তথ্য ভুল, অভিযোগ অসীমের
শুধু স্থগিত নয়, ঋণ ঢেলে সাজারও দাবি
রাজ্যের ঘাড়ে চেপে থাকা ঋণের ভার লাঘব করতে শুধু তিন বছরের জন্য সুদ ও আসল দেওয়া স্থগিত রাখাই নয়, সামগ্রিক ভাবে ঋণের শর্ত (মেয়াদ, সুদ ইত্যাদি) ঢেলে সাজার দাবি জানালেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। সোমবার ‘ফিকি’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের পরে তিনি বলেন, “আমরা শুধু তিন বছরের জন্য মোরাটোরিয়ামই চাইনি। পাশাপাশি দাবি করেছি, পুরো ঋণটাই ঢেলে সাজা হোক। ঢেলে সাজার প্রক্রিয়ার মধ্যে ঋণ মকুব, সুদের হার কমানো, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি সব কিছুই পড়ে।”
তিন বছর ঋণ পরিশোধ বন্ধ রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কেন্দ্রকে পনেরো দিনের ‘চরমসীমা’ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন অমিতবাবু সেই দাবিতে নতুন মাত্রা জুড়লেন। যদিও অর্থনীতিবিদদের একাংশের মতে, ঋণ পরিশোধ স্থগিত রাখা বা ঋণ ঢেলে সাজা কোনও পথেই রাজ্যের পক্ষে এই ঋণের ফাঁদ থেকে পাকাপাকি ভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
অমিতবাবুর এ দিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের এক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বলেন, “অর্থ কমিশন ইতিমধ্যেই সব রাজ্যের ঋণ ঢেলে সেজেছে। স্বল্প সঞ্চয় থেকে পাওয়া ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার কমানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ঋণের ক্ষেত্রে বেড়েছে পরিশোধের মেয়াদ। ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের আমলে পশ্চিমবঙ্গও এই সুবিধা পেয়েছে।” ফলে ঋণ ঢেলে সাজার সুযোগ কম বলেই তাঁর অভিমত।
ঋণ পরিশোধ আপাতত বন্ধ রাখার রাস্তায় হেঁটেও দীর্ঘ মেয়াদে রাজ্যের লাভ নেই বলে অধিকাংশ অর্থনীতিবিদের মত। তাঁদের বক্তব্য, সুদ তো আসলে মকুব করা হচ্ছে না। তিন বছর বন্ধ রাখতে চাওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ওই সময়ের পরে পুরো সুদটা আসলের সঙ্গে জুড়ে ঋণের বোঝা আরও অসহনীয় করে তুলবে।
রোগ যখন কঠিন, তখন তেতো দাওয়াই দেওয়ারই পক্ষপাতী অর্থনীতিবিদরা। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যকে প্রথমত রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে, দ্বিতীয়ত খরচ কমাতে হবে। কিন্তু কী আগের বামফ্রন্ট সরকার, কী এখনকার তৃণমূল সরকার কেউই রাজ্যের নিজস্ব আয় বাড়াতে ‘কঠোর’ কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।গত আর্থিক বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ৩০ শতাংশ রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির কথা বললেও বাস্তবে তা বেড়েছে মাত্র ১৮ শতাংশ।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য

রাজ্যের আয় বছরে ২১ হাজার কোটি টাকা। সুদ-আসল মিলিয়ে দিতে হয় বছরে ২২ হাজার কোটি।
অসীম দাশগুপ্তের জবাব
ওঁদের বাজেট বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১১-১২ সালে রাজস্ব আয় ২৫ হাজার কোটি। সুদ বাবদ ব্যয় ১৬ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব ও পুঁজিখাতে ওই বছরে মোট আয় ৮৭ হাজার কোটি। সুদ, আসল, বেতন ইত্যাদি মিলিয়ে ব্যয় ৬০ হাজার কোটি। অর্থাৎ হাতে থাকছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। তথ্য আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে একটু সতর্ক থাকা উচিত।
অমিত মিত্রের যুক্তি
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় সংসদে দাঁড়িয়েই মেনে নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ দেশের তিনটি ঋণগ্রস্ত রাজ্যের মধ্যে একেবারে প্রথমে রয়েছে। তখন আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর দাবি মেনে নিতে অসুবিধা কোথায়!
উল্টে নয়া জমানায় খরচের বহর বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। যার ফলে ঋণের উপরে মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়েছে রাজ্যকে।
২০১০-১১ আর্থিক বছরে রাজ্যের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত বাজার থেকে ধার নিয়েছিলেন ৯৫০০ কোটি টাকা। পরের আর্থিক বছরের মে মাসে নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়। ওই আর্থিক বছরের দশ মাসে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বাজার থেকে ধার নিয়েছেন ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অসীমবাবুর অভিযোগ, “এটা বাজার থেকে ধারের রেকর্ড। আমরাও কোনও দিন বাজার থেকে এত ধার করিনি।”
কিন্তু রাজ্যের নিজস্ব আয় বাড়ানোর কোনও উপায় কি ছিল না?
