রাষ্ট্রপতি নির্বাচন : কথা সনিয়া, মুলায়মের সঙ্গে
মমতার মন পেতে সাহায্যের সিদ্ধান্ত
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থন আদায় করতে পশ্চিমবঙ্গের জন্য আর্থিক প্যাকেজের বন্দোবস্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহ। দু’জনেই এ বিষয়ে একমত যে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে তৃণমূল নেত্রীকে তুষ্ট করতে না পারলে শরিকি ঐক্য ধরে রাখা যাবে না।
জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লি আসা মমতাও আজ দিনভর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে সক্রিয় ছিলেন। যাকে ‘ঐকমত্যের রাজনীতি’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বলেই আখ্যা দিয়েছেন তিনি। সনিয়া গাঁধী থেকে শুরু করে আহমেদ পটেল, মুলায়ম সিংহ যাদবের সঙ্গে বৈঠক করে তাঁদের মন বোঝার চেষ্টা করলেন মমতা। কিন্তু নিজের হাতের তাস দেখালেন না।
কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে ইউপিএ-র তিন নম্বর শরিক ডিএমকে-র সঙ্গে ইতিমধ্যেই আলোচনা সেরে ফেরা হয়েছে। মুলায়ম সম্পর্কেও তারা অনেকটাই নিশ্চিন্ত। কারণ, দুর্নীতির একাধিক মামলা থাকায় সমাজবাদী পার্টির প্রধান খানিকটা চাপে। কিন্তু দর কষাকষির ব্যাপারে সব চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন মমতা। তাই তিনি কী করবেন, তা নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে কংগ্রেসে। শুরু হয়েছে মমতার ‘মন রাখার’ পথ খোঁজার চেষ্টাও।
সংসদে তৃণমূল নেত্রী। ছবি: প্রেম সিংহ
রাজ্যের আর্থিক সঙ্কট মেটাতে মমতা যে সব দাবি তুলেছেন, তার কতটা পূরণ করা যায়, তা ঠিক করতে আজ সকালে সংসদ ভবনেই বৈঠকে বসেন সনিয়া, মনমোহন এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়। তার আগে প্রণববাবু তাঁর অর্থ মন্ত্রকের ব্যয়সচিব সুমিত বসুর সঙ্গে এক দফা বৈঠক করেন। পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব ও কেরল এই তিনটি ঋণগ্রস্ত রাজ্যের জন্য কেন্দ্রীয় সাহায্যের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সুমিত বসুর নেতৃত্বেই একটি কমিটি গড়া হয়েছে। গত কাল সেই কমিটি পশ্চিমবঙ্গের অর্থ দফতরের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিল। সেই বৈঠকে রাজ্যের তরফে যা যা জানানো হয়েছে, তা আজ প্রণববাবুকে ব্যাখ্যা করেন সুমিতবাবু। তার পরেই প্রণবের সঙ্গে সনিয়া-মনমোহনের বৈঠক হয়। পরে ফের সুমিতের সঙ্গে আলোচনায় বসেন অর্থমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আজই বৈঠক হওয়ার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে মমতাকে জানানো হয়, সংসদে নানা কাজ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত থাকবেন। তাই আগামী কাল বৈঠক করার প্রস্তাব দেওয়া হয় মমতাকে। মমতা আপত্তি করেননি। তবে প্রকাশ্যে ব্যস্ততার কারণ দেখালেও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের একটি সূত্র বলছে, মমতার সঙ্গে বৈঠকের আগে রাজ্যের জন্য আর্থিক প্যাকেজের বিষয়টি চূড়ান্ত করে নিতে চাইছেন মনমোহন। সে জন্যই বৈঠকটি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ, মমতা যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে রাজ্যের আর্থিক দুর্দশা নিয়েই সরব হবেন, তা ইউপিএ-সরকার তথা কংগ্রেস নেতৃত্বের অজানা নয়। তৃণমূল সূত্রের খবর, আগামিকাল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে পঞ্জাবকে কেন্দ্রীয় সাহায্য দেওয়ার দৃষ্টান্ত তুলে চাপ বাড়ানোর চেষ্টা করবেন মমতা।
