তখন গঙ্গা ছিল জমিদারবাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বাড়ির পাশেই একটা মস্ত পুকুর। ট্রলি পাতা হয়েছে সেখানে। রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন ছবি বিশ্বাস। নিজেই চাপলেন ঘোড়ার পিঠে। পরক্ষণেই নেমেও পড়লেন। এ বার ছবি বিশ্বাসের পোশাক পরানো হল সহিসকে। ঘোড়ায় ছুটলেন সহিস। বেশ খানিকটা দূরে নদীর পাড়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন সহিস। আবার ছবি বিশ্বাস পড়ে নিলেন সেই পোশাক। ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ছবি বিশ্বাস। জলসাঘর সিনেমার স্যুটিং দেখার সেই স্মৃতি এখনও ভোলেননি এলাকার মানুষ।
উঠোনভরা লোকলস্কর, ঠাকুর-চাকর, দরজায় সান্ত্রী। নিমতিতা রাজবাড়ির সেই গমগমে অবস্থাটা এখনও যেন চোখের সামনে দেখতে পান সত্তরোর্ধ্ব শিশির দাস। |
তাঁর কথায়, “একদিন এই ছবিটাই ছিল নিমতিতা রাজবাড়ির সত্যিকারের ছবি। তারপরে এই ছবিটা তৈরি হল সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’ সিনেমার জন্য।”
শিশিরবাবুরা তখন কিশোর। অষ্টম বা নবম শ্রেণির ছাত্র। বার তিনেক স্যুটিংয়ের সেট পড়েছিল নিমতিতার এই রাজবাড়িতে। প্রথমবার চলল টানা এক মাস। জলসাঘরের সূত্রেই সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে এখনও তাঁদের চোখ চলে যায় সুপ্রাচীন এই বিশাল প্রাসাদটির দিকে। তিনি বলেন, “সত্যজিৎ রায়, ছবি বিশ্বাসের মতো নাম। তবে আমরা গ্রামে তখন তত কিছু জানতাম বা বুঝতাম না। আমাদের মূল উৎসাহ ছিল স্যুটিং দেখার।” তিনি বলেন, “অবাক হয়ে গেলাম সহিস আর ছবি বিশ্বাসের বদলাবদলি দেখে।” তিনি বলেন, “নাটমন্দিরের সামনের দোতলায় থাকতেন ছবি বিশ্বাস। পাশের ঘরেই সত্যজিৎ রায়। জমিদারবাড়ির বাইরে স্যুটিং ছাড়া খুব একটা বেরোতেন না তাঁরা। কিন্তু তাঁদের কণ্ঠস্বর, উচ্চারণভঙ্গি, ব্যক্তিত্ব মুগ্ধ করে দিত।” তবে জমিদার বাড়ির ভিতের স্যুটিংয়ের সময়ে সেখানে যাওয়ার অনুমতি মিলত না শিশিরবাবুদের। বাইরে থেকে শুনতে পেতেন শব্দ।
অরঙ্গাবাদ কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান সাধন দাস বলেন, “জলসাঘরের পরে ওই রাজবাড়িতে লোকজনের যাতায়াত বেড়েছিল। এখন আবার তা পরিত্যক্ত।” ভেঙে পড়ছে সেই বিশাল বাড়ি। খাবারঘর, দালানের মাথার ছাদ ভেঙেছে। রন্ধনশালা জঙ্গলে ভরা। শেষ রানিমা সবিতা চৌধুরী প্রয়াত হয়েছেন বছর দুই আগে। এক মাত্র পরিচারক গোবর্ধন দাসও মারা গিয়েছেন। সবিতাদেবীর দুই ছেলে থাকেন কলকাতায়। দুর্গা পুজো অবশ্য এখনও হয়। শেষ পর্বে বিশ্বম্ভর রায়ের জমিদারি যেমন ভেঙে পড়েছিল, সেই ভাবেই মুছে গিয়েছিল নিমতিতার এই রাজবাড়ির চাকচিক্যও। |