অর্থ দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, রাজ্যের আয় বাড়ানোর প্রধান উৎস শিল্প। কিন্তু শিল্পায়নের পথে রাজ্য যে খুব একটা এগিয়েছে তা নয়। যে রাজ্যে শিল্প নেই, সে রাজ্যের পক্ষে রাজস্ব বাড়ানোর জন্য অন্য উপায় খুঁজতেই হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। নাগরিকদের উপরে জলকর বা অন্য কোনও কর বসাতেও আপত্তি রয়েছে শাসক দলের। তোলা হচ্ছে না ভর্তুকিও। রাজ্যের অর্থ দফতরের কর্তাদের একাংশের মতে, রাজ্যের মদ-নীতিতে সামান্য পরিবর্তন আনলেই আবগারি রাজস্ব ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু জনমোহিনী রাজনীতির কারণে বাম বা বর্তমান কোনও সরকারই সে পথে হাঁটতে রাজি হয়নি।
কী ভাবে বাড়ানো যায় আবগারি রাজস্ব?
অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন,“রাজ্যে দেশি মদের দোকান চাহিদার তুলনায় যথেষ্টই কম। এই মদের দোকান খোলার অনুমতি দেওয়া হলেই আবগারি রাজস্ব এক লাফে বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে কমবে বেআইনি চোলাই মদের কারবারও। তাতে বিষ মদের হাত থেকে বাঁচবেন সাধারণ মানুষ। অন্য অনেক বড় রাজ্য সেই কাজটিই করে ফেলেছে। কিন্তু এখানে সেই কাজটি করতে সাহস পাননি কেউ।” বাম জমানার অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত অবশ্য শেষ দিকে ওই পথে হেঁটে আবগারি রাজস্ব বাড়ানোর জন্য কিছুটা চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সতর্কভাবে কিছু দেশি মদের দোকান বাড়িয়েছিলেন তিনি। এ ব্যাপারে তাঁর নীতি ছিল, ‘ভারসাম্যমূলক’ ভাবে দেশি মদের দোকান বাড়াতে হবে। এর জন্য তিনি একটি সর্বদলীয় বৈঠকও ডেকেছিলেন। কিন্তু ওই বৈঠকে দেশি মদের দোকান বাড়ানোর পক্ষে সায় দেননি তৃণমূল নেতৃত্ব।
নতুন সরকারের আমলে সরকারের খরচ লাফ দিয়ে বেড়েছে বলেও অর্থ দফতরের কর্তাদের বক্তব্য। নানা মেলা, পুরস্কার থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত ভোটের মুখে প্রকল্প ঘোষণার জেরে খরচের পাল্লা ক্রমেই ভারী হচ্ছে। যার জেরে বাধ্য হয়েই বাড়ছে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা।
এই পরিস্থিতিতে সুদ-স্থগিত ও ঋণ পুনর্গঠনকেই একমাত্র উপায় বলে মনে করছে রাজ্যের তৃণমূল নেতৃত্বাধীন সরকার। কেন্দ্রে সরকার চালানোর জন্য কংগ্রেস যে হেতু তৃণমূলের উপরে অনেকটাই নির্ভরশীল, সে হেতু এ ব্যাপারে তাদের উপরে চাপ দিচ্ছেন মমতা। পরিস্থিতি বিচার করে কংগ্রেস নেতৃত্বের মনোভাবও যথেষ্ট নরম। সোমবার ওয়াশিংটন থেকে দিল্লি ফিরে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গের নতুন সরকারের ঘাড়ে যে ৩৪ বছরের ঋণের বোঝা চেপে রয়েছে, সে ব্যাপারে আমরা অবহিত। এটাও ঠিক যে পঞ্জাব বা কেরলের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের ঋণের ভার বেশি। এ ব্যাপারে সমস্ত দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” আর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কপিল সিব্বল মমতাকে বার্তা দিয়ে বলেছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের জোটসঙ্গী। তাঁর সঙ্গে আমাদের জোট অব্যাহত থাকবে। দু’তরফের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব।”
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিশেষ একটি রাজ্যকে এই সুবিধা দেওয়া সম্ভব কি না, তা নিয়ে অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের মনে প্রশ্ন রয়েছে। তাঁদের বক্তব্য, সেটা হলে অন্য রাজ্যগুলি প্রশ্ন তুলবে। যদিও অমিতবাবুর বক্তব্য, “ঋণ নিয়ে পঞ্জাব, কেরল ও পশ্চিমবঙ্গের সমস্যার কথা কেন্দ্র নিজেই স্বীকার করেছে। তা হলে ওই তিন রাজ্যের জন্য বিশেষ আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের অঙ্গ হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি মেনে রাজ্যকে মোরাটোরিয়াম দিতে অসুবিধা কোথায়? ওই দাবি মানার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধা আছে বলে যাঁরা মন্তব্য করেছেন, তাঁদের কথার কোনও ভিত্তি নেই।” এ প্রসঙ্গে অসীমবাবু বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি মেনে কোনও রাজ্য যদি বাড়তি অর্থ পায়, তা হলে ভাল।” তবে তাঁর বক্তব্য, রাজ্যের উচিত কয়লার রয়্যালটির ‘ন্যায্য’ দাবি কেন্দ্রের কাছে তুলে ধরা। তা হলে বাড়তি ৫ হাজার কোটি টাকা পাওয়া সম্ভব। একই সঙ্গে তিনি বলেন, “রাজ্যের মোট ধারের পরিমাণের সঙ্গে স্বল্পসঞ্চয় খাত থেকে পাওয়া ৭৯ হাজার কোটি টাকা যুক্ত করা হয়েছে। এটা মকুব করার জন্য আমরা বার বার কেন্দ্রকে বলেছি। নতুন সরকারেও সেই দাবি তোলা উচিত।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.