অর্থাৎ যথার্থ সমালোচনা। গণতন্ত্রে সেটা জরুরি। কেবল
নাগরিক স্বাধীনতার
জন্য নয়, রাজ্যের উন্নয়নের জন্যও জরুরি। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল |
শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতারাই আমরা-ওরা করে থাকেন, তা নয়। সম্ভবত আমরা, সাধারণ ভাবে নাগরিক সমাজও এক ধরনের বনামের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’-এর চরমপন্থী অবস্থান ক্রমশ বাধ্যতামূলক হয়ে উঠছে আমাদের জীবনে। বৈদ্যুতিন চ্যানেলের প্যানেল আলোচনায় যোগ দিলে সঞ্চালক প্রথমেই জেনে নিতে চান, আপনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে বলবেন না বিপক্ষে? সম্প্রতি এমনই এক আলোচনাসভায় পক্ষ ও বিপক্ষের বললাম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক কাজকর্ম তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে আগ্রহ আমার, হতে পারে মুখ্যমন্ত্রীর কিছু কাজকর্ম সম্পর্কে আমি সমালোচনামূলক বা ক্রিটিকাল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি সি পি এমের পক্ষে, তার মানে এই নয় যে সামগ্রিক ভাবে মমতার সকল কাজকর্মের ভূত-ভবিষ্যৎ সবেরই কট্টর সমালোচক।
খুব সমস্যা, এ হেন সাদা-কালোর মাঝামাঝি ধূসরতায় দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলা মানে মধ্যপন্থা? ভারসাম্য রক্ষা করা অথচ জ্ঞানের দর্শন তো চিরকালই আমাদের শিখিয়েছে সংশ্লেষণ বা সিন্থেসিসের সত্য। সমগ্রতাকেই প্রকৃত জ্ঞান বলে জেনেছি, অন্ধের হস্তিদর্শনকে নয়। সম্প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে যে সব আলোচনা চলছে, সেখানেও দু’টি প্রবণতা। একটি মত হল, ক্ষমতায় আসার পরে তাঁর মাথার উপরে প্রধানমন্ত্রী বা কোনও মন্ত্রিসভার ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সেস’ নেই, আকস্মিক ক্ষমতার স্পটলাইট তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। তিনি এ রাজ্যের মুখিয়া বা সরপঞ্চ। কিন্তু মঞ্চে অবতীর্ণ হয়ে ক্ষমতার স্পটলাইটে মাথা ঘুরে বার বার পড়ে যাচ্ছেন প্রশাসনের মঞ্চে। তিনি ভুল করেও স্বীকার করতে জানেন না। বিলেতের এক সংবাদ-পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে ‘মিসচিফ মিনিস্টার’ অভিধা প্রয়োগ করা হয়েছে ।
বিপরীত মতটি হল, মুখ্যমন্ত্রীকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সি পি এম, কংগ্রেস এবং বৃহৎ মিডিয়ার একাংশ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। মমতা সাবঅলটার্ন অবয়ব। সমাজের উচ্চ শ্রেণির মনপসন্দ নয়, কিন্তু এখনও বাংলার, বিশেষত গ্রামীণ জনসমাজে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা। এই জনপ্রিয়তায় ঈর্ষাকাতর হয়ে বৃহৎ পুঁজিপতি শক্তি তাঁর ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টায় ব্রতী। |
প্রতিবাদী গণতন্ত্র। কলকাতা, এপ্রিল ২০১২ |
এই দুই চরমপন্থী অবস্থানের মধ্যে সীমিত না থেকে একটি নতুন প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক রাজনীতিকে দেখা দরকার। প্রথমত, এটা সত্য যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু ভুল করেছেন। আমার মনে হয়, মুখ্যমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় ভুল হল, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দোষী সাব্যস্ত না করে তার বা তাদের প্রধান রক্ষকর্তা হয়ে ওঠা। যেমন সি পি এমের সমর্থকদের বয়কট করা নিয়ে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক যা বলেছেন, গণতন্ত্রে সাংবিধানিক ব্যবস্থায় তা বলা যায় না। এমন নয় যে, খাদ্যমন্ত্রীকে সি পি এম সম্পর্কে ওই সব কথা বলার জন্য মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন। বস্তুত, তিনি জানতেনই না জ্যোতিপ্রিয় কী বলেছেন। কিন্তু ঘটনাটি শোনার পরে তাঁর উচিত ছিল সতীর্থের কৃতকর্ম থেকে নিজেকে আলাদা করা। একই ভাবে কার্টুন-কাণ্ডেও তিনি যখন বিষয়টি জানলেন, তখনই পুলিশ ও তাঁর দলের কিছু নেতার বিরুদ্ধে নিজেই বক্তব্য পেশ করে প্রশাসনিক মূল্যবোধকে দলীয় মূল্যবোধের ঊর্ধ্বে ঠাঁই দিতে পারতেন। সেটাই ছিল তাঁর কর্তব্য। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসুও এমনটা বহু বার করেছিলেন।
