বাংলা ছবির বৈচিত্র অনেক বেড়েছে। দুনিয়ায় তার বাজারও তৈরি।
সেই সুযোগ কাজে লাগানোর তাগিদ নেই আমাদের। প্রশ্ন তুলেছেন
ইন্দ্রজিৎ রায় |
আজ থেকে ঠিক পনেরো বছর আগের কথা। ইংল্যান্ডের ইয়র্ক শহরের এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে ভারতীয় সিনেমার এক প্রদর্শনীতে দু’টি ছবি দেখানো হয়েছিল প্রথমটি হিন্দিতে, দীপা মেটার নতুন ছবি ‘ফায়ার’ আর দ্বিতীয়টি বাংলায়, ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’। ফায়ার ‘হাউসফুল’ না হলেও, উদ্যোক্তাদের পয়সা উসুল হয়ে গেছিল দর্শক সমাগমে, যাঁদের অনেকেই হলের বাইরে আমাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের দেশে ‘এমন’টা হয় বুঝি? রাতের শোয়ে মেঘে ঢাকা তারা-য় কিন্তু গোটা হলে আমরা মাত্র দু’জন। বাংলা সিনেমার আর্ত চিৎকার আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম যেন প্রতীকী।
গত পনেরো বছরে বিদেশে আমার অভিজ্ঞতার রূপ, পনেরো বছরের বাংলা সিনেমার মতোই, অনেক বদলেছে। তবু, আগে বলি, উপরের ঘটনা থেকে ফুটে ওঠা কী কী আজও বদলায়নি, হয়তো বা কোনও দিনই বদলাবে না। প্রথমত, ইয়র্ক শহরের বাসিন্দারা সকলেই সমগোত্রীয়, সাদা ইংরেজ (মুখ্যত ইয়র্কশায়ারীয়ই); সেথায় ভিনদেশি প্রায় নেই বললেই চলে, ভারতীয়রা, আক্ষরিক অর্থে হাতে-গোনা। কোনও মতেই এ হেন শহরকে ‘মাল্টিকালচারাল’ বলে চিহ্নিত করা যায় না। জনসংখ্যার এই জাতিগত বিভাজনের চিত্রটা আজও ইয়র্কে বদলায়নি। দ্বিতীয়ত, ইয়র্কের মতোই বিদেশের অন্য অনেক দেশে, এমনকী স্পেন, ব্রাজিল বা নিউজিল্যান্ডের মতো দেশেও যেখানে ভারতের প্রভাব খুব কম, সেখানেও অনেক শহরের নাগরিকদের কাছে ভারত ও তার সংস্কৃতির চর্চা অন্যতম প্রিয় বিষয়। গত পনেরো বছরে, ইন্টারনেটের যুগে এই কৌতূহল বেড়েছে, কমেনি মোটেই। তৃতীয়ত, এই জনসংখ্যার মধ্যে, ভারতীয় সিনেমার খবর যাঁরা রাখেন ও সিনেমা দেখতে চান, তাঁরা ভাল ভারতীয় সিনেমা বলতে হিন্দির পরেই (হয়তো বা আগে) বাংলা সিনেমার কথা ভাবতেন, আজও তা-ই ভাবেন। |
এ বার বলি, সে দিনের মেঘে ঢাকা বিলিতি সন্ধ্যার ‘কহানি’তে আজ কী কী বদলেছে। প্রথমত, বিলেতে তো বটেই, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি মায় দক্ষিণ আফ্রিকাতেও ভারতীয় ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা জমিয়ে বসেছেন, সংখ্যায় অনেক গুণ বেড়েছেন, প্রতিপত্তিশালী হয়েছেন। নতুন হিন্দি সিনেমা দেখতে আজ ফিল্ম ক্লাব বা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উপর ভরসা করতে হয় না। দ্বিতীয়ত, বাংলা সিনেমার পুরো খোলনলচেই গত পনেরো বছরে বদলে গেছে। বাণিজ্যিক চাকচিক্য তো ছেড়েই দিলাম, ‘ভাল বই’ বলতে যেমন ঋত্বিক-সত্যজিৎ-মৃণালের বাইরে আমরা ভাবতে পারতাম না আজ সেই