তদন্ত শেষই হল না, অভিযোগকারিণীকে ঠেলে দেওয়া হল ‘আইসোলেশন সেল’-এ।
তাদের হেফাজতে থাকাকালীন যৌন নিগ্রহের মতো গুরুতর অভিযোগের নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই অভিযোগকারিণীকে এমন ‘কোণঠাসা’ করার অভিযোগ উঠেছে রাজ্যের সব চেয়ে বড় সরকারি মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্র পাভলভ হাসপাতালের বিরুদ্ধে। এমনকী, অভিযোগ নথিভুক্ত হওয়ার চার দিন কেটে যাওয়ার পরেও কোনও মনোবিদকে ওই মানসিক রোগিণীর কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে।
বরং এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পাভলভের সুপার রাঘবেশ মজুমদার ওই রোগিণীকে চিহ্নিত করেছেন ‘ছেলেঘেঁষা’ বলে। কিন্তু, কোনও রোগিণী ‘ছেলেঘেঁষা’ হলেই কি তাঁর উপরে যৌন নির্যাতন চালানোর অধিকার জন্মে যায়? উত্তরে তিনি “ঠিক তা নয়” বলার পাশাপাশি হাসপাতালে কী কী নেই, তার ফিরিস্তি শুনিয়েছেন। তাঁর কথায়, “চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর ৬৭টা পদ খালি। অ্যাম্বুল্যান্স মাসে ১৫-২০ দিন খারাপ হয়ে পড়ে থাকে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবার জানিয়েও লাভ হয়নি। কী ভাবে হাসপাতাল চালাচ্ছি, তা আমিই জানি।”
অ্যাম্বুল্যান্স অকেজো থাকার খেসারত দিতে হয়েছে ওই রোগিণীকেও। হাসপাতাল সূত্রের খবর, ‘যৌন নিগ্রহের’ পরে রিকশায় চাপিয়ে তাঁকে চিকিৎসার জন্য ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। এক চিকিৎসক বলেন, “ন্যাশনালে প্রথম বার যাওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকেরা না থাকায় তাঁকে ফিরে আসতে হয়। কয়েক ঘণ্টা পরে রিকশা করেই ওই রোগিণীকে আবার ন্যাশনালে পাঠানো হয়। মানসিক তো বটেই, শারীরিক ভাবেও তিনি তখন বিধ্বস্ত।”
গত বৃহস্পতিবার রাতে পাভলভের এক ঠিকাকর্মী ওই রোগিণীর শ্লীলতাহানি করেন বলে অভিযোগ। হাসপাতালের তরফে শনিবার তপসিয়া থানায় এ বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করা হয়। কেন অভিযোগ জানাতে এত দেরি হল, সে প্রশ্নের কোনও উত্তর কর্তৃপক্ষের কাছে পাওয়া যায়নি।
মাস কয়েক আগে ওই তরুণীকে একটি মিশনারি হোম থেকে পাভলভে পাঠানো হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, ওই তরুণীর আচরণগত কিছু সমস্যা রয়েছে। তিনি পুরুষদের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হন। তা থেকেও এমন কিছু ঘটে থাকতে পারে। যদিও পাভলভের চিকিৎসক মহলের একটা বড় অংশের বক্তব্য, এমন নানা তকমা চাপিয়ে ওই রোগিণীর অভিযোগকে গোড়া থেকেই যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সেই কারণে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রেও অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। এমনকী, সুপ্রিম কোর্ট যখন ভুক্তভোগীর বয়ানকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে বলেছে, তখনও মানসিক রোগের কারণ দেখিয়ে বারবার বিষয়টিকে লঘু করার চেষ্টা চলছে।
অভিযোগকারিণীকে আইসোলেশন-এ রাখা কি পরোক্ষে তাঁকে শাস্তি দেওয়ারই নামান্তর নয়? পাভলভে তাঁর চিকিৎসক বিশ্বজিৎ দে বলেন, “এ ব্যাপারে আমি একটা কথাও বলব না।”
পাভলভের সুপার রাঘবেশবাবুর অবশ্য দাবি, ওই রোগিণীকে এ ভাবে আলাদা করে রাখার বিষয়টি সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। তিনি বলেন, “হয়তো কোনও কারণে মেয়েটি হিংস্র হয়ে উঠছিল। তাই আলাদা করে রাখতে হয়েছে। তবে এখন থেকে ফের সাধারণ ওয়ার্ডেই রাখা হবে।”
মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের তরফে রত্নাবলী রায় বলেন, “গোটা ঘটনায় হাসপাতাল স্তরে সংবেদনশীলতার অভাব খুব বেশি মাত্রায় লক্ষ করা গিয়েছে। অথচ, সরকারি হেফাজতে থাকাকালীন এমন একটি ঘটনা অনেক বেশি গুরুত্ব দাবি করে। তা ছাড়া, এটি ধর্ষণ না শ্লীলতাহানি, তা মেয়েটির বয়ানের ভিত্তিতে আদালত ঠিক করবে। আগে থেকেই কোনও চিকিৎসক বা সুপারের এই বিষয়ে মন্তব্য করার এক্তিয়ার নেই।”
স্বাস্থ্য দফতরের দায়িত্ব নেওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানসিক স্বাস্থ্যকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সমাজে মানসিক রোগীর সংখ্যা দিন দিন যে হারে বেড়ে চলেছে, তাতে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যার বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব না দিলে তার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে বলে মেনে নিয়েছিলেন স্বাস্থ্যকর্তারাও। তারই পরিপ্রেক্ষিতে পাভলভ মানসিক হাসপাতালের এই ঘটনা সরকারের প্রয়াসকেও খানিকটা ধাক্কা দেবে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যকর্তাদেরই একটা বড় অংশ। |