প্রবন্ধ ২...
পেটের কথা ভুলেই গেলাম, কিন্তু পিঠ?
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সমীপেষু,
পূজনীয়া দিদি,
বড় ভয় করছে। দাদাদের অনেক বলেছি। কোনও কাজ হয়নি। তাই আপনাকে সরাসরি এই পত্র। বহু ব্যস্ততার মধ্যে সময় করে যদি এক বার পড়েন। অবশ্য এটা ধরেই নিচ্ছি, দাদারা এই চিঠি আপনার হাতে তুলে দেবেন।
সবই ঠিক ছিল। থানায় যেতে গেলে নাগরিক কমিটির পায়ে ধরা, বাড়ি করতে গেলে ইট, বালি, পাথর কার কাছ থেকে কিনতে হবে সেই নির্দেশ পালন। সেই ছোটবেলায় প্রাতঃকৃত্য করতে যাওয়ার আগে মাকে বলে যাওয়ার মতো। স্কুলেও ছোট ক্লাসে তার অন্যথা হত না। কিন্তু হঠাৎ মনে হল, উঁচু ক্লাসে উঠে গিয়েছি। মনে মনে বেশ একটা পরিবর্তনের প্রত্যাশা। মনে হল আমরা বড় হয়েছি। দাদাদের হুকুম আর মানব না। কার কাছ থেকে সবজি কিনব তা ওরা বলার কে? চাকরি দিতে পারে না, অথচ রোলের দোকান করে দু’মুঠো ভাত জোটাব, তার জন্যও দাদাদের পয়সা দিতে হত! তা-ও মেনে নিয়ে ছিলাম। বাড়িতে অকর্মণ্য দাদা। রোয়াকে বসে আড্ডা মারে। কিন্তু ভাই তো! এই ভেবেই মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু মনে মনে জানতাম অক্ষম যদি ক্ষমতা পায় তা হলে সে অন্যের ঘাড়ে বসেই খাবে। আমরা ‘তোলা’ বলি, কেউ কেউ একে অন্যায়ও বলে, কিন্তু এ জিনিস যখন মেনেই নেওয়া হয়েছে তখন আর লাফালাফি করে লাভ কী? তবে এটাও ঠিক, একই কাজের জন্য দুই দাদাকে পয়সা দিতে হত না। চাকরি করতে গেলেও একটু তোলা চড়াতে হত, তবে কোথায় চড়াতে হবে তা জানার বোধহয় নির্দিষ্ট উপায় ছিল।
হঠাৎ কী যে হল! আরও বড় দাদারা, যাঁরা অনেক লেখাপড়া করেছেন, যাঁদের নাম ছবি দিয়ে কাগজে ছাপে তাঁরা বললেন, “হঠাও এই কিল মারার গোঁসাইদের। বদল চাই। পেট না বাঁচুক মান তো বাঁচুক।” তা বটে। স্বাধীনতা হেলাফেলার জিনিস নয়। টাটারা পালিয়েছে। তাতে কী? গুজরাতের ভাল হয়েছে। ওদের দেখে আরও পাঁচটা গাড়ি কোম্পানি গুজরাতে টাকা ঢেলেছে। গুজরাতি মায়ের বাছাদের চাকরি হয়েছে। তো? আমরা না হয় দেশ গড়ি!
যাঁরা বলেছিলেন, পরিবর্তনের কথা, তাঁরা আমাদের মুখের কথাই কেড়ে নিয়ে বলেছিলেন। আপনার সঙ্গে হাঁটতে বলেছিলেন। বলেছিলেন গণতন্ত্রের কথা। আপনিও তো তা-ই বলেছিলেন। রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে দিনের পর দিন, মঞ্চের পর মঞ্চে, এক হাতে মাইক আর অন্য হাতে শাড়ির আঁচলের খুট। সাহস দিয়েছিলেন প্রতিবাদ করার। আপনার ভোটবাক্স ভরে দিলাম সেই প্রতিবাদের সুরে তাল মিলিয়ে। ফাঁকা পেটে, পিঠে সওয়ানো মুশকিল। তাই ভোট দিয়ে নিশ্চিন্তে ফিরলাম। দাদাদের মুখ মনে করে বললাম, “দেখ কেমন লাগে!” মা-মাসিরা বললেন, “অনাচারের দেশে গৌরী এল গো। এ বার গোলা ভরবে।” তা হলে এত দিন? রাসেল স্ট্রিটের পানের দোকানদার বললেন, “অসুরের উৎপাতও নিতে হয়। তবে তিনিই তো বধ করেন।” তা ভাল। মনে হল পুলিশের কাছে যেতে আর নাগরিক কমিটি করতে হবে না। পাড়ার জমির কী হল, সবাই তা জানবে।
কিন্তু দিদি, এক বছরও তো গেল না। সেই গৌরীকে এখন আর তেমন গৌরী লাগে না কেন? মা-মাসিরা টিভি খুলে আঁতকে ওঠেন কেন? রাসেল স্ট্রিটের পানওয়ালার গলাতেও তো আর সেই ভক্তির আর আশ্বাসের গভীরতা কানে ছুঁয়ে যায় না। আপনার গলাতেও কেন এমন ‘আমরা-ওরা’র সুর? তা হলে কি আমরা ভুল ভেবেছিলাম?