আর্থিক প্যাকেজকে পাখির চোখ করলেও মমতার এ বারের দিল্লি সফরে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। আজ তিনি সংসদের সেন্ট্রাল হলে পা-রাখার কিছু আগেই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ‘বিস্ফোরক’ মন্তব্য করেছেন কংগ্রেস মুখপাত্র রেণুকা চৌধুরী। বলেছেন, “প্রণববাবু দলের জন্য এত মূল্যবান যে তাঁকে আমরা ছাড়ি কী করে?” ফলে মমতা আসামাত্রই তাঁকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকেরা। জবাবে মমতা বলেন, “প্রণববাবুকে কংগ্রেসই তো রাষ্ট্রপতি হওয়ার দৌড়ে রাখছে না দেখছি!” তবে পর ক্ষণেই তিনি বলেন, “আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতা জানি। তা ছাড়া কংগ্রেস কাকে প্রার্থী করবে, সেটা তাদের ব্যাপার।”
তবে তাঁর পছন্দের প্রার্থী কে, তা নিয়ে আজ মুখ খুলতে চাননি মমতা। তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপতি ভোটে ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রার্থী দেওয়ার ঐতিহ্য রয়েছে। আব্দুল কালাম যখন রাষ্ট্রপতি হন, তখন আমি তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলাম। মুলায়ম সিংহ যাদব তা সমর্থন করেছিলেন। এ বারও আমার সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে সেই ঐকমত্যের রাজনীতি করার চেষ্টাই করছি।” এবং এ বারও মমতার ‘জোটসঙ্গী’ সেই মুলায়ম। আজ অশোক রোডে মুলায়মের বাড়ি গিয়ে বৈঠক করেন মমতা। তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে এই দুই নেতা-নেত্রী একজোট।
মুলায়মের সঙ্গে বৈঠকের আগে দশ জনপথে সনিয়ার কাছে যান মমতা। মিনিট বিশেক কথা হয় দু’জনের মধ্যে। তিনি কি সনিয়ার কাছে কোনও প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করলেন? অথবা তাঁকে কোনও প্রার্থীর নাম জানালেন সনিয়া? সাংবাদিকদের কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে মমতার রসিকতা ভরা মন্তব্য, “আমিই রাষ্ট্রপতি প্রার্থী।” তবে কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, তিনি যে এখনও কোনও প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত করেননি, তা মমতাকে জানিয়েছেন সনিয়া। পাশাপাশি তৃণমূল নেত্রীর সম্মতি ছাড়া যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না, তা-ও জানিয়ে দিয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মমতার সমর্থন কোন দিকে যাচ্ছে, সেটা যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, তা ভালই বুঝতে পারছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। মমতা ও মুলায়মের সম্মতি পেলে কংগ্রেস প্রার্থী ভোট বৈতরণী পেরিয়ে যাবেন। এটা ঠিক যে, চার বাম দলের সম্মিলিত ভোট মমতার হাতে থাকা ভোটের চেয়ে সামান্য বেশি। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ভোটে বামেদের সমর্থন নিলে মমতার বেঁকে বসা স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে ইউপিএ-ই ভেঙে যেতে পারে। ফলে, মমতাকে বাদ দিয়ে এগোতে চায় না কংগ্রেস।
কিন্তু এটাও ঠিক যে, মমতার ‘মন পাওয়া’ কঠিন। হামিদ আনসারির বিষয়ে তাঁর আপত্তি থাকতে পারে। কারণ প্রথমত, লোকপাল বিল নিয়ে বিতর্কের সময় রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসেবে হামিদ আনসারির ভূমিকায় মমতা এখনও অসন্তুষ্ট। তা ছাড়া উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আনসারি ছিলেন বামেদের প্রার্থী। তাই মমতা তাঁকে সমর্থন করবেন না বলেই মনে করছেন অনেকে। এই অবস্থায় সকলের আগে ইউপিএ-র ‘কঠিনতম শরিক’-এর সঙ্গে বোঝাপড়ায় পৌঁছনোর চেষ্টা চালাচ্ছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। তাই গত রাতেই তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছিল কমল নাথকে। আজ মুলায়ম-মমতা বৈঠকের পরে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল। আহমেদের সঙ্গে মুলায়মের সম্পর্ক ভাল। আবার মমতার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেন তিনি।
