|
|
|
|
বনধে উত্তপ্ত ডুয়ার্স, প্রশাসনিক ভূমিকায় পক্ষপাত দেখছে মোর্চা |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
দুই দিনে দুই বনধ। কিন্তু রবিবারের সঙ্গে সোমবারের তরাই-ডুয়ার্স বনধের ফারাক ‘উত্তাপের’। পার্থক্য ‘রাজনৈতিক বার্তা’য়।
এই অবস্থায় পাহাড় ও তরাই-ডুয়ার্সে শান্তি বজায় রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছেই আবেদন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাহাড়ে ও ডুয়ার্সে যা চলছে, তা ‘ছোট্ট’ ঘটনা এবং তা নিয়ে ‘বেশি উতলা হওয়ার’ কিছু নেই বলে মন্তব্য করলেও একই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, যত দিন পর্যন্ত পরিস্থিতি ‘ঘোলাটে’ করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, তত দিন কোনও পক্ষকেই সভা বা মিছিল করার অনুমতি দেবে না রাজ্য সরকার। আর বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “কোনও আত্মসন্তুষ্টির মনোভাব না রেখে সব পক্ষকে আলোচনায় ডেকে সমাধানের চেষ্টা করা উচিত সরকারের। এই মুহূর্তে দক্ষিণের সফরে না গিয়ে উত্তরে মনোনিবেশ করা দরকার!” রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত, মুখ্যমন্ত্রীর জঙ্গলমহল সফরের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন বিরোধী দলনেতা।
ঘটনা হল, গত ১০ এপ্রিল মোর্চা শিবির বিরোধী ‘তরাই-ডুয়ার্স জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি’র ডাকে বনধ হয়। তার পরে ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (জিটিএ)-এ তরাই-ডুয়ার্সের অন্তর্ভুক্তির ‘চেষ্টা’র বিরোধিতায় গত কালই ‘তরাই-ডুয়ার্স জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি’র বনধ ডাকে। সেই বনধ জনজীবনে প্রভাব ফেললেও তাতে সে ভাবে বড় গোলমাল হয়নি। সেই বনধে পুলিশ-প্রশাসনের তরফে বাড়তি তৎপরতা বাসিন্দাদের নজরে পড়েনি। কিন্তু গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা শিবিরের ‘যৌথ মঞ্চ’-এর ডাকা অনির্দিষ্টকাল ডুয়ার্স বনধের প্রথম দিন, সোমবার সক্রিয় পুলিশ-প্রশাসনকে দেখল মানুষ। আর ঘটনা হল, সে দিনই গণ্ডগোল হল! ঘটনাস্থল বানারহাট ও ওদলাবাড়ি। বনধ সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ, দোকান-ট্রাকে আগুন লাগানো, মারধর, কোপানোর একাধিক ঘটনা ঘটেছে। দু’পক্ষের অন্তত ১০০ জন জখম হয়েছেন। লাঠি চালিয়ে, রবার বুলেট ছুড়ে, কাঁদানে গ্যাসের ‘শেল’ ফাটিয়ে, অন্তত শতাধিক বনধ সমর্থককে গ্রেফতার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে পুলিশ। আর দিনভর এই ‘উত্তাপ’ ঘিরে প্রশাসনিক ‘সক্রিয়তা’র মধ্যে নানা ‘রাজনৈতিক ভাষ্য’ খুঁজে পেয়েছেন সংশ্লিষ্টেরা। |
|
রণক্ষেত্র:
সংঘর্ষের আগুনে জ্বলছে বানারহাট। |
মোর্চা শিবিরের অভিযোগ, তাদের বনধ বানচাল করতে একাধিক রাজনৈতিক দল সম্মিলিত ভাবে উস্কানি দিচ্ছে এবং তা ‘জেনেও’ রাজ্য সরকার কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ‘শান্তিপূর্ণ’ বনধের সময়ে ওই রাজনৈতিক লোকজনেরাই আগুন লাগিয়ে, মারপিট করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে বলে মোর্চা নেতাদের দাবি। খোদ মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গের অভিযোগ, “জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির বনধ তো