তালিকাটা রীতিমতো লম্বা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঋতুপর্ণ-অপর্ণা-সন্দীপ তো ছিলেনই, গত পনেরো বছরেই মাঠে নেমেছেন অঞ্জন দত্তের মতো অন্য ক্ষেত্রে অভিজ্ঞরা ও কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে আজকের সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের মতো নবীনরা। দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রীর তালিকা তো আরও দীর্ঘ প্রসেনজিৎ নিজেকে বদলেছেন, দেব-জিৎ-রা লাল-জুতো পরে দাপাচ্ছেন, অপর্ণা-ঋতু-কৌশিক-রা নিজেদের পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয়ও চুটিয়ে করছেন, মুম্বইয়ের প্রতিষ্ঠিতরা এসেছেন, আসছেন, সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার এক ঝাঁক নতুন ছেলেমেয়ে ‘এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমাকে’ অবস্থার সূচনা করেছেন। তৃতীয়ত, প্রযুক্তির প্রসার ও উপযুক্ত ব্যবহার বাংলা সিনেমায় এখন অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে গেছে। পনেরো বছর আগে, মেঘে ঢাকা তারা-র প্রিন্টটা বিদেশের প্রেক্ষাগৃহে দেখতে ভারী লজ্জা করেছিল, এখন ঝাঁ-চকচকে সিনেমার কারিগরি নিখুঁত ডিজিটাল প্রিন্ট দেখে আমাদের তাক লেগে যায়। চতুর্থত, বিদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার সরাসরি যোগ ঘটেছে; ভারতীয় সিনেমার পরিচ্ছেদ হিসেবে নয়, নিজের স্বতন্ত্র সত্তায়। এখন লন্ডননিবাসী সঙ্গীতা দত্ত সেই শহরে বসে বাঙালি জীবনের উপর সিনেমা তৈরি করছেন, ফ্লোরিডার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সুমন ঘোষ আজ টলিউডের অঙ্গ হয়ে উঠেছেন।
এত ‘পরিবর্তন’ সত্ত্বেও কোথাও যেন একটা ফাঁক রয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্যের মতোই, বাংলা সিনেমা আজ আমাদের গর্বের বস্তু, তবু বিদেশের বাজারে ‘প্রোডাক্ট’ হিসেবে বাংলা সিনেমা এখনও সেই পনেরো বছর আগের জায়গাতেই পড়ে রয়েছে, বলিউড কিন্তু তুলনায় লাফিয়ে লাফিয়ে কয়েকশো গুণ এগিয়ে গেছে। তফাতটা মূলত অর্থনৈতিক হিন্দি সিনেমাকে বিশ্ব বাজারে রফতানি করা হয়েছে। আজ, অনেক দেশেই তাই হিন্দি সিনেমা ‘মেনস্ট্রিম’ সিনেমা ভারতে মুক্তি পাবার দিনই বিদেশের বিভিন্ন শহরের অজস্র মাল্টিপ্লেক্সে বলিউডের সব সিনেমারই দেখা মেলে, তা সে রা-ওয়ান হোক বা ভেজা ফ্রাই-২। বস্তুত, নতুন সিনেমার প্রথম সপ্তাহের বাণিজ্যের যে বিপুল অঙ্কগুলো আমরা শুনতে পাই, তার মধ্যে বিদেশে ডলার-পাউন্ডে কেনা টিকিট-সেল ধরা থাকে। ইয়র্কে, শহরের মধ্যে না হলেও, শহরের বাইরের বা কাছের শহর লিডসের একাধিক মাল্টিপ্লেক্সে বলিউড আজ পৌঁছে গেছে। এমনকী দক্ষিণী সিনেমাও বিদেশের হলে ঢুকে পড়েছে, কিন্তু বাংলা ছবির পরিবেশকরা আজও শুচিবায়ুগ্রস্তই রয়ে গেলেন। বিদেশে বিক্রীত সংস্কৃতি মানেই তাঁদের কাছে বোধ করি বিকৃত, অপসংস্কৃতি।
