|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
এ কোন দেশ? রামের না কি শিবঠাকুরের? |
মুখ্যমন্ত্রী ‘সবাই মিলে নতুন বাংলা’ গড়ার মোবাইল-আহ্বান পাঠিয়েছেন। অথচ ১৪১৯-এ হাসি,
ছড়া
ব্রাত্য।
ঔদ্ধত্য, ক্ষমতা, দলতন্ত্রের বাম জমানার আয়না-ছবি। ‘সবাই’ আর ‘নতুন’ কোথায়? লিখছেন
তিলোত্তমা মজুমদার |
পহেলা বৈশাখের প্রত্যুষ। পাখির কলতান, মৃদু সমীরণ, উষার নম্র কিরণে স্নাত পশ্চিমবঙ্গের সভ্যতা। চোখ মেললাম, আর সেলফোনে বার্তা প্রবেশনের সংকেত বাজল। নববর্ষের প্রসন্নতায় তাকে উন্মোচন করে দেখি, WBGOVT প্রেরিত বয়ান, SHUBHO NABABARSHE APNADER SAKALKE JANAI AAMAR ANTARIK PRITI-O-SUBHECCHA. SABAI BHALO THAKUN, SUSHTHA THAKUN. ASUN SABAI MILE NATUN BANGLA GORE TULIMAMATAA. |
|
কেন। অম্বিকেশ মহাপাত্রের লাঞ্ছনার প্রতিবাদে। যাদবপুর। ছবি: রাজীব বসু |
প্রথম ধাক্কায় প্রীতি লাভ করা গেল। নতুন বাংলা গড়ার উৎসাহ উসকে উঠল। কিন্তু এ কথাও না ভেবে পারা গেল না, নতুন বাংলায় অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রদের কী হবে? কিংবা বৈজ্ঞানিক পার্থসারথি রায়ের? আন্তর্জাতিক চাপ আছে বলে তিনি ছাড়া পাচ্ছেন, কিন্তু এই অন্যায় গ্রেফতারের ফলে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের মাথা হেঁট হয়ে গেল যে বিশ্বের কাছে, তার কী হবে? নোনাডাঙার উচ্ছিন্ন মানুষগুলোর কী হবে? কিংবা দেবলীনা চক্রবর্তীর? যাঁকে মাওবাদী সন্দেহে ইউএপিএ দেওয়া হল? সেই সংবাদপত্রগুলির কী হবে, যারা সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে নিষিদ্ধ হয়ে গেল? কী হবে আরও সব পেশাদারি বা অপেশাদারি কার্টুন আঁকিয়েদের? জেলে যাবেন কি সেই ছড়াকার, বা সমস্ত প্রেরক, ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকের হাতে প্রহার জুটবে তাঁদের, যাঁরা এই ছড়াটি ফোনবার্তায় প্রচার করছেন, ‘অতএব চুপ থাকো, প্রতিবাদ নাস্তি/ নইলে কপালে আছে যথোচিত শাস্তি/ কাকের কী যায় আসে/ পেকে গেলে বেলটা/ জাহাজ না পেয়ে কেউ/ পেয়ে গেলে রেলটা?...’ অথবা আরও একটা: ‘সাবধান, সাবধান চোদ্দোশো উনিশে/ শুভেচ্ছা জানালেও ধরে নেবে পুলিশে/ উপরি জুটবে কিছু পিঠে গালে দুমদাম/ মুচলেকা দিতে হবে তুমি নাকি ঘোর বাম।...’ অনুসন্ধান চলতে পারে কার এ চটুলতা। সংস্কৃতিময় রাজ্যে এখন হাসি নিষেধ। পড়া নিষেধ, আঁকা নিষেধ, লেখাও। কী হবে তাঁদের, যাঁরা এ সব করেন? প্রশ্ন উঠতে থাকে। একের পর এক।
তবে হ্যাঁ, কৃষকদের সম্পর্কে খানিক নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে। কৃষিসম্বল বঙ্গে ভাল চাষ দিতে পারলেই কৃষিরত্ন খেতাব মিলবে। কৃষককে পুরস্কৃত করার কথা কে কবে এমন করে ভেবেছে! সহজ শর্তে ঋণের সুবিধা এতেও সরকারের সদিচ্ছা প্রকাশ পায়। বিশেষত, নিকটেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। এ সরকার মসনদে বসার প্রথম দিকে মুখ্যমন্ত্রী হাসপাতালগুলিতে হানা দিয়ে চমকপ্রদ উচ্চাশার সঞ্চার