|
|
|
|
এ বার জঙ্গলমহলের মতো ‘প্যাকেজ’ চায় সিঙ্গুরও |
গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় • সিঙ্গুর |
পরিবর্তনের ‘জমানা’য় আর কত ধৈর্য ধরতে হবে?
জমি-ভাগ্য ঝুলে রয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। সরকারের তরফে কোনও আর্থিক সহায়তা মেলেনি। কোনও বিশেষ সাহায্য নেই। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে সিঙ্গুরের। সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুনও ধিকি ধিকি জ্বলছে।
আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে রাজি সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’রা। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁদের একটাই দাবি, অন্তত জঙ্গলমহলের মতো কোনও ‘প্যাকেজ’ দিক রাজ্য সরকার। তাতে অন্তত সংসারটা বাঁচে।
সিঙ্গুর আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল বাজেমিলিয়া গ্রাম। সেখানকার বাসিন্দা আশা ঘোষ জমি আন্দোলনে প্রথম সারিতে ছিলেন। এখন সকাল-বিকেল রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন। টাটাদের প্রকল্পে তাঁর পাঁচ বিঘা জমি গিয়েছে। তাঁর ক্ষোভ, “দিদির অপেক্ষায় থেকে সাত বছর কেটে গেল। মদ খেয়ে মরলে সরকার টাকা দিচ্ছে। আগুনে পুড়লে সরকার টাকা দিচ্ছে। সরকারি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য আমাদের আর কী করতে হবে বলতে পারেন?”
শুধু আশাদেবীর নয়, এই ক্ষোভ ‘অনিচ্ছুক’দের বেশির ভাগেরই।
২০০৬ সালে টাটাদের গাড়ি কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণের দুঃখ ভুলতে পারেননি বহু গরিব গ্রামবাসী। তাঁরা পাশে পেয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তখন থেকে গ্রামবাসীদের নিয়ে বহু আন্দোলন করেছেন মমতা। পরামর্শ দিয়েছেন ‘ধৈর্য’ ধরার। আশ্বাস দিয়েছেন, জমি ফেরত দেওয়ার।
সিঙ্গুর-আন্দোলন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গত বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর তখ্তে বসিয়েছে। কিন্তু সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ গ্রামবাসীদের অবস্থার উন্নতি হয়নি। তাঁদের ‘শ্যাম ও কুল’ দুই-ই গিয়েছে। না ফেরত পেয়েছেন জমি, না নিয়েছেন ক্ষতিপূরণের টাকা। যত দিন গড়াচ্ছে, বাড়ছে তাঁদের হাহাকার। তাঁরা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন, “দিদি বোধহয় আমাদের একেবারেই ভুলে গেলেন। আর তো এখানে আসেন না। তাঁর দলের নেতাদেরও দেখা পাওয়া ভার।”
আন্দোলন পর্বে ৩৮ বার সিঙ্গুরে গিয়েছিলেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এখনও পর্যন্ত একবার। গত বছর ২৬ সেপ্টেম্বর। সে বারও গ্রামবাসীদের ধৈর্য না হারানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। বস্তুত, ক্ষমতায় আসার পরে নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম সিদ্ধান্তই ছিল ওই জমি ফেরত নিয়ে। সে জন্য প্রয়োজনীয় ‘বিল’ও আনে সরকার। কিন্তু তা নিয়ে জল গড়ায় কলকাতা হাইকোর্টে। মামলাটি এখনও বিচারাধীন। কবে সেই মামলার ফয়সালা হবে জানেন না সিঙ্গুরের গ্রামবাসীরা। স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের ‘ভূমিকা’তেও তাঁরা ক্ষুব্ধ।
|
জমি দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন যাঁরা |
|
|
|
|
আশা ঘোষ |
নবকুমার ঘোষ |
চিত্তরঞ্জন ঘোষ |
