ভারতের মুখ্য অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা অধ্যাপক কৌশিক বসুর একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করিয়া গত কয়েক দিন রাজধানীর রাজনীতি আলোড়িত হইতেছে। কৌশিকবাবু যাহা বলিয়াছেন, তাহা তর্কাতীত। এবং, তাঁহার বক্তব্যে এমন একটিও শব্দ নাই, যাহা এত দিন পর্যন্ত রাজনীতির প্রধান কুশীলবদের নিকট অজ্ঞাত ছিল। তিনি বলিয়াছেন, দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি যে রকম, তাহাতে ২০১৪ সালের পূর্বে বড় মাপের সংস্কারের সম্ভাবনা নাই বলিয়াই আশঙ্কা। অধ্যাপকের এই আশঙ্কাটি তাঁহার ব্যক্তিগত নহে। ভারতীয় অর্থনীতি লইয়া যাঁহাদের কিছুমাত্র আগ্রহ আছে, তাঁহাদের মধ্যে এই আশঙ্কাটি এখন সর্বজনীন। আশঙ্কার প্রধান কারণ জোট রাজনীতির চলন। শরিকদের অন্যায্য চাপের সম্মুখে নতিস্বীকার করাই ইউ পি এ জোট সরকারের দ্বিতীয় দফার অভিজ্ঞান হইয়াছে। সরকার কার্যত মেরুদণ্ডহীন যে কোনও ক্ষেত্রেই এক পা আগাইলে একশত পা পিছাইয়া আসা ভিন্ন তাহার আর উপায়ান্তর নাই। ফলে, শরিকদের চাপে বহু-ব্র্যান্ড রিটেলে বিদেশি লগ্নির প্রস্তাব হইতে বিমা ও ব্যাঙ্কিং পরিষেবায় সংস্কার বহু জরুরি কাজই বকেয়া রহিয়াছে। বিভিন্ন রাজ্যের আপত্তিতে পণ্য ও পরিষেবা কর ব্যবস্থাটি ঝুলিয়া রহিয়াছে, প্রত্যক্ষ করবিধিও ভবিষ্যতের গর্ভে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলিলেন, দুর্নীতি ইত্যাদির ভয়ে আমলারাও যথাসাধ্য ঝুঁকি এড়াইয়া চলিতেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁহাদের কাজ করিবার পরামর্শ দিয়াছেন। অবান্তর পরামর্শ। আমলারা কর্তা নহেন। কেন্দ্রীয় সরকার গত দুই বৎসর যাবৎ নীতি-পক্ষাঘাতে আক্রান্ত। সেই সরকারের আমলাদের ঝড়ের গতিতে কাজ করিবার পরামর্শ দেওয়া অর্থহীন। প্রধানমন্ত্রীকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করিতে হইবে। নেতৃত্বের তাহাই যথার্থ পন্থা। তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাক, ২০০৮ সালে যখন ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি লইয়া বামপন্থীরা অচলাবস্থা সৃষ্টি করিয়াছিল, তখন যে প্রধানমন্ত্রী নিজের কর্তব্য অবিচলিত ছিলেন, তাঁহার নাম মনমোহন সিংহ। ১৯৯১ সালে যিনি ভারতে আর্থিক সংস্কারের বিপ্লব ঘটাইয়াছিলেন, তাঁহার নামও মনমোহন সিংহ। আর এক ক্রান্তিকাল তাঁহার চারিত্রিক দৃঢ়তার পরীক্ষা লইতেছে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াই কর্তব্য।
সংস্কারের জন্য ভারত দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করিয়া আছে। কিছু কাল পূর্বেও প্রধানমন্ত্রী মাঝেমধ্যে দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলিতেন। এখন আর বলেন না, সম্ভবত তাহার অসম্ভাব্যতা স্বীকার করিয়া লইয়াই। নেতারা যাহাই ভাবুন, তাঁহাদের নিকট জোট রাজনীতির স্বার্থ যতই গুরুত্বপূর্ণ হউক সংস্কারের জন্য পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করিলে বিপদ। সংস্কারের পথে আজই, এখনই হাঁটা প্রয়োজন। পথটি নিঃসন্দেহে বন্ধুর। শরিকরা রাগ করিবেন, বিরোধী পক্ষ সুযোগের সন্ধানে থাকিবে। কিন্তু, থামিলে চলিবে না। প্রথম কাজ, ভর্তুকির উপর রাশ টানা। অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় জানাইয়াছিলেন, সরকার এই বার ভর্তুকির একটি ঊর্ধ্বসীমা মানিয়া চলিবে। কথাটি যে নেহাত কথার কথা নহে, তাহা প্রমাণ করিতে হইবে। পেট্রোপণ্যের ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমাইতেই হইবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষুব্ধ হইতে পারেন, কিন্তু সেই ক্ষোভের ভয়ে ভর্তুকির বোঝা বাড়িতে দেওয়া চলে না। ভারতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বৃদ্ধির হার ক্রমেই শ্লথ হইতেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা সত্ত্বেও, সুদের হার কমাইয়া সেই সমস্যার মোকাবিলা করিতে চাহিয়াছে। কিন্তু, সরকার যদি রাজকোষ ঘাটতির লাগাম না টানে, তবে সেই চেষ্টায় বিষম ফল হইবে। এক দিকে শ্লথ অর্থনীতি, অন্য দিকে মূল্যস্ফীতি এমন পরিস্থিতি ইউ পি এ-র নির্বাচনী রাজনীতির পক্ষেও ইতিবাচক হইবে কি? নিষ্ক্রিয়তার সরকারি নীতি কোন বিপদ ডাকিয়া আনিতে পারে, তাহা এত দিনে স্পষ্ট। সেই নিষ্ক্রিয়তার দায় অর্থনীতিকে চুকাইতে হয় বৃদ্ধির গতিভঙ্গের অঙ্কে, বিশ্ব-অর্থনীতিতে গুরুত্ব-হ্রাসের অঙ্কে। |