করেছিলেন যেমন। মনে হয়েছিল, এই বার সরকারি হাসপাতালগুলি কর্মতৎপর ও সেবাপরায়ণ হয়ে উঠবে। বেশি দূর অবশ্য এগোয়নি। তবে কৃষকদের কথা আলাদা। কৃষকের সুবিধার জন্য অনেক বেশি পরিমাণ জমি সেচের আওতাভুক্ত হলে কিংবা ক্ষুদ্র জমি প্রসারিত করার ব্যবস্থা হলে, যোগাযোগ ও পরিবহণ সমৃদ্ধ হলে, উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ এবং ফড়েদের এড়িয়ে সরাসরি কেনাবেচার পরিকাঠামো গড়তে পারলে সত্যিকারের মঙ্গল হত কেবল কৃষকের নয়, সারা বাংলার।
কিন্তু এ সব কি এক দিনে হয়? নির্বাচনমুখী রাজনীতি চায় মুচমুচে হাতে গরম বুলবুলভাজা প্রকল্প। চৌত্রিশ বছরের জগদ্দল সরকার সরিয়ে কায়েম হওয়া বর্তমান সরকার তার ব্যতিক্রম হবে, এমন আশা ছিল বটে। তবে, কৃষিরত্ন যাঁরা ধারণ করবেন, তাঁদের এ কথাও মনে রাখতে হবে, ফলন ভাল না হলে, কিংবা ফসল পচে-টচে লোকসান গেলে আত্মহত্যা করা চলবে না। করলেই আপনি কৃষক থাকবেন না। অথবা, এই নববঙ্গে কোনও কৃষক ঋণের জালে বা অনাহারে আত্মহত্যা করতেই পারেন না, করলে তাঁর পারিবারিক অশান্তিই সেই আত্মহননের আসল কারণ। ঠিক যেমন বামশাসনে আমলাশোলের অস্তিত্ব প্রথমে স্বীকার করাই হয়নি। একই ভাবে নতুন সরকারের সুশাসিত রাজ্যে ধর্ষণ হলেই সাজানো, সরকারি ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে চক্রান্ত। সাংবাদিক সর্বসমক্ষে প্রহৃত হয়ে হাসপাতালে গেলেও তা অভিনয় ছাড়া কিছু নয়।
এ কোন রামের দেশ? রামের, না কি শিবঠাকুরের? সরকারের পক্ষে অনুকূল নয়, এমন সংবাদ পরিবেশনের বা সমালোচনার শাস্তি নেমে আসে সংবাদমাধ্যমের ওপর। আবার কিছু শাস্তি অচিরে প্রত্যাহার করা হয়, কিছু বা হয় না। অতীতে বাম জমানায় আমরা এমন দেখেছি। দেখেছি অগণিত এবং অধিকাংশ বেআইনি অটো চলতে দেওয়ার উদ্ধত প্রকাশ। এখন দেখছি লাল পাল্টে তেরঙা ধ্বজা। অটোর নির্যাতন ঠিক তেমনই আছে। শহরের ট্যাক্সিচালকেরা সেই একই রকম অভব্য এবং অসহযোগী। গরিব জনগণ আগের মতোই ব্ল্যাকে কেরোসিন কিনে স্টোভে ভাত ফোটায়। চাকরি দিতে না পারা অসংখ্য বেকারের কিছু অংশকে সংস্থান করিয়ে দেওয়ার এবং দলীয় মিছিলে ব্যবহার করার বাম অশুভ চক্র
একই রকম ক্রিয়া করে, পুলিশ একই রকম হৃদয়হীন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ইশারা চালিত যন্ত্র। যদিও, নববর্ষের প্রথম দিনে পুলিশও শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছে। রাজানুসরণই তার কর্তব্য কিনা, জনসুরক্ষা কেবল কাগুজে তত্ত্ব।
বাম সরকার লাল ঝান্ডা তুলে, ‘দিতে হবে’ স্লোগানের ধাক্কায় শিল্পগুলির সর্বনাশ করে, নতুন করে শিল্পস্থাপন করতে গিয়ে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ব্যর্থতা এবং নৃশংসতা জমিয়ে তুলেছিল, বর্তমান সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল সম্পর্কে শুচিবায়ুগ্রস্ত, কিন্তু নোনাডাঙায় উচ্ছেদ ঘটাতে পারে। কোনও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে, কেবল প্রতিশ্রুতি সম্বল করে, জমি