আর পাঁচটা সামাজিক অনুষ্ঠানের মতো অক্ষয় তৃতীয়াও এক সময়ে স্বীকৃত এর অনুষ্ঠান ছিল বহরমপুরে। কবিতা পাঠের আসর থেকে ছবির প্রদর্শনী, বাংলা গানেরও অনুষ্ঠান, জমজমাট এক বৈশাখী বিকেল হয়ে উঠত এ দিনটা। সময় গিয়েছে। হারিয়েছে অক্ষয় তৃতীয়ার জৌলুসও। তেমনই হারিয়ে গিয়েছে খাগড়ার সমৃদ্ধ ব্যবসায়ীদের বিরাট আয়োজনের সে দিনও। মুশির্দাবাদের সংগীত চর্চার ইতিহাসের গবেষক ষাটোধ্বর্র্ রমাপ্রসাদ ভাস্কর তাই বলেন, “আগে অক্ষয় তৃতীয়ায় হালখাতা করা হত মূলত সোনাপট্টিতে, খাগড়ায় কাঁসার বাসনের দোকানে ও কিছু মিষ্টান্নের দোকানে। এখন প্রায় সব ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানেই অক্ষয় তৃতীয়ার উৎসব পালন করা হয়। কিন্তু সেই উৎসবের চেহারা চরিত্র বদলে গিয়েছে।”
যা হারিয়েছে তা কী আর ফেরে! শহরের পুরনো বাসিন্দাদের তাই আফশোস যায় না। অক্ষয় তৃতীয়ার সকাল সার্বজনীন হয়ে উঠলেও ছোট-মেজ দোকানে এক টুকরো মিষ্টির প্যাকেটে তার সীমাবদ্ধতা। তবে হারিয়ে গিয়েছে সেই গান-কবিতার দিনগুলো। রমাবাবুদের কথায়, “ধর্মীয় অনুসঙ্গটাই মুছে গিয়েছে যেন।”
এ দিন লালবাগের ধরণি ধর ঘোষের কালীবাড়ির বয়স ২১৯ বছরে পা দিল। কিছু গেলেও কিছু রয়ে যায়, সেই কালীবাড়িতে এখনও রয়ে গিয়েছে অক্ষয় তৃতীয়ার অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে বসে মুর্শিদাবাদ জেলা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি অজয় সিংহ বলেন, “১২০০ সালের অক্ষয় তৃতীয়ার দিন ধরণী ধর ঘোষের কালীবাড়ির প্রতিষ্ঠা হয়। সে কারণে প্রতি বছর অক্ষয় তৃতীয়ার দিন এখানে অনুষ্ঠান হয়। বহরমপুরে মহাকালী পাঠশালা লাগোয়া দশমুণ্ড কালীবাড়িতেও অক্ষয় তৃতীয়ার দিন শুরু হওয়া মেলা চলে ১০ দিন ধরে। সেই ট্রাডিশন আজও কিন্তু চলছে।”
আবার কিছু ট্রাডিশন হারিয়েছে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও বহরমপুর শহরের গোরাবাজার এলাকার বাসিন্দা সমীরণ ঘোষ কবিতা লেখেন। তাঁর আক্ষেপ, “কৈশোরে ও যৌবনে দেখেছি অক্ষয় তৃতীয়ায় বহরমপুর শহরে কবিতা পাঠের আসর বসত, ছবির প্রদর্শনী হত, বাংলা গানেরও অনুষ্ঠান হত। এখন অক্ষয় তৃতীয়া কী সে সব ভাবা যায়!” তিনি জানান, আগে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন বাড়িতে ইলিশ, না চিংড়ির পদ হবে এবং তার রেসিপি কি হবে তা নিয়ে রীতিমতো চর্চা চলতো। এখনও সে সব মফস্সলের ছোটখাটো রেঁস্তোরায় সীমাবদ্ধ। অত্যাধুনিক সাজে সজ্জিত বহরমপুরের অভিজাত সোনার দোকানের এক কর্তা বলেন, “সোনার দাম বেড়ে যাওয়ার ছাপ পড়েছে অক্ষয় তৃতীয়ার উৎসবেও। ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একটা সামাজিক সর্ম্পক তৈরী হয়।”
বহরমপুরের মতো নবদ্বীপেও এ দিনটা একটু যেন অন্যরকম। বিভিন্ন মঠ-মন্দিরে এই দিনই শুরু হয় কৃষ্ণের চন্দনযাত্রা। এই উৎসবে কোনও পুজো, মন্ত্রপাঠ, যাগযজ্ঞ নেই। গানের সুরে, ফুলের সুগন্ধে উদ্যাপিত হয় কৃষ্ণপ্রেম। বিগ্রহকে সুগন্ধী জলে স্নান করিয়ে সর্বাঙ্গে পুরু করে চন্দন লেপে তাতে পরানো হয় ফুলের সাজ। রাতে রাধারমণ বাগ সমাজবাড়িতে রাধাকৃষ্ণ নৌকাবিহার করেন। বৈষ্ণবেরা একে বলে বিলাসী সেবা। সেবাইতদের পোশাক সাদা। অলঙ্কারও হয় মুক্তোর। জ্যোৎস্না রাতে রাধাকৃষ্ণের স্নান, বেশ বদল থেকে নৌকাবিহার এই প্রতিটি কাজই বাঁধা থাকে কীর্তনের সুরে। পুরাতত্ত্ব বিশারদেরা বলেন, প্রচণ্ড গরমে ধাতব বিগ্রহগুলির যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, সে জন্য চন্দনের প্রলেপের সঙ্গে ভেষজ উপাদনও থাকত আগে। চেষ্টা কর হত, বিগ্রহকে ঠান্ডা কোনও জায়গায় রাখতে। তাকে ঘিরেই তৈরি হয়ে গিয়েছে এক বৈশাখী উৎসবই। সেই প্রথা এখনও চলছে।
কিছু গিয়েও কিছু তো পড়ে রয়েছে! |