এক দিকে রাজ্য সরকারের তীব্র অর্থসঙ্কট। অন্য দিকে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলিয়ে অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষকদের পেনশনের আবেদন জমা পড়েছে ৭৫ হাজারেরও বেশি। ফলে শিক্ষক-শিক্ষিকারা অবসরের কত দিন পর পেনশন পাবেন, তা ক্রমেই অনিশ্চয়তার দিকে চলেছে।
সরকারি সূত্রে খবর, পেনশনের আবেদনের যে পরিমাণ ফাইল (পেনশন রিভিশন-সহ) জমেছে, তাতে সমস্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের পেনশন চালু করতে লাগবে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। শিক্ষকরা যাতে মাস পয়লায় বেতন পান, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে দিকে নজর দিয়েছেন। কর্মরত শিক্ষকদের মাইনে দিতে গেলে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পেনশনে টান পড়বে বলে অর্থ দফতরের অফিসাররা ইতিমধ্যেই অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে জানিয়েছেন। ফলে পেনশনের কাজ চলছে ধীর গতিতে।
পেনশন দফতরের এক মুখপাত্র অবশ্য দাবি করেন, “যত দ্রুত সম্ভব পেনশনের বকেয়া ফাইল ছাড়ার চেষ্টা হচ্ছে। এ জন্য বিশেষ জোরও দেওয়া হয়েছে। সরকারের অর্থসঙ্কট থাকলেও এখনও পর্যন্ত পেনশন পেমেন্ট অর্ডার (পিপিও) ছাড়ার পর ট্রেজারি কোনও শিক্ষকের পেনশন আটকায়নি।” সরকারি সূত্রে খবর, প্রতি মাসে গড়ে প্রায় আড়াই হাজার করে পিপিও ছাড়া হয়। সে হিসেবে অবসরের পরে এক জন শিক্ষকের পেনশন পেতে কম করে দু’বছর লাগবে।
অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকদের কত পেনশন-ফাইল জমা হয়েছে, তা নিয়ে পেনশনের দফতরের (অর্থ দফতরের অধীন) অফিসাররা সর্বশেষ বৈঠক করেছেন গত ৩০ জানুয়ারি। সেই বৈঠকের বিবরণীতে লেখা হয়েছে ‘সমস্ত দিক থেকে প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যে বিপুল পরিমাণ পেনশন ফাইল জমা আছে, তা ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না। যা পরিস্থিতি, তাতে ২০১২ সালের মার্চ মাসের মধ্যে বকেয়া পেনশন পেমেন্ট অর্ডার ছাড়ার যে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছিল, তা-ও কোনও ভাবেই পূরণ করা যাচ্ছে না’। গোটা বিষয়টি নিয়ে পেনশন অধিকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করেন বলেও সরকারি বিবরণীতে লেখা হয়েছে। এর পরেই জরুরি ভিত্তিতে কিছু ফাইল ছাড়া হয়। যে সব শিক্ষক স্বাস্থ্যের কারণ দেখিয়ে আবেদন করেছেন, তাঁদের পিপিও প্রদানের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। তা সত্ত্বেও ৩১ মার্চের পরে ৩৫ হাজার ফাইল পড়ে আছে বলে পেনশন দফতর সূত্রে খবর।
অর্থ দফতর সূত্রে খবর, পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও এখনও শুধু মাত্র বিধাননগরের পেনশন দফতরেই পেনশন রিভিশন-সহ ৩৫ হাজারের বেশি ফাইল পড়ে আছে। এ ছাড়া, কম্পিউটার প্রিন্ট-আউটের পরেও পিপিও পড়ে আছে প্রায় ৩ হাজার ৩০০। যা আগামী দিনে ছাড়া হবে। রাজ্যের সব ক’টি জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক অফিসে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলিয়ে আরও প্রায় ৪০ হাজার পেনশনের আবেদন জমা পড়েছে। যা পরবর্তী কালে বিধাননগরের পেনশন অফিসে পাঠানো হবে। অর্থ দফতরের অফিসারদের মতে, যে পরিমাণ ফাইল পড়ে আছে, তার বড় অংশই বাম আমলের। এমনকী, পেনশন রিভিশনের জন্য প্রাথমিক-শিক্ষকদের যে ১৬ হাজার এবং মাধ্যমিক-শিক্ষকদের ১০ হাজার ফাইল পড়ে আছে, তা-ও অধিকাংশই বাম-জমানার। কিন্তু এখন এই বকেয়া পেনশনের দায় বর্তেছে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর উপর। রাজ্যে প্রায় ৫২ হাজার প্রাথমিক স্কুল এবং ১২ হাজার মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩ লক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকাকে মাস পয়লায় সরকারকে বেতন দিতে হয়। অবসরের পর এক জন শিক্ষককে প্রতি মাসে পেনশন ছাড়া এককালীন গ্র্যাচুইটি ও পেনশন ‘কমিউট’-এর (পেনশনের সর্বাধিক ৪০% বিক্রি বা কমিউট করা যায়) টাকা দিতে হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের জন্য যার পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রেই সব মিলিয়ে প্রায় ১০-১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। গড়ে প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা অবসর নেন। ৩০ জানুয়ারির বৈঠকের সরকারি বিবরণীতে স্পষ্ট, যত চেষ্টা হোক, বকেয়া পেনশনের পাহাড় সরানোর কাজ কঠিন। তাই ক্রমশ পিছোচ্ছে এক জন শিক্ষকের অবসরের পর পেনশনের টাকা হাতে পাওয়ার দিন। |