে বাড়ে, তারই মাপকাঠি ‘গ্লাইসেমিক ইনডেক্স।’ যেমন ১০০ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ালে তা যত দ্রুত রক্তে ছড়ায়, ১০০ গ্রাম আটার রুটিতে ততটা নয়। তাই আহারের বহর কমানোর পাশাপাশি সঠিক খাবার নির্বাচনও জরুরি। কার্বোবাইড্রেট শরীরের পক্ষে খুব প্রয়োজনীয় হলেও পরিমাণটা মাথায় রাখতে হবে। “আর তাই খুঁজে নিতে হবে ‘স্মার্ট কার্বোহাইড্রেট।’ যা থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি আসবে, অথচ ক্ষতি হবে না। একে বলে লো-গ্লাইসেমিক খাবার।” জানালেন শশাঙ্ক। পুষ্টিবিদ নৈনি শিতলবাদের কথায়, “কোনটা কতক্ষণ রান্না করছি, তার উপরেও নির্ভর করে কতটা শর্করা শরীরে যাচ্ছে। যেমন, ভাত যত সেদ্ধ হবে, তত তার ‘গ্লাইসেমিক লোড’ বাড়বে। এমন খাবার বেশি খেলে স্থূলত্ব ছাড়াও ব্যক্তিত্বে প্রভাব পড়তে পারে। গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশি হলে তাড়াতাড়ি খিদেও পেয়ে যায়। তাই পরিমাণে বেশি খাওয়া হয়ে যায়।”
সম্মেলনের আয়োজক সংস্থা ‘হিল ইন্ডিয়া’র তরফে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স নিয়ে ‘সচেতনতা’ যাচাই করতে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই ও বেঙ্গালুরুতে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। ৯০০ জন পুষ্টিবিদ জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে আসা লোকজনের অধিকাংশেরই এ নিয়ে জিজ্ঞাস্য থাকে না। কলকাতার ৪৩%, দিল্লির ৪০%, মুম্বইয়ের ৪৭% এবং বেঙ্গালুরুর ৫০% মানুষ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।
চিকিৎসকেরা এ-ও জানাচ্ছেন, অঞ্চলভেদে মানুষের মধ্যে ‘গ্লাইসেমিক লোড’ বিভিন্ন। এসএসকেএমে এটা নিয়েই একটা প্রকল্প চলছে। এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সতীনাথ মুখোপাধ্যায় উদাহরণ দিলেন, “দক্ষিণ ভারতের বাসিন্দারা তিন বেলা চালের খাবার খান। ভাত, ইডলি ইত্যাদি। কার্বোহাইড্রেট এত বেশি শরীরে যায় বলে তাঁদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কলকাতা বা অন্যান্য শহরের তুলনায় বেশি।” কিন্তু বাঙালি তো আলুও দেদার খায়!
সতীনাথবাবুর বক্তব্য, “আলুর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশি। ফাইবার কম, তাই তাড়াতাড়ি শরীরে মেশে। তবে খোসাসমেত আলু বা অন্য সব্জির সঙ্গে আলু মিশিয়ে খেলে ক্ষতি কম। একই কারণে ঢেঁকিছাঁটা চাল বা ভুষিসমেত আটা উপকারী।” |