শ্যামাপদ ঘোষ |
|
২০০৬ সালের আগে পর্যন্ত উত্তর বাজেমিলিয়ার কমল খাড়া নিজের এক বিঘে পাঁচ কাঠা জমিতে চাষ করে দিব্য সংসার চালিয়ে নিতেন। কিন্তু সেই জমি চলে গিয়েছে টাটাদের প্রকল্প এলাকায়। এখন খেতমজুরি করেন। ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে রয়েছে। তাঁর প্রশ্ন, “কৃষিজমি বাঁচাও কমিটি করে আমরা আন্দোলন করলাম। আর এখন দল বেমালুম ভুলে গেল? এখন আর কোনও নেতাকে দেখতে পাই না। কী ভাবে মেয়ের বিয়ে দেব জানি না।”
বস্তুত, আন্দোলন-পর্বে সিঙ্গুরে স্থানীয় তৃণমূল নেতারা ‘অনিচ্ছুক’ গ্রামবাসীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখতেন। কারও চিকিৎসা বা পড়াশোনার প্রয়োজনে সাহায্য করতেন। কিন্তু এখন সে সব আর হয় না বলে গ্রামবাসীদের অভিযোগ। যেমন, সিঙ্গুরের বেড়াবেড়ির শ্যামাপদ ঘোষ বা বারোহাত কালীতলার বাসিন্দা গোপাল মালিকের ক্ষোভ, “গ্রামে তৃণমূল নেতাদের আনাগোনা কমে গিয়েছে। আমরা বাঁচি কী মরি, তাতে ওঁদের মনে হয় আর কিছু যায় আসে না। আবার হয়তো পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে ওঁদের দেখা মিলবে।”
গ্রামবাসীদের এই অভিযোগ নিয়ে কী বলছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা?
সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ে যিনি ছিলেন পুরোভাগে, সেই বেচারাম মান্না এখন হরিপালের বিধায়ক। তাঁর দাবি, “আমি ওখানে যাই না, এ কথা ঠিক নয়। চাষিদের মতামত আমি সব সময়েই দলনেত্রীকে জানাই। গ্রামবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। ওখানকার লোকও আমার কাছে আসেন।” আর সিঙ্গুরে তৃণমূল বিধায়ক তথা কৃষিমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য চাষিদের আর্থিক দুর্দশার কথা মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেন, “চাষিদের তরফে প্রস্তাব এসেছে আর্থিক সহায়তার জন্য। তাঁরা দলের সঙ্গেও কথা বলতে চান। এই পরিস্থিতিতে আমরা চাষিদের প্রস্তাব দলের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বকে জানাব।”
আপাতত ঠিক কী চাইছেন সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’রা?
জমি যে এখনই ফেরত পাওয়া যাবে না তা তাঁরা বিলক্ষণ বূঝে গিয়েছেন। গ্রামবাসীরা চান, জঙ্গলমহলের তিনটি জেলার জন্য রাজ্য সরকার যেমন বিশেষ ‘প্যাকেজ’-এর ব্যবস্থা করেছে, অন্তত তেমন কিছু করা হোক। সিঙ্গুর কৃষিজমি আন্দোলনের নেতা মহাদেব দাস বলেন, “আইনের জটে চাষিদের জীবিকা আটকে গিয়েছে। তাঁদের জন্য সরকার বা দলের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল।” বেড়াবেড়ি পূর্বপাড়ার বাসিন্দা চিত্তরঞ্জন ঘোষ বা খাসেরভেড়ির নবকুমার ঘোষও বলছেন, “জঙ্গলমহলের মানুষের মতো আমরাও তো একটা বিশেষ পরিস্থিতির শিকার। তা হলে আমাদের জন্য কেন সরকার বা দল কিছু ব্যবস্থা
করবে না?”
সিঙ্গুরের কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলনের আর এক নেতা পূর্ণেন্দু বসু এখন শ্রমমন্ত্রী। তিনি বলেন, “ওই এলাকায় মানুষের ক্ষোভ থাকলে আর্থিক সহায়তার প্রশ্নে সরকারের চিন্তাভাবনা করার সুযোগ রয়েছে। ওখানকার পরিস্থিতির উপরে আমাদের দলীয় নেতারা নজর রাখছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।”
কিন্তু আদৌ সরকার ‘সাহায্যে’র হাত বাড়াবে কি না, তা নিয়ে সিঙ্গুরের সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। |
|
|
|
|
|