নাসরিন নিয়ে যাবেন জন্মভূমির তসবির
এই শহর মায়ের জন্নত, এক এক রুপিয়ার তাঁতের শাড়ি
তুন সংসার আর সন্তানের স্বপ্ন নিয়ে ১৯৪৮ সালের কলকাতায় পা রেখেছিলেন এক পাকিস্তানি তরুণী। এই শহরেই তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম। এ যাবৎ মায়ের চোখেই কলকাতাকে দেখেছেন সেই কন্যাসন্তানটি।
অবশেষে প্রৌঢ়ত্বে সেই শহরে এসে নাসরিন ওরফে মোনা কাসুরি বললেন, “দেশে যত দামি, যত সুন্দর জিনিসই পাওয়া যাক, মা বলতেন, ইয়ে তো কুছ ভি নেহি হ্যায়। কলকাতা মে...এমনকী কলকাতার মতো আম, কলাও নাকি কোথাও পাওয়া যায় না। ছোট থেকে এই শুনেই বড় হয়েছি।” মায়ের সেই ‘জন্নত’-এই তাঁর জন্ম। পাকিস্তানের বৃহত্তম বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার হোতা, প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী খুরশিদ মহম্মদ কাসুরির স্ত্রী, নাসরিনের তাই স্বপ্ন ছিল ভারতের দু’টি জায়গায় আসার। “বরাবর ভেবেছি, কলকাতা আর দুন স্কুলে আমাকে যেতেই হবে। বাবা দুন স্কুলে পড়েছিলেন। আর আমি জন্মেছি কলকাতায়। আট-ন মাস বয়সেই বাবা-মা আমাকে নিয়ে লাহৌরে চলে যান। তাই এ শহরের স্মৃতি বলতে আমার কিছুই নেই।” মা কী বললেন? “মা এখন আশি পেরিয়েছেন। এতটাই অসুস্থ যে জীবনের প্রতি আগ্রহও যেন চলে গিয়েছে। কলকাতায় আসছি শুনেও তেমন কিছু বলল না।”
মায়ের স্মৃতির শহর কলকাতা নাসরিনের কাছে তিনটি নাম বা ঠিকানা। তাঁর জন্মস্থান নার্সিংহোমের নাম, দাদু-দিদিমার বাড়ি (যেখানে ছিলেন তাঁর সন্তানসম্ভবা মা) আর নারকেলডাঙা (যেখানে কোহিনূর রাবার ওয়ার্কস গড়েছিলেন দাদু মহম্মদ সঈদ সেহগল)। পাকিস্তানে বাড়ি আর কলকাতায় ব্যবসা। বাবা মহম্মদ রফি মন্নু আর মা হামিদা সেহগলের ব্যবসায়ী পরিবারের পুরুষদের তাই নিয়মিত যাতায়াত চলত কলকাতা আর পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরের মধ্যে। মধ্য কলকাতায় একটি বাড়িও কিনেছিলেন দাদু। সন্তানসম্ভবা হওয়ার পরে মা-বাবা সেখানেই এসে ছিলেন। “বাবা-মায়ের বিয়ে হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। নতুন বিয়ে হওয়া একটা মেয়ে, সন্তান হবে, নতুন সব স্বপ্ন। মায়ের কাছে কলকাতা তখন তো একটা স্বর্গ।”
স্মৃতির খোঁজে মধ্য কলকাতার একটি বাড়িতে। ছবি: নিজস্ব চিত্র
সেই ‘জন্নতে’ তাঁর স্মৃতি ছুঁয়ে থাকা জায়গাগুলো কিছুটা খুঁজে রেখেছিলেন শহরের বন্ধুরা। ফলে মে দিবসের গনগনে রোদে প্রথম গন্তব্য মধ্য কলকাতার একটি বাড়ি। মায়ের কাছে শোনা গল্প থেকে যে বাড়ির স্মৃতি, “একটাই বাড়ি ছিল তখন। অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট ছিল বলেই মনে হয়। কারণ, অনেক চিনা প্রতিবেশি ছিল মায়েদের। ইহুদিরাও থাকতেন।” আজ সেই বাড়ি ভেঙে দু’টি আলাদা বাড়ি। নীচে অজস্র দোকান। পুরনো বাড়ির ঠিকানা ছিল ছয় নম্বর। সেই নম্বরের বর্তমান মালিক অগ্রবাল পরিবার। অতিথিদের স্বাগত জানাতে তাঁরা এসে দাঁড়িয়েছিলেন রাস্তায়। একতলার উঠোন থেকেই শুরু হয়েছিল স্মৃতিচারণ। উঠোন, বাড়িতে ঢোকার সরু গলি সব বার বার করে দেখে ছোট্ট ডায়রিতে নোট নিলেন নাসরিন। অরুণ জানালেন, তাঁর ঠাকুর্দা শ্যামলাল বাড়িটি কিনেছিলেন সেহগল পরিবারের থেকে। নতুন বউ হয়ে অরুণবাবুর মা, সাবিত্রী এসেছিলেন সেই নতুন বাড়িতে। বললেন, ‘বড় বড় আর কী উঁচু উঁচু ঘর! দোতলা বাড়ি, মনে হত তিন তলা।” তারপর বহু ভাঙাগড়া। নতুন চেহারার সেই বাড়ির ড্রইংরুমে বসে পাকিস্তানের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রীও মেতে উঠলেন আড্ডায়। পুরনো বাড়ির স্মৃতি হিসেবে দেখলেন সাদা-কালো কিছু ছবি। অরুণবাবুর মন্তব্য, “মনে হচ্ছে, পাকিস্তান থেকে পুরনো আত্মীয়দের আজ ফিরে পেলাম।”
পরের গন্তব্য বাংলার তাঁতের শাড়ির একটি দোকান। “তখন কলেজে পড়ি। এক দিন একটা পুরনো সুটকেস খুঁজে পেলাম। খুলে দেখি অপূর্ব সব শাড়ি। মা বললেন, তাঁতের শাড়ি। কলকাতায় থাকার সময় বাড়িতে এসে দিয়ে যেতেন এক মহিলা। এক এক রুপিয়া কি শাড়ি, মা বলেছিলেন, এখনও আমার কানে ভাসছে। অসাধারণ সেই সব শাড়ি পরেই আমার সারা কলেজ জীবন কেটেছে।” তাই এ বারেও দোকানে ঢুকে পাক্কা তাঁতের শাড়ি নিলেন, সবই হাল্কা রঙের। নিজের আর তিন পুত্রবধূর জন্য। স্বামী এক বার বলতে চেষ্টা করেছিলেন, একটু রঙচঙে শাড়ি কেনার কথা। স্ত্রী সাফ বললেন, ‘‘গরমে পরবে। হাল্কা রঙ। দেখতেও সুন্দর লাগবে, পরেও আরাম।” রেস্তোঁরায় বাঙালি খাবারের স্বাদ নেওয়ার পরে অবশেষে ‘জন্মভূমি’।
থিয়েটার রোডের নার্সিংহোমটি অবশ্য বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে গত চার বছর ধরে বন্ধ। গাছপালায় ঘেরা বাড়িটির দশা ভগ্ন। ধুলো পড়া, বাহারি রেলিংওলা সিঁড়ি বেয়ে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঢোকা। ভিতরেও সেই ধুলো। ভাঙাচোরা চেহারা। “মায়ের কাছে শুনেছি, ফরাসি ডাক্তাররাও এখানে আসতেন। মাত্র চার বছরেই এই অবস্থা হয়েছে?” এ সব দেখে মনের ভিতরে কী হচ্ছিল, তা বলা শক্ত। শুধু বললেন, “এই কেবিন, সিঁড়ি, করিডরের ছবিগুলো তুলে পাঠিয়ে দেবে? মাকে দেখাব।”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.