রবিবাসরীয় গল্প
হাওয়া-বারান্দা
নিবার দুপুর থেকে বিষম সমস্যার সৃষ্টি হয় বরুণার। ছেলের বউয়ের প্রতি রাগে গা চিড়বিড় করতে থাকে। সপ্তাহের বাকি ক’টা দিন বরুণা বেশ সুখেই থাকেন। সংসারের কোনও ভারী কাজ তাঁকে করতে দেয় না রাখি। মেয়েটিকে তিনিই পছন্দ করে পুত্রবধূ করেছিলেন। ছেলে বিকাশের সঙ্গে রাখির ভালই মিলমিশ হয়েছে। দেখতে দেখতে তিন বছর নির্বিঘ্নে গড়িয়ে গেল তিন জনের এই ছোট্ট সংসার। শুধুমাত্র শনিবারের দুপুর গড়াতেই সব কিছু বেতালা ঠেকতে থাকে। ছেলে-বউমা কেমন যেন উপেক্ষা ছুড়ে দেয় বরুণাকে। ঘটনাটা অবশ্য বেশি দিন ঘটছে না, হয়তো এক বছর হতে চলল। প্রতি শনিবার রাখি দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর সাজতে বসে। বিকাশ ততক্ষণে অফিস থেকে ফিরে এসে খেয়েদেয়ে বিছানায় একটু গড়িয়ে নেয়। বাড়ির কাছেই অফিস। হাঁটা পথে মিনিট কুড়ি। বিকাশ মিউনিসিপ্যালিটির ক্লার্ক। শনিবার হাফ ছুটি। রাখির সাজগোজ শেষ হওয়ার মুখে বিকাশ উঠে পড়ে ফিটফাট হয়ে নেয়। ‘মা আসি’ বলে বেরিয়ে যায় দু’জনে। ‘কোথায় যাচ্ছিস’ জিজ্ঞেস করে বরুণা আজ পর্যন্ত একটাই উত্তর পেয়েছেন ছেলের থেকে, ‘যাই, একটু ঘুরে আসি। সারা সপ্তাহ তো কাজের চাপে কেটে যায়।’ বরুণা বোঝেন, এটা উত্তর নয়, উত্তর না দিতে চাওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত। কোথায় যায়, ওরা বলবে না। না বলার অধিকার ওদের আছে। কারণ, সত্যিই তো কর্তব্যে কোনও ত্রুটি রাখে না দু’জনে। মায়ের প্রতি যত্ন, আত্মীয় কুটুম্বিতা সব কিছু ওরাই সামলায়। বরুণাকে কিছুই ভাবতে হয় না। ছোট এই এক তলা বাড়িটা করতে গিয়ে কর্তার সমস্ত সঞ্চয় ফুরিয়েছে। মেয়ে রেবার বিয়ে দিতে প্রচুর দেনা করতে হয়েছিল। বিকাশ তার ওই ছোট চাকরিটা থেকে সে সব শোধ করে চলেছে। বউমা রাখি সাধারণ গ্র্যাজুয়েট। ওই শিক্ষাটুকু সম্বল করে সকাল বিকেল টিউশন পড়ায়। তার পর আছে রান্নাবান্না, সংসারের বিবিধ কাজ। কাজের লোক শুধু ঘর ঝাঁট আর মুছে দিয়ে যায়। এত পরিশ্রমের পর সপ্তাহের একটা দিন স্বামী-স্ত্রী ঘুরে-বেড়াতে, হাওয়া খেতে বেরোতেই পারে। বরুণার কোনও অসন্তোষ থাকার কথা নয়, নেইও। ওরা যদি নিজেদের বেড়ানোর জায়গাটা গোপন রাখতে চায়, রাখতেই পারে। বরুণার তাতেও কোনও আপত্তি নেই। গোলমালটা হচ্ছে ওদের বেরোনর ধরনটা নিয়ে। শনিবারের দুপুর থেকে ছেলে-বউমাকে যেন নিশিতে পায়। প্রায় ঘড়ি ধরে চারটে নাগাদ বেরিয়ে পড়ে দু’জনে। বেরোনর আগে যখন রেডি হয়, নিজেদের মধ্যে চাপা গলাতেও কথা বলে না। যা শুনে বরুণা আন্দাজ করতে পারতেন, কোথায় যাচ্ছে ওরা।