দুপুর ২:৫০ সংসদের সেন্ট্রাল হলে গেলেন মমতা
৩:১৫-৩:৫০ বৈঠক বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণর সঙ্গে
৪:২০ ১০ জনপথে মমতা
৪:৪০ সনিয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে দলীয় দফতরে
৫:৪০-৬:৩০ মুলায়ম সিংহের বাড়িতে বৈঠক
সন্ধ্যা ৬:৪৫-৭:০৫ আহমেদ পটেলের সঙ্গে বৈঠক
মমতা অবশ্য নিজের মতো করে সক্রিয় হয়ে চাপে রেখেছেন কংগ্রেসকে। তবে কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের মতে, নিজের পছন্দের প্রার্থীকে রাষ্ট্রপতি পদে বসানোর থেকেও মমতার কাছে বেশি জরুরি রাজ্যের জন্য আর্থিক প্যাকেজ আদায় করা। সেই কারণেই আর্থিক প্যাকেজ নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী চাইছেন, রাজ্যের আর্থিক সঙ্কটের এমন কোনও সমাধানসূত্র খুঁজে বের করতে, যাতে কোনও সাংবিধানিক বাধা না-আসে। আবার অন্য রাজ্যগুলিও পশ্চিমবঙ্গকে বিশেষ সাহায্য দেওয়া হচ্ছে বলে আপত্তি তুলতে না পারে। আরও একটি বিষয় মাথায় রাখতে হচ্ছে কংগ্রেসকে। তা হল, সংসদের চলতি অধিবেশন শেষ হওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কোনও ঘোষণা হলে অন্য আঞ্চলিক দলগুলি শোরগোল তুলতে পারে। তাই ২২ মে অধিবেশন শেষের পর আর্থিক প্যাকেজের ঘোষণা হবে বলে আপাতত রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে সন্ধিস্থাপনের চেষ্টা চলছে। কিন্তু মমতাও কেন্দ্রের তরফে কোনও ঘোষণা না-হওয়া পর্যন্ত আশ্বস্ত হতে নারাজ।
আজ দুপুর পৌনে তিনটে নাগাদ সংসদে আসেন মমতা। প্রথমে ভুল করে পূর্ণমন্ত্রীদের
জন্য নির্ধারিত স্থানে গিয়ে দাঁড়ায় তাঁর গাড়ি। নিজেই ভুল শুধরে দেন মমতা। সেন্ট্রাল হলে ঢুকতেই তাঁকে ঘিরে ধরেন সাংবাদিকরা। সেখানে তখন উপস্থিত লালুপ্রসাদ যাদব-সহ অন্য বহু নেতা। কিন্তু তাঁদের ঘিরে এই উত্তেজনার লেশমাত্র ছিল না।
সেন্ট্রাল হলেই তাঁর ঐকমত্যের রাজনীতির কৌশল ফুটিয়ে তোলেন মমতা। এক দিকে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী, প্রকাশ জাভড়েকর, অন্য দিকে সিপিআই নেতা ডি রাজা সকলের সঙ্গেই হাত মেলান তিনি। সৌজন্য বিনিময় করেন।
এর পরে বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণের সঙ্গে কিছু ক্ষণ কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টনের সফর নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশ নিয়েও তাঁরা কথা বলেন বলে মন্ত্রক সূত্রে খবর। এর পর সোজা দশ জনপথ। কংগ্রেস সভানেত্রীর সঙ্গে বৈঠক সেরে বেরনোর সময় দৃশ্যতই উৎফুল্ল ছিলেন মমতা। হাল্কা রসিকতাও করেন সাংবাদিকদের সঙ্গে।
আগামী কাল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন মমতা। তার পরের দিন যোগ দেবেন মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে। সেখানে হাজির থাকবেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক-সহ বেশ কয়েক জন প্রথম সারির রাজনীতিক। রাষ্ট্রপতি ভোট নিয়ে তাঁদের সঙ্গে মমতার কী আলোচনা হয়, সেটাই এখন দেখার।

সহ প্রতিবেদন: প্রেমাংশু চৌধুরী


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.