প্রবন্ধ...
‘টুইটার আর ফেসবুকটা কী, আমাকে বোঝাও’
থা বলতে বলতে আচম্বিতে মেহদি হসনের গজল গেয়ে ওঠেন মান্না দে। ‘আয়ে কুছ অবর কুছ শরাব আয়ে/উস কে বাদ আয়ে জো অজব আয়ে।’ সুরের ছোঁয়ায় পলকে ভিতরের যাবতীয় যন্ত্রণা মুছে গিয়ে ভোরের আলো। ফয়েজ আমেদ ফয়েজের উর্দু কবিতার অর্থ বলতে থাকেন বাংলায়। “মানেটা পুরো না জেনে গান করা যায় নাকি?” ঠিক তারপরেই কণ্ঠে সরগমের নাটকীয় মোচড়। তাঁর সামনে বয়স নতজানু।
এই তো, কাল বাদ পরশু, মে মাসের পয়লা তাঁর জন্মদিন। মে ডে, মহারাষ্ট্র ডে, মান্না দে। তাঁর জন্মদিন পালনের দিন মুম্বইয়ের সঙ্গীত মহল এমনই বলত। তিরানব্বই বছর কেটে গেল। আপাতত, একশোর দিকে খুব দৃপ্ত ভাবে চলেছেন মান্না দে। অথচ, যাত্রাপথটি বিষণ্ণ হয়ে এল যে! সন্দেহ নেই, এই জন্মদিনটি বিষণ্ণতম। ৫৯ বছরের সঙ্গিনী, স্ত্রী সুলোচনা, চলে গিয়েছেন। নির্জনে, নিজের বাড়িতে কান পাতেন মান্না দে। ওই মহাসিন্ধুর ও পার থেকে কী সঙ্গীত ভেসে আসে!
এখন চলতে ফিরতে কষ্ট। হাঁটতে হয় ওয়াকার নিয়ে। পিঠের যন্ত্রণাটা বাড়লে শুয়ে পড়তে হয়। আরও যন্ত্রণার, ফাংশানের প্রচুর ডাক এলেও যাওয়া হয় না দীর্ঘ দিন। সদ্য-প্রয়াত স্ত্রীর ছবি ঘর জুড়ে। তাঁর কথা উঠলেই কান্না এসে আড়াল করে দেয় কথা। “রবীন্দ্রনাথের উপরে একটা বই পড়ছিলাম সে দিন। এত শোক পেয়েছেন জীবনে। তবু কী শান্ত ভাবে নিয়েছেন। সব শোক বুকে নিয়ে বলেছেন, ‘তবে তাই হোক’। কী আশ্চর্য কথা। তবে তাই হোক।” বলা শেষ হয় না। থেমে যান। দীর্ঘ সময় স্তব্ধ টেলিফোন।
এখন এমন কেউ আছেন, যাঁর সঙ্গে গান নিয়ে লম্বা আড্ডা দিতে ইচ্ছে করে? “গুলাম আলি। ওঁর প্রত্যেক গানে বোঝা যায়, কী চমৎকার শিক্ষা। রীতিমতো শিখে গান করেছেন। আমি এত শিখতে পারিনি। অনেক শেখা বাকি থাকল।”
আশ্চর্য, মান্না দে-ই না এক সময় গেয়েছিলেন,
“মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়
মনে হয়, জীবনের কত কাজ সারা হয়ে গেল
আরও কত বাকি রয়ে গেল।”

সত্যি? এখনও বাকি? আরও কত কাজ বাকি রয়ে গেল! আরও কত গান! বেঙ্গালুরুর কল্যাণনগরের নির্জন বাড়িতে মান্না দে-র মাথায় নতুন রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক গানের অ্যালবামের স্বপ্ন। তিরানব্বইয়েও মান্না দে-র অভিধানে ‘অবসর’ শব্দটি নেই।

