পাওলি দাম অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্র ‘হেট স্টোরি’র বিজ্ঞাপনী পোস্টার প্রদর্শনে আদালতের নিষেধাজ্ঞা কিছু প্রশ্ন তুলিয়াছে। আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকিয়াও জিজ্ঞাসা করা দরকার, যে চলচ্চিত্র ইতিমধ্যেই সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাইয়াছে, তাহারই স্থিরচিত্র কেন দর্শকদের চরিত্র নষ্ট করার প্রেরণা হইয়া উঠিবে? একে তো সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাইতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। নাবালকমনস্ক দেশবাসীর চরিত্র ঠিক রাখার জ্যাঠামশায়গিরির ঠেলায় শিল্পসম্মত বহু দৃশ্য সংবেদনশীল পরিচালকদের চলচ্চিত্র হইতে ছাঁটিয়া ফেলা হয়। উপরন্তু এখন আইনের নির্দেশে ছাড়পত্র পাওয়া চলচ্চিত্রের দৃশ্য লইয়া রচিত পোস্টার প্রদর্শনেও বাধানিষেধ আরোপিত হইতেছে।
প্রায় ষাট বছর আগের একটি আইন মোতাবেক এই নিষেধাজ্ঞা। এই ষাট বছরে বঙ্গীয় সমাজ কি এতটুকুও বদলায় নাই? বাঙালির রুচি, স্পর্শকাতরতা, শালীনতার সংজ্ঞা অপরিবর্তিত থাকিয়াছে? তাহার সাংস্কৃতিক চেতনা, রসজ্ঞান, ব্যবহৃত পোশাকের দৈর্ঘ্য, সবই কি ষাট বছর আগেকার যুগে থমকাইয়া আছে? এমন নয় তো যে, সমাজ তাহার ভীরু ও দ্বিধাক্লিষ্ট স্পর্শকাতরতা ছাড়াইয়া আগাইয়া গিয়াছে, আইন ও তাহার প্রয়োগকর্তারা এখনও সেই অগ্রগতির প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ করেন নাই? মাননীয় বিচারপতিরা এই প্রশ্নগুলি গভীর ভাবে বিবেচনা করিলে সমাজর মঙ্গল হইতে পারে। বস্তুত, সংশ্লিষ্ট আইনটির যৌক্তিকতা ও কালৌচিত্য লইয়া প্রশ্ন তোলা জরুরি। প্রসঙ্গত, সমকামিতাকে দণ্ডনীয় ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করা ঔপনিবেশিক যুগের একটি আইন সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের বিধান প্রণিধানযোগ্য। মাননীয় বিচারপতিরা বলিয়াছিলেন, যে সমাজে সমকামকে ‘অস্বাভাবিক’ গণ্য করা হইত, তাহার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়া গিয়াছে, এখন ওই মানসিকতা ও তৎপ্রসূত আইন আঁকড়াইয়া থাকা হাস্যকর। এমন হাস্যকর ও অপ্রাসঙ্গিক বহু আইনই কিন্তু সমাজের অগ্রগতির পথে, বহুত্ববাদের পথে কাঁটা বিছাইয়া রাখে।
তামিলনাড়ু ছাড়া ভারতের আর কোনও রাজ্যে এই আইন নাই, যাহার বলে আদালত সেন্সর ছাড়পত্র পাওয়া একটি চলচ্চিত্রের পোস্টার প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিতে পারে। যত বস্তাপচা, গোঁড়ামিপ্রসূত, প্রতিক্রিয়াশীল আইন কি এই পশ্চিমবঙ্গেই থাকিতে হইবে? মনে করা যাইতে পারে, দেশের সব রাজ্যে পরিত্যক্ত জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনও কেবল পশ্চিমবঙ্গেই বহাল তবিয়তে বিরাজমান। শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক নবনির্মাণের রাস্তায় চলিতে গিয়া অন্য সব রাজ্যই এই আইনের ফাঁস হইতে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমিকে মুক্তি দিয়াছে, কেবল এই রাজ্য তাহাকে সযত্নে আঁকড়াইয়া আছে। এবং তাহাও জনহিতের দোহাই দিয়া। অনেক ক্ষেত্রে অবশ্য আইন থাকিলেও অবান্তর কিংবা বাতিলযোগ্য জ্ঞান করিয়া বিচারপতিরা সেগুলি প্রয়োগ করিতে চাহেন না। পশ্চিমবঙ্গের সে সৌভাগ্যও হয় না। তন্ন-তন্ন করিয়া খুঁজিয়া কেহ-না-কেহ আদিম কালের একুশে আইনগুলি ধূলা ঝাড়িয়া তাক হইতে নামাইয়া আনেন। আর তাহার জোরে নিষেধাজ্ঞাও জারি হয়। ইহার ফলে সমাজের মঙ্গল হয় কি? সমাজ অগ্রসর হয় কি? ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই অচল আইনগুলি বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ভবিতব্য লইয়াই হাজির। সেই কাজ দেশের আইনসভার সদস্যদের। তাঁহারা কাজটি সম্পাদন করিবেন কি? |