|
|
|
|
শিক্ষিকাকে ‘গালি’, জগ ‘ছুড়লেন’ তৃণমূল নেতা |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
রায়গঞ্জ কলেজে ঢুকে তৃণমূলের এক নেতা অধ্যক্ষ-নিগ্রহে ‘ইন্ধন’ জুগিয়েছিলেন। এ বার তৃণমূলের আর এক নেতার বিরুদ্ধে কলেজের ‘স্টাফরুমে’ ঢুকে শিক্ষিকাকে নিগ্রহের অভিযোগ উঠল। প্রতিবাদ করা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ‘শুনতে’ হল, ‘কী করে তোরা চাকরি করিস দেখব’, কিংবা ‘বাইরে চল, দেখাচ্ছি’।
মঙ্গলবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড় কলেজের ওই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা, প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলাম। তিনি ওই কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি। শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুটা-র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এক ‘মতান্তরের’ জেরে এ দিন তিনি ওই কলেজের এক শিক্ষিকাকে গালিগালাজ করে জলের জগ ছুড়ে মারেন বলে অভিযোগ। দেবযানী দে নামে ওই শিক্ষিকা থুতনিতে চোট পেয়েছেন। তবে পুলিশের কাছে নয়, কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পক্ষ থেকে আরাবুলের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করা হয়েছে ওয়েবকুটা-র কাছে। অভিযোগকারীদের বক্তব্য, এলাকায় ‘দাপুটে’ ওই নেতার বিরুদ্ধে সরাসরি পুলিশের দ্বারস্থ হতে তাঁরা সাহস পাচ্ছেন না। অভিযোগ অস্বীকার করে আরাবুল দাবি করেছেন, ওই কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশের হাজিরার ব্যাপারে ‘অনিয়ম’ রয়েছে। সে সব নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে। |
তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক
আরাবুল ইসলাম। |
‘হামলায়’ আহত ভাঙড়
কলেজের শিক্ষিকা দেবযানী দে। |
ছবি: সামসুল হুদা। |
|
এ দিনের এই ঘটনার নিন্দা করে ওয়েবকুটা-র পক্ষ থেকে ওই কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিরাপত্তার জন্য উপযুক্ত বন্দোবস্তের দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি, বিশিষ্ট শিক্ষকেরাও এই ঘটনার নিন্দা করেছেন। অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী বলেন, “যদি এ ঘটনা সত্য হয়, তা হলে বলতে হবে খুবই দুর্ভাগ্যজনক।” বিশিষ্ট ওই শিক্ষকের আক্ষেপ, “আশা করা গিয়েছিল, কলেজগুলি রাজনৈতিক দখলমুক্ত হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা হয়নি। এ-ও দেখা যাচ্ছে যে, বহু কলেজের সঙ্গে রাজনীতিকদের যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। এটা মোটেই কাম্য নয়।”
আরেক বিশিষ্ট শিক্ষক সুনন্দ সান্যালের কথায়, “এটা যদি দলতন্ত্র না হয়, তবে দলতন্ত্র আর কাকে বলব!” কেবল তাই নয়, প্রবীণ ওই শিক্ষকের প্রশ্ন, “তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের আস্কারা না পেলে আরাবুল এমন ঘটান কী করে!” কোনও স্তরে কোনও ধরনের ‘পরিবর্তন’ না হলে এমনই চলতে থাকবে বলেও তিনি আক্ষেপ করেছেন।
বামফ্রন্ট-বিরোধী মনোভাবসম্পন্ন বলে পরিচিত শিক্ষক সংগঠন ‘ডেমোক্র্যাটিক টিচার্স ফর অটোনমি অ্যান্ড অ্যাকাডেমিক ফ্রিডম’-এর পক্ষ থেকে এ দিন ব্যঙ্গচিত্র-কাণ্ডের প্রতিবাদে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে গোলপার্ক পর্যন্ত মিছিল করা হয়। অম্বিকেশ মহাপাত্রের ‘কাজের’ নিন্দা করে তাঁদের দাবি ছিল, বাইরে যে যাই করুন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দূষিত করা চলবে না। কিন্তু এ দিন আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দূষিত করার সমতুল নয়? ওই শিক্ষক সংগঠনের অন্যতম নেতা কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, “ঘটনাটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। খুবই অন্যায় হয়েছে।”