তুলে দিতে পারে বাণিজ্যিক উদ্যোগের স্বার্থে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা পুলিশের তোয়াক্কা না করে সরাসরি শাস্তি দেয় অটোচালককে, কর্মিবৃন্দ অধ্যাপককে মারধোর করে, প্রতিবাদের নিরস্ত্র মিছিলে চড়াও হয় দললালিত লুম্পেন ঠিক আগেকার মতোই, মুখ্যমন্ত্রী মাওবাদী নেত্রী সুচিত্রার পাশাপাশি ছবি তুলতে পারেন, তাঁর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারেন, মণিপুরে সংগ্রামী শর্মিলা চানুকে দর্শন করে সম্মান জানিয়ে আসতে পারেন, আবার মাওবাদী সন্দেহেই দেবলীনাকে ইউএপিএ দেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রী এমনকী বলতে পারেন এখনও বলিনি কোন কাগজ পড়বেন... কিংবা, এখনই স্বৈরাচারী ইত্যাদি শব্দ খরচ করে ফেললে পরে কী বলবেন!
সেই ঔদ্ধত্য, সেই অগণতান্ত্রিক দলায়ন, সেই নির্বাচনমুখী পদক্ষেপ। উন্নয়নের স্বার্থে জবরদখলীকৃত জমি থেকে উচ্ছেদ করতে হতে পারে। কিন্তু তার জন্য অবশ্যকরণীয় ব্যবস্থা অবলম্বন না করলে সুশাসন জারি আছে বলা চলে না। কোটি কোটি দরিদ্র জনগণের এই দেশে নিঃসম্বল মানুষ একফালি জায়গাতেই শিকড় ছড়াতে চায়। উচ্ছেদ কর্মটির চেয়ে অনেক সভ্য এবং ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ জমি রক্ষা করা। দারিদ্র দূরীকরণের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা করা। বিগত সরকার তা বুঝেও বোঝেনি। বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন পুনর্বাসনের পক্ষে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার মা-মাটি-মানুষের স্লোগান দিয়ে বিপুল জনসমর্থনে যে সরকার আসীন হল, তার দায় যেমন বিশাল তেমনি মহত্ত্বের সম্ভাবনাও। আমরা সেই মহত্ত্বই আকাঙ্ক্ষা করি। বিরোধী থাকাকালীন যে প্রতিশ্রুতি, যে নীতি, যে সংবেদনশীলতার প্রকাশ ছিল, ক্ষমতালাভের অব্যবহিত পরেই তার বিপ্রতীপ প্রবণতা হতাশ করে। দুঃখিত করে।
বামফ্রন্ট সরকারের অন্যায়, দলতন্ত্র, ঔদ্ধত্য এবং নির্মমতার বিরুদ্ধে, অনুন্নয়ন এবং অরাজকতার বিরুদ্ধে অনেক স্বপ্ন এবং আশা নিয়ে তৃণমূলকে জনগণ নির্বাচন করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘শেষ বামপন্থী’ আখ্যা পেয়েছিলেন, নোয়াম চমস্কির সমর্থিত পত্রের প্রতিলিপি বিলি হয়েছিল মিছিল থেকে মিছিলে। আজ যখন তিনি প্রতিবাদ জানান, ক্ষমতা তাঁকে হেয় করে। কেন এই বাক্সর্বস্ব অসহিষ্ণুতা? সহযোগিতাপূর্ণ বিরোধিতাই একমাত্র উন্নয়নের সহায়ক, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠারও। কোনও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নয়, কেবল শূন্য ভাঁড়ারের গল্প এবং তার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাক্ষিণ্য বিতরণ করে আনুকূল্য ক্রয়। এ তা হলে কোন পরিবর্তন, যা ‘বদলা নয় বদল চাই’ স্লোগান হয়ে ঢোকে আর ঘৃণা এবং প্রতিশোধের ফাল হয়ে বেরোয়! নববর্ষের শুভেচ্ছার ভিতর যে সৌগন্ধ, উদ্বেল করার পরিবর্তে তা উদ্বিগ্ন করে কেন? |
|
|
|
|
|