অনিচ্ছুক কৃষকের সংখ্যা বলে যা দাবি করেছিলেন আপনারা, সেটা সত্যি? না কি, সংখ্যাটা এতটাই কম যে সমঝোতা করা যেত? কিন্তু এই প্রশ্ন তোলা যাবে না। বলতে পারব না টাটার সঙ্গে অত বিনিয়োগ একসঙ্গে টানল গুজরাত, আমরা বসে বুড়ো আঙুল চুষলাম। হ্যাঁ, এটা ঠিক, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের দাপট রাজ্যবাসীকে বলে দিয়েছিল বামফ্রন্টের বুনো ওলের জবাবে একমাত্র আপনিই সেই বাঘা তেঁতুল। কিন্তু পরিবর্তন? টাটাদের যা হয়েছে হয়েছে। দিদি, আপনার দাপট প্রমাণের জন্য ভোটের আগে এর দরকার ছিল। আমরা ভেবেছিলাম, এটা রাজ্যের স্বল্পমেয়াদি ক্ষতি। কিন্তু ইনফোসিস? টাটা আর ইনফোসিস যোগ করলে বিনিয়োগের চিরবিদায়ের রাস্তা খুলে দিলাম আমরা। আপনার এস ই জেড নিয়ে আপত্তির মূল কারণ জমি। কিন্তু প্রথমত ইনফোসিস জমি জোগাড় করেছে আপনার ক্ষমতায় আসার আগেই। আর দুই, এদের তো অত জমি লাগে না। এটা হতে দিলে কিছু ছেলে চাকরি পেত। টাটা বিদায়ের ক্ষতেও মলম পড়ত। আপনি বললেন, “জমি কিনতে হবে। সরকার শিল্প গড়ার জন্য জমি কিনে দেবে না।” সেটাই নীতি। মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু একই সঙ্গে আপনি নিয়ম করলেন, জমি কিনলেই হবে না। সরকারি কমিটিকে জানাতে হবে কী শিল্প হচ্ছে। কমিটি অনুমতি দিলে তবে শিল্প হবে। এ তো বকলমায় সেই লাইসেন্স রাজ! আজকের দুনিয়ার বড় শিল্প সত্যিই কি এত খুচরো ঝামেলা মানবে? আপনার পূর্বসূরিরাও একই কাজ করে রাজ্যের শিল্পের সর্বনাশ করেছে। তা হলে পরিবর্তন?
আর স্বাধীনতা? শিল্পের স্বাধীনতা শুধু নয়, ব্যক্তির স্বাধীনতা? সে যদি থাকে, তবে নিউ গড়িয়ায় অধ্যাপক গ্রেফতার হলেন কী করে? সেই অকর্মণ্য দাদাদের পেটের ভাত জোগাড়ের চিরায়ত পদ্ধতি তো থামল না। একই সঙ্গে আপনার কিছু ভাই বলছেন, বামেদের সঙ্গে পাত ভাগ কোরো না, প্রতিশোধ নেওয়ার শক্তি কমে যাবে। এ পথ তো ‘ওদের’। অসহিষ্ণুতা, পেশির জোর, দলতন্ত্র। এর বিরুদ্ধেই তো ভোট। তা হলে?
দিদি, পেটের দায় গেছে আপনার ভোট বাক্সে। কিন্তু পিঠ? নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার? পশ্চিমী সাময়িকীতে প্রভাবশালীর তালিকায় আপনার নাম। আমরা গর্বিত। ১৯৩৮ সালে ওই সাময়িকীতে আর এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে দিয়ে প্রচ্ছদ হয়েছিল। তিনি তাঁর বইতে লিখেছিলেন: সাধারণ মানুষ সংবাদপত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভুল পথে চালিত হয়, রাষ্ট্রের দায়িত্ব এটা হতে না দেওয়া; যখন গোটা বিশ্ব যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সংবাদমাধ্যম তখন নাগরিকদের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী মনোভাব তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এটা বন্ধ করতে হবে।
তাঁর দেশে তাঁর জীবৎকালে এই প্রতিবেদনের কোনও প্রতিবাদ হয়নি। হলেও বাকি নাগরিকরা তার খবর পাননি।
তাই আমি ভীত। আর্থিক স্বাধীনতা বিনিয়োগহীনতার কারণেই হৃত। ব্যক্তিস্বাধীনতাও আমারই ভাইদের হাতে সমর্পিত। আপনি কি সত্যিই এমনই গৌরী?
ইতি
আপনার সবিশেষ আতঙ্কিত ভাই বেকুব


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.