অসংখ্য রবীন্দ্রসঙ্গীত মুখস্থ। “আমি অবসরে গান শুনি। বাংলা গানই বেশি।” গান শোনার ফাঁকে ফোন যায় কলকাতার পরিচিতদের কাছে। ধীরেন মিত্রের গলায় ‘নীলাম্বরি নীল শাড়ি পরে নীল যমুনায় কে যায়’ শুনেছ? ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর বাংলা গান কী চমৎকার গলা! পছন্দের গীতিকারদের কাছ থেকে লেখা চাইছেন। এখনও প্রেমের গান পেলে সুর করতে বসে যান মান্না। মাঝে বলছিলেন, “ওই ইংরেজি গানটার বাংলা হয় না? হ্যাভ আই টোল্ড ইউ লেটলি দ্যাট আই লাভ ইউ?”
গান তো আছেই। সঙ্গে, আছে একটি মন। পৃথিবীর সব কিছু নিয়ে অসম্ভব কৌতূহলী মন। “টুইটার আর ফেসবুকটা কী, আমাকে বোঝাও!” আই পি এল শুরুর দিন বিকেলের দিকে ফোন। “আই পি এল-টা কোন চ্যানেলে দেখাবে? এত বেশি মারে, দেখতে ইচ্ছে হয় না!” বার্সেলোনা-রিয়াল হেরে যাওয়ার পর দিন ফোন। “রাবিশ! রোনাল্ডো-মেসি-কাকা তিন জনেই পেনাল্টি নষ্ট করল! কী হল ওদের?”
বয়স তাঁর বাচনভঙ্গিতে থাবা বসাতে পারেনি। ফলে, মান্না দে-র স্বকণ্ঠে তাঁর জীবনের বিভিন্ন অ্যানেকডোট শোনা একটি আশ্চর্য দৃশ্য-শ্রাব্য অভিজ্ঞতা। হিন্দিতে কোনও গল্প করতে গেলে গুজরাতি ভদ্রলোকের সংলাপ মান্না বলবেন গুজরাতিতে। মরাঠি ভদ্রলোকের সংলাপ মরাঠিতে। উর্দু-বলিয়ে লোকের সংলাপ চোস্ত উর্দুতে। বাঙালি থাকলে অবশ্যই বাংলায়।
অতঃপর, স্মৃতি। তা এতটাই নিখুঁত যে একে এক সময় প্রায় অলৌকিক ঠেকে। নিজের অধিকাংশ গানের সুরকার-গীতিকারদের নাম বলে দিতে পারেন আজও।
স্মৃতিধর হওয়ার ব্যাপারটা না হয় কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কাছে পাওয়া, কিন্তু সংলাপ বলার এই স্টাইল?
মান্না হাসেন, “আমি সবার কথা বলার স্টাইল ফলো করতাম প্রথম থেকে। সুরকাররা বলতেন, গানের মধ্যে মশলা ঢোকাতে। বদমাইশি ঢোকাতে। সেগুলো চেষ্টা করতাম।” বোঝাতে গিয়ে শোনালেন ফৈয়াজ খাঁ-র বিখ্যাত ঠুমরি ভেঙে মেহমুদের লিপে তাঁর গান, কাহে কো ঝুটি বানাও। “শচীনদা বলেছিলেন, পানওয়ালা মেহমুদের গলায় ঠুমরি গাইতে হবে।” তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় তৃপ্তি, সব ধরনের গান করতে পারা। এই বৈচিত্র তাঁর গানের স্বাক্ষর যেমন, তেমনই তাঁর ব্যক্তিত্বের অভিজ্ঞানও বটে।
রফি, কিশোর, তালাত, হেমন্ত এই চার গায়কের গল্পই বেশি শোনা যায় মান্নার মুখে। হেমন্তর মেয়ে রানু ছিলেন মান্নার খুব প্রিয়। হেমন্ত মান্নাকে বলেছিলেন, “আপনি সামলাতে পারেন রানুকে।” কিশোরকুমার ছেলে অমিতকে বলেছিলেন ‘মান্না-দা’র কাছে গান শিখতে যেতে। তালাতের বাঙালি স্ত্রী ছিলেন মান্নার স্ত্রী সুলোচনার গভীর বন্ধু। বাড়িতে যাতায়াত ছিল। আর রফি বলেছিলেন, “সবাই শোনেন আমার গান, আমি শুনি মান্নাদার গান।” সঙ্গে থাকা মান্না দে-র দ্রুত (এবং সবিনয়) সংযোজন, “না, না। রফি ও সব বলতে হয় বলে দিয়েছিল। আমার গান অত শুনত না।”
আড্ডার পরিসরে তিনি অসামান্য কথক, ফলে শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ। অথচ, তিনি স্বয়ং মাঝে মাঝে বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। কখনও আবার সুরে-কথায় কেটে যায় সেই মেঘ। আবার আসে। নির্জনতা ঘিরে ধরে তাঁকে। স্মৃতিরা দেখা করতে আসে।
মান্না দে গুনগুন করে ধরেন কাকার গান, ফিরে চলো ফিরে চলো ফিরে চলো আপন ঘরে...


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.