তৃণমূলের অন্দরেও কার্যত এই মন্তব্যেরই প্রতিধ্বনি। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ওই কলেজে গোলমালের অভিযোগ দলের কাছেও পৌঁছেছে। কলেজে কিংবা কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলার চেষ্টা দল বরদাস্ত করবে না। |
|
মঙ্গলবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূলপন্থী অধ্যাপকরা মিছিল করেন শহরে। ছবি: সুমন বল্লভ। |
কোন প্রেক্ষাপটে ওই কলেজে ঠিক কী ঘটেছে, তা দলের তরফে বিশদে খতিয়ে দেখা হবে। তাতে আরাবুলের দোষ প্রমাণ হলে দল যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। শুধু তা-ই নয়, ওই ঘটনায় অন্য কারও উস্কানি রয়েছে বলে বোঝা গেলেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।”
কলেজ সূত্রের খবর, ওয়েবকুটা-র একটি নির্বাচন উপলক্ষে প্রতি কলেজে ওই সংগঠনের প্রতিনিধি বাছাইয়ের কাজ চলছে। ভাঙড় কলেজে এ দিন সেই নির্বাচন ছিল দুপুর ২টোয়। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অভিযোগ, এ দিন সকালে আরাবুলের কয়েক জন প্রতিনিধি কলেজে এসে জানান, ওয়েবকুটা-র নির্বাচনে কাদের নাম যাবে, পরিচালন সমিতির সভাপতি সেই তালিকা তৈরি করে ফেলেছেন। সেই নামগুলিই (পাঁচটি) ওয়েবকুটা-য় পাঠানো হবে। কলেজের ভূগোলের শিক্ষিকা দেবযানী দে-র বক্তব্য, “সহকর্মী-মহলে আলোচনা করছিলাম, এর আগে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নামই ওয়েবকুটা-য় গিয়েছে। এ বারও তেমনই হোক না? কোনও ভাবে সে খবর চলে যায় সভাপতির কাছে।” কলেজ সূত্রের খবর, বেলা ১১টা নাগাদ কলেজে আসেন আরাবুল।
ওয়েবকুটার কাছে করা অভিযোগে কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানিয়েছেন, কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি কিছু বহিরাগত এবং এক দল ছাত্রকে নিয়ে শিক্ষিক-শিক্ষিকাদের ঘরে হাজির হন। জড়িয়ে পড়েন ‘তীব্র’ বাদানুবাদে। সেই সময় আরাবুল দেবযানী দেবীর দিকে জলের জগ ছুড়ে মারেন। দেবযানী জখম হন। ওই শিক্ষিকার কথায়, “২০০১ থেকে এই কলেজে পড়াচ্ছি। গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলায় এমন পরিস্থিতি আগে দেখিনি! আমরা ভীত, সন্ত্রস্ত!” |
সুকান্ত চৌধুরী: দেখা যাচ্ছে, কলেজগুলি রাজনৈতিক দখলমুক্ত হয়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক। |
সুনন্দ সান্যাল: তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের আস্কারা না পেলে আরাবুল এমন ঘটায় কী করে? |
|
এই ‘উত্তপ্ত পরিবেশ’ এবং ‘অবাঞ্ছিত ঘটনা’র ‘নেতৃত্বে’ আরাবুল ছিলেন বলে অধ্যক্ষ ননীগোপাল বারিকের কাছে অভিযোগ জানান কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। অধ্যক্ষ অবশ্য বলেন, “বেশ কয়েকদিন ধরে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ অনিয়মিত ভাবে কলেজে আসছেন বলে অভিযোগ করছিলেন সভাপতি। আজ তিনি টিচার্স রুমে গিয়েছিলেন তা জানি। কিন্তু ওখানে কী হয়েছে, তা জানি না।” শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি।
আরাবুল ইসলাম বলেন, “মাস তিনেক আগে কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি হয়েছি। তারপর থেকেই দেখেছি, অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা দেরিতে কলেজে আসেন, তাড়াতাড়ি চলে যান। কিন্তু হাজিরা খাতায় ঠিক সময় কলেজ ছেড়েছেন বলে সই করেন। সেই ব্যাপারেই আমি আজ আলোচনা করতে কলেজে গিয়েছিলাম।” তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “শিক্ষক-শিক্ষিকারাই আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন।” |
|
|
|
|
|