বানচালের চেষ্টা হয়নি। আমরাও কিছু করিনি। অথচ, এ দিন বানারহাট, বাগরাকোট-সহ বিভিন্ন এলাকায় হামলা করা হয়েছে বনধ সমর্থকদের উপরে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আমাদের সমর্থন দেখে ভয় পেয়ে কিছু লোককে টাকা দিয়ে ও মদ খাইয়ে এই কাজ করেছে। এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে।” ‘যৌথ মঞ্চ’-এর অন্যতম আহ্বায়ক জন বার্লার অভিযোগ, পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের ‘পক্ষপাতের’ জন্যই তাঁদের ডাকা বনধে গণ্ডগোলের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে তার পরেও বনধ প্রত্যাহার করার ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি মোর্চা শিবির। জন বার্লা রাতে বলেন, “বনধ শিথিল করা হয়েছে বলে কিছু মহল থেকে প্রচার করছে। তা ঠিক নয়।”
ঘটনা হল, সোমবার দিনভর অশান্তি রুখতে ‘তৎপরতায়’ ত্রুটি রাখেনি পুলিশ-প্রশাসন। ডুয়ার্সের মালবাজার, নাগরাকাটা, জয়গাঁ, কালচিনি, বীরপাড়া, বানারহাট, মাদারিহাট থানা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। রাজ্য সশস্ত্র পুলিশকে তরাই-ডুয়ার্স জুড়ে টহলদারিতে নামানো হয়েছে। ভুটান সীমান্তে পাহারায় থাকা এসএসবি জওয়ানদেরও সতর্ক করা হয়েছে। আজ, মঙ্গলবার জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে ‘সব রকম’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন।
রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ মনে করছেন, পুলিশ-প্রশাসনের এই ‘তৎপরতা’র মাধ্যমে পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সের সাম্প্রতিক সমস্যা নিয়ে তাদের ‘অবস্থান’ সম্পর্কে ‘বার্তা’ দিয়েছে রাজ্য সরকার। যার ইঙ্গিত মিলেছিল, নাগরাকাটায় রবিবার ‘যৌথ মঞ্চ’-এর সভার অনুমতি না দেওয়ার মধ্য দিয়ে। মোর্চার এক শীর্ষ নেতা ওই সভার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে ‘দরবার’ করায়, রাজ্যের তরফে ‘স্পষ্ট’ করে দেওয়া হয়, পাহাড়ে মুখ্যমন্ত্রী এবং অন্য মন্ত্রীদের ঢুকতে না দেওয়ার যে ‘হুমকি’ মোর্চা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন (পরে অস্বীকারও করেছেন) তাতে জিটিএ গঠন প্রক্রিয়ার উপরে ‘অনভিপ্রেত প্রভাব’ পড়তে পারে। কোনও কারণে ওই প্রক্রিয়া থমকে গেলে মোর্চার উপরেই তার ‘দায়ভার’ বর্তাবে। দার্জিলিং পাহাড়ের বাসিন্দাদের আবেগের কথা মাথায় রেখে জিটিএ-চুক্তি করা হলেও তরাই-ডুয়ার্সের মানুষের ‘সংবেদনশীলতায়’ আঘাত দিতে পারে, এমন কোনও ‘অবস্থান’ যে রাজ্য সরকার বরদাস্ত করবে না সেটা এ দিনের ‘উত্তেজক’ পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ-প্রশাসনের ‘তৎপরতার’ মাধ্যমে ফের মনে করানো হয়েছে। পাশাপাশি, মোর্চা ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে
মতবিরোধের সুযোগে পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সে ‘ঘোলাটে’ পরিস্থিতি তৈরির ‘চক্রান্ত’ বরদাস্ত করা হবে না বলেও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। |
|
বনধে সুনসান ৫৫ নম্বর জাতীয় সড়ক। |