মনে হচ্ছে, মমতা এখনও এই রাজনৈতিক নিপুণতা অর্জন করতে পারেননি। তিনি যেন শিক্ষানবিশ মুখ্যমন্ত্রী। আবার এটাও বাস্তব যে, মানুষ ভুলের মধ্য দিয়েই শিক্ষা লাভ করে। তৃণমূল নেত্রী প্রকাশ্যে স্বীকার করুন আর না করুন, অন্য সকলের মতো তাঁকেও ঠেকে শিখতে হবে। শেখা দরকার।
অতীতে সি পি এম যখন শাসক দল ছিল, তখনও আমরা নানা নীতি, নানা বিষয়ে সি পি এমের কঠোর সমালোচনা করেছি। সে দিন সি পি এমের এক শীর্ষ নেতা বলেছিলেন, বৃহৎ সংবাদমাধ্যমের এই সমালোচনা হল ‘ধনগৌরবের ইতরতা’। কিন্তু সেই সমালোচনা ছিল বিষয়ভিত্তিক, নীতিভিত্তিক। তাই সি পি এমের শিল্পায়নের প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানালেও আমরা আইনশৃঙ্খলার অবনতি থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে দলতন্ত্রের মতো বিষয়ে তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়েছি।
আজ তৃণমূল ক্ষমতাসীন। আজও সংবাদ-কর্মী হিসেবে তৃণমূল অথবা সি পি এম, চোখ বুজে একটি পক্ষকেই বেছে নিতে হবে এমনটা কি গণতন্ত্রে অভিপ্রেত? তার চেয়ে মুক্ত চিন্তায় ভর দিয়ে ভাল কাজ হলে দরাজ গলায় ভাল বলব, ভুল হলেও ভুলকে ভুল বলব এই গণতন্ত্রই কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু সমালোচনা মানেই তা নেতিবাচক ষড়যন্ত্র নয়। বরং ছবিতে চন্দনের প্রলেপে অনেক সময় ছবির মুখ ঢেকে যায়। পূজার ছলে ভুলে থাকা অপরাধ। বরং সমালোচনার পরিসর গণতন্ত্রে শাসক দলকে ঋদ্ধ করে। নিয়ন্ত্রণে রাখে ‘কাল্ট’-এর বল্গাহীন উন্মাদনাকে।
ধীরে ধীরে এই সমালোচনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে রাজ্য সরকার। কিন্তু পাশাপাশি এটাও দেখতে হবে যে, সবে যে সরকার তার যাত্রা শুরু করেছে, তার সম্পর্কে অভিজাত একটি উচ্চ মাচায় উপবিষ্ট হয়ে শুধুই নিন্দামুখর হওয়া কোনও কাজের কথা নয়। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে গোরা পানুবাবুকে বলেছিলেন, পাঁউরুটি চিবোতে চিবোতে শুধু নিন্দা করলেই কি আপনার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? আপনি নিজে কি দায়িত্ব পালন করছেন?
সবাই মিলে মমতাকে গাল পাড়া আর প্রতিনিয়ত রকমারি ব্যঙ্গবিদ্রুপ, নানা ধরনের নিন্দাসূচক টুইট করাটাই এখন নাগরিক সমাজের ফ্যাশন। কিন্তু এটা কি ভেবেছেন, পশ্চিমবঙ্গে শাসক দল তৃণমূলের কোনও বিকল্প পরিসর কি এখন প্রস্তুত? ৩৪ বছরের সি পি এম শাসনে বিরক্ত মানুষ এখনও সি পি এমকে আবার মমতার বিকল্প হিসেবে ভাবতে পারছে না। কংগ্রেস বা বিজেপি তো কাছাকাছি কোথাও নেই। একদা কলকাতার শহুরে ভোটাররা ছিল কমিউনিস্ট-বিরোধী আদি কংগ্রেসের সঙ্গে, কংগ্রেসের অবক্ষয়ের সুযোগ নিয়ে এই পরিসরটি মূলত তৃণমূল কংগ্রেসই দখল করে। আবার গ্রামীণ বাংলার কৃষিভিত্তিই ছিল সি পি এমের সাংগঠনিক ভিত্তিস্থল। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে প্রশাসনিক ব্যর্থতার পরে তৃণমূলই এই পরিসর দখল করে। এখনও শহর ও গ্রামে তৃণমূলের সাংগঠনিক শক্তি ভেঙে পড়েছে এবং আবার সি পি এম সেই পরিস্থিতি দখল করেছে এ কথা সি পি এম নেতারাই বলছেন না। তা হলে বিকল্প রাজনৈতিক পরিসর যখন প্রস্তুত নয়, তখন সংবাদমাধ্যমের শুধু নয়, নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব এই রাজ্যটি যাতে নৈরাজ্যের দিকে, শূন্যতার দিকে চলে না যায়, সেটা দেখা। যে কোনও মূল্যে তাকে বাঁচাতে হবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একক ভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের স্রষ্টা। তিনি ভারতের রাজনীতিতে এক অন্যতম আইকন। পাঁচ বছর রাজ্য শাসন করার জন্য বিপুল জনাদেশ নিয়ে তিনি মহাকরণে ক্ষমতাসীন হয়েছেন। তাঁর ভুলের সমালোচনা করার অধিকার যেমন আমাদের আছে, ঠিক তেমনই সমবেদনা নিয়ে তাঁর সরকারকে ঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা দায়িত্বও আছে সাধারণ মানুষের। একতরফা নিন্দায় এ সরকারকে হতাশাগ্রস্ত করলে রাজনীতির পসরা কে কতটা ঘরে তুলতে পারবে, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবে রাজনৈতিক দল। কিন্তু এ রাজ্যে যদি শিল্প না হয়, উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে যায়, গোটা দুনিয়ার কাছে এ সরকার আবার পশ্চিমবঙ্গের ভাবমূর্তিকে ‘নেহি চলেগা নেহি চলেগা’র ছকে বেঁধে দেয়, তবে ষাট-সত্তর দশকের সেই বামপন্থী ইতিহাসের এক বিয়োগান্তক পুনরাবৃত্তি আমাদের কানাগলিতে পৌঁছে দেবে।
আশার পিঠে আশা নিয়েই তো বাঁচি আমরা। |