একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় প্রকাশ, ভারতে ১৫-১৯ বৎসর বয়ঃক্রমের ৫৭ শতাংশ ছেলে বিশ্বাস করে, স্ত্রীকে প্রহার করিবার মধ্যে কোনও অন্যায় নাই। একই বয়ঃক্রমের ৫৩ শতাংশ মেয়েও সহমত। উল্লেখ করা ভাল, এই পরিসংখ্যান যাহা বলিতেছে, সম্ভবত তাহার অনেক অধিক সংখ্যক ছেলেমেয়ে বিশ্বাস করে যে স্ত্রীকে প্রহার করা স্বামীর অধিকারভুক্ত তাহারা রাজনৈতিক শুদ্ধতার খাতিরে বিশ্বাসটি সমীক্ষকের নিকট প্রকাশ করে নাই। কিন্তু, যত জন কথাটি প্রকাশ্যে বলিয়াছে, সেই সংখ্যাটিই আতঙ্কিত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট এই বয়ঃসন্ধির প্রজন্মই একুশ শতকের ভারত। আর মাত্র কয়েকটি দিন, তাহার পরই ভারত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনটিতে পাকাপাকি ভাবে বসিল দেশ জুড়িয়া সর্ব ক্ষণ এই নেপথ্যসংগীত বাজাইয়া যাওয়ার পরেও একুশ শতকের ‘ইন্ডিয়া’-য় পুরুষতন্ত্রের দাঁত নখ সবই এখনও অক্ষত রহিয়াছে, ইহা সুসমাচার নহে। কিন্তু, ইহাই বাস্তব। এই বাস্তবটি অস্বীকার করিবার উপায় নাই।
পুরুষতন্ত্র কী ভাবে ঔচিত্যের সংজ্ঞা নির্মাণ করে, কী ভাবে ‘পুরুষ’-এর হিংস্রতাকে বৈধতা দেয়, তাহা বহু আলোচিত। এই সমীক্ষায় যে বয়ঃক্রমের ছেলেমেয়েরা পারিবারিক হিংসাকেই স্বাভাবিক বলিয়া মানিয়া লইয়াছে, তাহারা আপাতত পুরুষতন্ত্রের শিকার। এবং, একই সঙ্গে, তাহারা পুরুষতন্ত্রের ধারক হিসাবেও প্রস্তুত হইতেছে। ভারতে এখনও অধিকাংশ পরিবারেই পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য প্রশ্নাতীত। এই প্রাক্-যৌবন ছেলেমেয়েগুলি সেই পরিসরেই লালিত। ফলে, পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যের মধ্যে যে অন্যায় আছে, তাহা যে পরিত্যাজ্য, এই বোধটি পরিবারের পরিসরে গড়িয়া উঠিতে পারে নাই। তাহা বোধ হয় অনিবার্যই ছিল। কিন্তু, যে দেশ প্রাণপণে বিশ্ব-শক্তি হইয়া উঠিবার দাবি করিতেছে, সেই দেশে পরিবারের বাহিরে অন্যান্য পরিসরগুলিতেও পুরুষতন্ত্র এমন অপ্রতিরোধ্য থাকিল কী ভাবে? কেন স্কুল-কলেজে পুরুষতন্ত্রের কদর্য দিকটিকে ছাত্রছাত্রীদের সম্মুখে তুলিয়া ধরা হইল না? কেন টেলিভিশন-বাহিত বিনোদন পুরুষতন্ত্রের চেনা ছককেই পুষ্পে-পত্রে পল্লবিত করিয়া ঘরে ঘরে ছড়াইয়া দেয়? এই ব্যর্থতা নিঃসন্দেহে সমাজের। রাষ্ট্রেরও। কিন্তু, যে গভীর বেদনা, যে ব্যর্থতাবোধ অনুভূত হওয়ার কথা, তাহার তো চিহ্নমাত্র নাই।
একটি প্রশ্ন থাকিয়া যায়। যে কিশোরীরা স্ত্রীকে প্রহার করাকে স্বাভাবিক বলিয়াই গণ্য করিয়াছে, তাহাদের সেই স্বাভাবিকত্বের বোধটি কি বেদনারহিত? নাকি, তাহারা এই বেদনাকে অনিবার্য জানিয়াই মানিয়া লইয়াছে, এবং অনিবার্য বলিয়াই তাহাকে ‘স্বাভাবিক’ জ্ঞান করিয়াছে? প্রায় নিঃসংশয়ে বলা চলে, অনুমানটি যথার্থ। প্রহার হিংস্রতার চরম প্রকাশ, কিন্তু প্রাত্যহিকতার মধ্যে যে নারীর প্রতি হিংস্রতা থাকে, তাহাতে ক্ষতবিক্ষত না হইয়া অধিকাংশ ভারতীয় নারীরই উপায়ান্তর নাই। সেই হিংস্রতার বিপরীত প্রান্তে ‘প্রিয়জন’ থাকে বলিয়া তাহা স্বভাবতই আরও বেদনাদায়ক হয়। পরিবারের পরিসরে এই হিংস্রতাকে দমন করিতে হইলে বাহিরের পরিসরে সচেতনতা গড়িয়া তোলা ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। সমাজ সেই দায়িত্ব অস্বীকার করিতে পারে না। |