ফলস্বরূপ, বাইশে শ্রাবণ বা ভূতের ভবিষ্যৎ দেখতে হলে ভবিষ্যতের শ্রাবণে ডিভিডি প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। বিনোদন হিসেবে পাগলু-২ হয়তো অনেক গড়পড়তা বলিউডি সিনেমাকে টেক্কা দিতে পারবে, কিন্তু বিলেতের দর্শকের কাছে আসবে না। এই দর্শকরা যে শুধু বাঙালি বা ভারতীয়, এমনটা ভাবা ভুল হবে। ‘অথেনটিক ইন্ডিয়ান’ খাবারের মতো নানা দেশের স্বতন্ত্র ছায়াছবির চাহিদা দিন কে দিন বাড়ছে। আমরাই জোগান দিতে বিমুখ। এ তো হল প্রত্যক্ষ ক্ষতি, পরোক্ষ ক্ষতিও কম নেই। বিদেশে অনেক বাঙালি পরিচালক আছেন, যাঁরা এই ‘বাজারি’ যুক্তিতেই বাংলায় সিনেমা করতে নারাজ। যেমন, সঙ্গীতা দত্ত। সঙ্গীতার প্রথম ছবি ‘লাইফ গোজ অন’। বাঙালি পুরুষরা ঠিক যা যা সমস্যায় ভয় পাই, তাই নিয়েই এই ছবি। অথচ, এর ভাষা বাংলা নয়, ইংরাজি। শুধু যে বড় এক বাজার আমরা হারাচ্ছি তা নয়, অনেক সম্ভাবনারও গলা টিপে ধরছি।
অনেক বাঙালি সাহিত্যিক ইংরাজিতে লেখেন, কারণ বাংলার বাজার ইংরাজির আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় নগণ্য। বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে কিন্তু সাহিত্যের এই সমস্যা খাটে না। প্রবাসী বঙ্গসন্তান বাংলা পড়তে চান না, কিন্তু বাংলা সিনেমা দেখতে উদ্গ্রীব হয়ে আছেন। বাংলা সিনেমার নিজস্ব এক ভাষা আছে, সাবটাইটল-এ যা মারা পড়ে না; সাহিত্যের অনুবাদে যে সুবিধা মেলে না। উদাহরণ হিসেবে সত্যজিতের গল্প আর সন্দীপের ছবির তুলনা করা যেতে পারে। ইংরাজি অনুবাদের ফেলুদার থেকে, সাবটাইটল নিয়ে ছবিতে ফেলুদা বিদেশে তো বটেই, ভারতেরই ভিন্ন প্রদেশে অনেক বেশি গ্রহণীয়। বিলেতে অনুরণন, ইতি মৃণালিনী ডিভিডি-তে দেখে এখানকার নতুন প্রজন্ম বাংলা সিনেমায় উৎসাহী। প্রবাস কেন, খাস কলকাতার বুকে বসেই এ যুগের কোনও যুবককে রবীন্দ্র উপন্যাস আলোচনা করতে দেখেন? অথচ, নৌকাডুবির কাহিনির প্যাঁচ সিনেমায় দেখে তাদের আলোচনার তুফান তুলতে দেখেছি।
নববর্ষে আমরা এ বারও ধুতি পরে, ফাইভ স্টার হোটেলের রেস্তোরাঁয় রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুনতে আমপোড়া সরবত আর ডাব-চিংড়ি খেলাম আর সাবেকি বাঙালিয়ানার প্রদর্শনী করলাম। আসুন এ বার নতুন ভাবে আমাদের বাঙালিয়ানাকে বিশ্বের দরবারে পেশ করি। আমাদের দেশজ বাংলা সিনেমা রফতানি করি। কহানির সাফল্যের পরে আমরা অনেকে ভাবছি টালিগঞ্জে বসে হিন্দি ছবি বানালে ভাল হয়। তার সময় এসে গেছে। সময় এসেছে ঠিকই, তবে নিজের কাজ সারা পৃথিবীকে দেখানোর, অন্যের কাজ করার নয়। আমি আমার মতো কাজ করি, সেটাই পণ্য হিসেবে অন্যরা ঠিকই কিনবে।
|
ব্রিটেনে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক |