আনুষ্ঠানিক ভাবে কমিউনিস্টরা এখনও ‘বাম’ গণ্ডি পেরোতে নারাজ। কিন্তু কমিউনিস্ট হয়েও গণ্ডি পেরোতে চাইছেন কেউ কেউ!
গণ আন্দোলনের পথে দলের ভিত্তি প্রসারিত করতে শুধুমাত্র ‘বাম ঐক্যে’র সীমা ছাড়িয়ে ‘বৃহত্তর ঐক্যে’র প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সিপিআইয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। বিতর্কের কেন্দ্রে প্রবীণ শ্রমিক নেতা তথা সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্ত। যিনি ট্রেড ইউনিয়ন স্তরে ফলিত ভাবে ‘বৃহত্তর ঐক্যে’র মডেল প্রয়োগ করে চলতে মরিয়া! দলের রাজনৈতিক ‘লাইন’ যা-ই হোক!
কংগ্রেস, বিজেপি, মুসলিম লিগ, ডিএমকে-র মতো অ-বামপন্থী দলের শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি একযোগে গত ফেব্রুয়ারিতে দেশ জুড়ে সাধারণ ধর্মঘট পালন করেছিল। সেই ধর্মঘটের ‘সাফল্য’কে অভিনন্দন জানিয়েছে সিপিএম এবং সিপিআই, দুই কমিউনিস্ট দলের পার্টি কংগ্রেস। কিন্তু সেই ‘সাফল্যে’র উপরে ভিত্তি করে সিপিআইয়ের পার্টি কংগ্রেসে গুরুদাসবাবুর পেশ-করা বিকল্প প্রস্তাব গৃহীত হয়নি! সিপিএমের মতোই সিপিআই-ও বাম ও গণতান্ত্রিক ঐক্যের ডাক দিয়েছে। আর গুরুদাসবাবু দলের অন্দরে লড়ে চলেছেন এই বার্তা নিয়ে যে, “শুধু স্টিরিও-টাইপ স্লোগান-নির্ভর ঐক্যের ডাক থেকে বেরোতে না-পারলে বামেরা জাতীয় রাজনীতিতে আরও কোণঠাসা হবে।”
পটনায় পার্টি কংগ্রেসে সিপিআইয়ের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর প্রবীণ সদস্য গুরুদাসবাবুকে অবশ্য তাঁর বিকল্প প্রস্তাবটি পাঠ করতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা গ্রহণ করা হয়নি ‘টেকনিক্যাল’ কারণ দেখিয়ে। বলা হয়, পার্টি কংগ্রেসের আগেই নথিভুক্ত করার জন্য ওই প্রস্তাব জমা পড়েনি।
কিন্তু দলীয় নেতৃত্ব বা সিপিএমের শীর্ষ নেতাদের অনীহা সত্ত্বেও গুরুদাসবাবু তাঁর মতো করে এগিয়ে চলেছেন। এআইটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক হিসাবে চলতি সপ্তাহেই বৈঠক করেছেন আইএনটিইউসি-র সর্বভারতীয় সভাপতি জি সঞ্জীব রেড্ডির সঙ্গে। দল-নির্বিশেষে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির আপাতত পরিকল্পনা, খনি, ব্যাঙ্ক, বিমার মতো ক্ষেত্র ধরে ধরে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়িয়ে তোলা। এ ভাবে চলতে চলতে
আগামী বছরে গিয়ে আবার একটা সাধারণ ধর্মঘট। এখনই যেমন দক্ষিণে নাইভেলিতে অসংগঠিত শ্রমিক এবং উত্তরে দেরাদুনের কাছে কয়েকটি কারখানায় ‘ঐক্যবদ্ধ’ ধর্মঘট চলছে। দলের ‘বেড়া’ ভেঙে এই ঐক্যকেই বৃহত্তর ক্ষেত্রে তুলে নিয়ে যেতে চান গুরুদাসবাবুরা।
রাজ্যের সাংসদ গুরুদাসবাবুর বক্তব্য, “আমাদের আরও উদার হয়ে স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের শক্তি কমে গিয়েছে। এখন দুর্বার গণ আন্দোলনের পথে গিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে হবে। ঘুরেফিরে সেই তৃতীয় ফ্রন্ট বা বাম গণতান্ত্রিক ঐক্যের কথা বললে যে দলগুলির কথা মনে আসে, সেই ছবিটাই আঁকড়ে ধরে থাকলে চলবে না! ভবিষ্যতের নতুন নতুন রাজনৈতিক বিন্যাসের জন্য তৈরি থাকতে হবে।” বিকল্প প্রস্তাবে তিনি দেখিয়েছেন, কমিউনিস্ট আন্দোলন কোনও কালেই শুধু সংসদীয় শক্তির উপরে নির্ভরশীল ছিল না। তা হলে এখন সাংসদ-বিধায়ক কমে যাওয়ায় ‘রক্ষণশীলতা’কেই ধরে থাকার যুক্তি কী? তাঁর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘পুঁজিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে পাল্টা লড়াই করতে প্রস্তুত গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির বৃহত্তর ঐক্য দরকার। শুধু তৃতীয় ফ্রন্ট বা বাম গণতান্ত্রিক ঐক্যের স্লোগানের কথা বললে চলবে না। গণ আন্দোলনের প্রসার ঘটলে সামাজিক শক্তিগুলির পুনর্বিন্যাসের নতুন সুযোগ সামনে আসবে’।
প্রকাশ্যে স্বীকার করতে কুণ্ঠা হলেও সিপিএম এবং সিপিআই নেতৃত্ব ঘরোয়া ভাবে মানেন, বাম আন্দোলনের অনেক দাবিই তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের দিকে টেনে নিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে রাজ্যের দাবিদাওয়া আদায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে মমতার ‘লড়াই’ও বামপন্থী ঘরানাতেই। ‘বৃহত্তর ঐক্যে’র কথা বলে কি গুরুদাসবাবুরা ভবিষ্যতে তৃণমূলের মতো শক্তির জন্যও দরজা খোলা রাখতে চান? গুরুদাসবাবুর জবাব, “কোনও দলকে ভেবে আমি কিছু বলিনি। এই দল এবং স্লোগান-নির্ভর ভাবনার চেনা ছকই ভেঙে বেরোতে বলছি!” |