|
|
|
|
অবশেষে ‘জয়’, ছেলেকে ছাড়তে এলেন পালক পিতাও |
কাকার সঙ্গেই দেশে ফিরল অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যা |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
সাদার উপর কালো বুটির জামা পরা এক বছরের এক রত্তি আর তিন বছরের সবুজ টি-শার্ট।
হাতের আপেলটা তখনও খাওয়া শেষ হয়নি। দিল্লির বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর দরজা খুলে গেল। সামনে ক্যামেরার ঝলসানি, মন্ত্রী-সান্ত্রী, এক গুচ্ছ অচেনা মুখ। সবুজ টি-শার্ট মুখ লুকোলো পালক-পিতার কোলে। যাঁর কোল থেকে তাকে ছিনিয়ে আনার জন্যই এক বছরের লড়াই!
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ন’টা। আদালতের মারপ্যাঁচ, বিদেশমন্ত্রীর উদ্যোগ, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ সব পেরিয়ে দেশে ফিরল তিন বছরের অভিজ্ঞান আর এক বছরের ঐশ্বর্যা। অনুরূপ-সাগরিকার দুই সন্তান। ঠিক মতো দেখভাল হচ্ছে না বলে গত বছর মে মাসে যাদের নিয়ে গিয়েছিল নরওয়ের শিশুকল্যাণ বিভাগ। গত কাল আদালতের নির্দেশে তাদের তুলে দেওয়া হয়েছে কাকা অরুণাভাসের হাতে। নরওয়েতে ভারতীয় দূতাবাসের কর্তারা আর দেরি করেননি। পারিবারিক সূত্রের খবর, কেউ আদালতের রায়ে স্থগিতাদেশ চাইতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল।
এক বছরের মেয়েটা অবাক চোখে দেখছিল চারদিক। বাবা-মা কেউই সঙ্গে নেই। আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে বাবা অনুরূপ ভট্টাচার্য সঙ্গে আসতে পারেননি। এমনকী বিমানবন্দরেও যেতে পারেননি। মা সাগরিকা আগেই চলে এসেছেন। সন্তানদের পথ চেয়ে বসে রয়েছেন বিরাটির বাড়িতে। বুটি জামা পরা ঐশ্বর্যাকে কোলে তুলে নিলেন ঠাকুমা-ই। খাকি উর্দির যে জওয়ানরা এত ক্ষণ চোয়াল শক্ত করে ভিড় সরাচ্ছিলেন, তাঁদের চোখও ছলছল করে উঠল। বিদেশ প্রতিমন্ত্রী প্রণিত কউর পঞ্জাবের পোড় খাওয়া রাজনীতিক। তিনিও ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শুধু বলছিলেন, “এত সুন্দর দু’টো শিশুকে বাবা-মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, ভাবতেই পারছি না।” |
|
ঘরে ফেরা। নরওয়ে থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পর। মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। ছবি: দেবাশিস রায়। |
অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যাকে ফেরাতে বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ ব্যক্তিগত ভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও গত মাসে সোলে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তার পরেই আদালতে সুর নরম করে কাকার হাতে শিশুদের তুলে দিতে রাজি হয় নরওয়ের শিশুকল্যাণ বিভাগ। রায় বেরনোর পরে অরুণাভাস ও শিশুদের সঙ্গে নিয়ে গত সন্ধ্যাতেই নরওয়ে ছাড়ার বিমান ধরেন দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি পি বালচন্দ্রন। সঙ্গে নরওয়ের আধিকারিক এবং অভিজ্ঞানের পালক-পিতা স্পিগ-ও ছিলেন। গত এক বছর অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যা ছিল এই স্পিগ এবং তাঁর স্ত্রী মারিয়ানের কাছেই। এ দিনও স্পিগকেই আঁকড়ে ছিল অভিজ্ঞান। ভিড় দেখে যখন সে ঘাবড়ে যাচ্ছিল, শান্ত ভাবে তার মাথা কাঁধে টেনে নিচ্ছিলেন, মৃদু চাপড় দিয়ে আশ্বস্ত করছিলেন স্পিগই। কাল সম্ভবত ফিরে যাবেন তিনি।
নাতি-নাতনিরা আজ দিল্লি পৌঁছচ্ছে জেনে ভোরবেলাতেই কলকাতা থেকে দিল্লির বিমান ধরেন অনুরূপের বাবা-মা, অজয় ও শিখা ভট্টাচার্য। তাঁরা বিমানবন্দরেই অপেক্ষা করছিলেন। নাতি-নাতনিকে কোলে পেয়ে কারও মুখেই কথা ফুটছিল না। অরুণাভাস বললেন, “খুব ভাল লাগছে। সত্যিই খুব ভাল লাগছে।” পেশায় ডেন্টিস্ট অরুণাভাস নিজের কাজকর্ম ছেড়ে বহু দিন স্ট্যাভাঙ্গারে দাদার কাছে গিয়ে পড়েছিলেন। শেষে ভাইপো-ভাইঝিকে নিয়ে দেশে ফিরে বললেন, “এটা কিন্তু আমাদের জয়।” স্ট্যাভাঙ্গার থেকে অনুরূপ বলছিলেন, “এক বছর ধরে এই যুদ্ধ চালাচ্ছি। বাচ্চা দু’টোর উপরেও মারাত্মক প্রভাব পড়েছে।” গত এক বছরে সাগরিকার সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যেও যে আঘাত লেগেছে, সে কথা লুকোননি অনুরূপ। আদালত তাঁকে আপাতত মাস দুয়েক নরওয়ে ছাড়তে নিষেধ করেছে। তবে একবার সম্মতি মিললেই সে দেশের পাট চুকিয়ে এখানে ফিরবেন তিনি।
দিল্লিতে সময় নষ্ট করেননি অরুণাভাসও। বিকেলেই অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যাকে নিয়ে কলকাতার বিমান ধরেন। সন্ধে ৬.৫০ নাগাদ বিমান কলকাতার মাটি ছোঁয়। নরওয়ে থেকে কলকাতা দীর্ঘ বিমানযাত্রার ধকল! টাইম জোনের তফাৎ! মাইনাস ২০ ডিগ্রি-র স্ট্যাভাঙ্গার ছেড়ে ৩৫ ডিগ্রির দিল্লি, সেখান থেকে কলকাতা। বিমানবন্দরে দৃশ্যতই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল শিশু দু’টিকে। ঠাকুমা শিখাদেবী বলছিলেন, “আবহাওয়ার বদলটা ওরা এখনও মানাতে পারেনি। কিছু খাচ্ছে না। লুজ মোশন হচ্ছে!” ছটফট করছিল ততক্ষণে সাদা-নীল জামা পরে নেওয়া অভিজ্ঞান। ইংরেজিতে বলছিল, “ডায়াপার ভিজে গিয়েছে!”
বাইরে তত ক্ষণে উপচে পড়েছে সংবাদমাধ্যমের ভিড়। অরুণাভাস বেশ কিছুক্ষণ বাইরে বেরোননি। প্রায় ঘণ্টাখানেক বিমানবন্দরের ভিতরেই বসেছিলেন ওঁরা। এমনকী অন্য কোনও গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায় কি না, তাই নিয়ে রক্ষীদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেন। শেষ পর্যন্ত সামনে দিয়েই বেরোতে হল। অরুণাভাস সাংবাদিকদের বললেন, “আপনাদের সহযোগিতার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু এই মুহূর্তে একটু ছেড়ে দিন আমাদের।” এ দিন রাতেই কুলটিতে নিজেদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়ে গিয়েছেন ওঁরা। |
(কলকাতা থেকে সহ প্রতিবেদন: সুনন্দ ঘোষ) |
|
|
|
|
|