এ দিন মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “দু’টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘাত হচ্ছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আগে থেকেই ছিল। একটা দল বনধ ডাকলে অন্য দল যদি মিছিল করে, তা হলে সংঘাত হতেই পারে। তাই প্রশাসন দু’পক্ষকেই সংযত থাকার অনুরোধ জানাচ্ছে। পরস্পরের প্রতি বিষোদ্গার বা এমন আচরণ করবেন না, যাতে শান্তি বিঘ্নিত হয়।” মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “দার্জিলিং নিয়ে যে চুক্তি (জিটিএ) হয়েছে, সরকার এবং অন্য যাঁরা সেই চুক্তিতে সই করেছেন, সকলকেই তা মেনে চলতে হবে। সরকার একটি নিরপেক্ষ কমিটিও তৈরি করেছে। সেই কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ীই শান্তিপূর্ণ ভাবে সব কিছুর সমাধান হবে।” তাঁর সংযোজন, “আমি পাহাড় এবং সমতল দুই-ই ভালবাসি। দুই চোখের একটি পাহাড় হলে, অন্যটি সমতল। মনে রাখবেন,দার্জিলিংও বাংলার, ডুয়ার্সও বাংলার। ব্যক্তিগত স্বার্থে কেউ সেখানে অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করবেন না।” তবে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা গৌতম দেব এ দিনের ঘটনায় ‘মদত’ দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন কংগ্রেস এবং সিপিএমের বিরুদ্ধে।
পক্ষান্তরে জিটিএ-তে নতুন এলাকা অন্তর্ভুক্তির প্রশ্ন ‘ডেমোক্লিসের তরবারির মতো ঝুলিয়ে রেখে’ (আসন্ন বিপদ) রাজ্য সরকার পাহাড়ের সমস্যাকে আরও জটিল করেছে বলে সিপিএম নেতৃত্বের অভিমত। দলের দার্জিলিং জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য অশোক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘তরাই-ডুয়ার্সের কিছু এলাকা অন্তর্ভুক্তির দাবি খতিয়ে দেখতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি তৈরিতেই গণ্ডগোলের সূত্রপাত।” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে তৃণমূল ও তাদের সরকারই এই বিপদকে ডেকে এনেছে।’ তবে আলিমুদ্দিনে এ দিন সূর্যবাবু বলেন, “মানুষের ঐক্যের জন্য কোনও সাহায্য রাজ্য সরকার চাইলে যে কোনও স্তরে সাহায্য করতে আমরা প্রস্তুত। কিন্তু সরকারের একটা রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। এটা ছোট, বিক্ষিপ্ত ঘটনা এই মনোভাবটাই খারাপ এবং বিপজ্জনক প্রবণতাও বটে। দ্রুত ৯০% সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে, সরকারের তরফে এই মনোভাবও ঠিক নয়। তাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত।” কাল, বুধবার রাজ্য বামফ্রন্টের বৈঠকে পাহাড় ও ডুয়ার্সের পরিস্থিতি আলোচনায় আসবে বলে বাম সূত্রের খবর। সেইমতো সার্বিক ভাবে বামফ্রন্টের তরফে অবস্থান ঠিক করা হবে।
রাজ্যের সঙ্গে সহযোগিতায় রাজি বলে জানিয়েছে কংগ্রেসেও। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রীর অভিযোগ উড়িয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা রাজ্যসভার সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “এই ঘটনার সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক নেই। তবে তরাই-ডুয়ার্সে দ্রুত উত্তেজনার উত্তাপ কমানো দরকার। কারণ কেবল রাজনীতিতে নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও এই ঘটনার প্রভাব পড়বে। মুখ্যমন্ত্রী মনে করলে উভয় পক্ষকে ডেকে বৈঠক করে সমস্যা মেটাতে পারেন। আবার সব দলকে ডেকেও আলোচনা করতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী এই ব্যাপারে সাহায্য চাইলে কংগ্রেস সহযোগিতা করবে।”
|
নিজস্ব চিত্র |
|
|
|
|
|