রাখির সাজের বহর এমন, যেন কত বড়লোক বাড়ির বউ। অথচ অন্য সময় মেয়েটার সাজ নিয়ে কোনও আগ্রহই দেখা যায় না। বিকাশও পিছিয়ে থাকে না, যে ছেলে হামেশাই চটি, আকাচা, কুঁচকোনো প্যান্টজামা পরে অফিস চলে যায়, শনিবার বিকেলে সেই বিকাশ বদলে যায় আমূল। জুতো, ইস্ত্রি করা জামাপ্যান্ট পরে ফিটফাট বাবু। কখনও আবার বাহারে পাঞ্জাবি। এত আয়োজন দেখেই মনটা খচখচ করে বরুণার, কোন রাজসভায় যায় ওরা? এ তো হাওয়া খেতে বেরোনর ড্রেস নয়। দু’জনে ফেরার পর বরুণা বেশ কয়েক বার গোপনে ওদের ব্যাগ, পকেটফকেট ঘেঁটে গন্তব্যের হদিশ পাননি। ভেবেছিলেন হাতে উঠে আসবে সিনেমার টিকিট, রেস্তোরাঁর বিল, নিদেনপক্ষে বাসের টিকিট পেলেও না হয় কিছু একটা আন্দাজ করা যেত। ওরা যেন পণ করেছে মাকে কিছু জানতে দেবে না। সমস্ত প্রমাণ ফেলে আসে বাইরে। ঠিক এইখান থেকেই রাগ হতে থাকে বরুণার। মনে মনে বললেন, আরে, তোরা আনন্দ ফূর্তি করতে গেলে কি আমার খারাপ লাগবে? এত গোপনীয়তার কী প্রয়োজন? তোরা কি আমায় এতটাই নীচ মনের ভাবিস? সন্তানস্নেহ যেহেতু বিষমবস্তু, বরুণার রাগ গিয়ে পড়ে পুত্রবধূর ওপর। মনে হয় ওর বুদ্ধিতেই বিকাশ তাঁকে চেপে যাচ্ছে শনিবারের এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত। অবজ্ঞা করছে মাকে। শনিবার রাখির সাজ শুরু হলেই তাই গা জ্বালা করতে থাকে বরুণার। আজও সেই শনিবার। দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। নিস্তব্ধ সাদামাটা এই বাড়ির বাতাসে মিশে যাচ্ছে রাখির দামি প্রসাধনীর গন্ধ। বরুণা শুয়ে আছেন নিজের ঘরের বিছানায়। গন্ধটা দরজায় এসে দাঁড়াল, মা, আমরা বেরোচ্ছি।
কনুইয়ের ভারে শরীরটা একটু তুললেন বরুণা, রাখি যেন আজ আরও বেশি সেজেছে। ‘কোথায় চললে’ কথাটা মাথায় নিয়ে মুখে বললেন, ‘সাবধানে যেয়ো’। রাখি সরে গেল দরজা থেকে। খানিক বিরতিতে সদর টেনে দেওয়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। ডবল লক। নতুন লাগিয়েছে বিকাশ। বরুণা ভেতর থেকে খুলতে পারবেন, বিছানা থেকে এখনই ওঠার দরকার নেই। ছোট্ট একটা ঘুম দেওয়া যেতেই পারে। বরুণা জানেন ঘুম আর আসবে না। বিছানা থেকে নেমে আসেন। এখন এ-ঘর ও-ঘর ঘুরঘুর করবেন আর মনে একটা কথাই ফিরে ফিরে আসবে, ওরা কি আমায় এ ভাবে ফেলে রেখে আলাদা হয়ে যাওয়ার মহড়া দিচ্ছে? নিজেকে কেমন যেন পরিত্যক্ত, বড় বেশি অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।

দুই
‘খরস্রোতা’ হাউজিং কমপ্লেক্সের বিশাল গেটের সামনে এসে দাঁড়াল ট্যাক্সি। নেমে এল বিকাশ, রাখি। শনিবার বিকেলে ট্যাক্সির শৌখিনতাটা ওদের প্রয়োজনের মধ্যেই পড়ে। এই হাউজিংটা নির্মীয়মাণ, খাঁচা উঠে গিয়েছে কোনও ব্লকের দশ তলা, কোনওটার চোদ্দো তলা। নীচের দিকে কিছু ফ্ল্যাট প্রায় সম্পূর্ণ। বুকিং চলছে।
ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে বিকাশরা প্রকাণ্ড গেটের কোনার দিকে ছোট গেটটার কাছে পৌঁছল। ইউনিফর্ম পরা সিকিয়োরিটির লোকটা কোথা থেকে ছুটে এসে সেলাম মতো জানায়। পোশাকের মাহাত্ম্য, পূর্বপরিচয়ের হাসিসহ বিকাশ তাকে জিজ্ঞেস করে, অফিসে লোক আছে?
আছে স্যর। বলে লোকটা ছোট গেটের পাল্লাটা ঠেলে দিল।
ঘাড় হেঁট করে গেট ডিঙিয়ে চওড়া লনে এসে দাঁড়াল বিকাশ, রাখি। শহরের মধ্যে সম্ভাব্য টুকরো একটা শহর। ফাঁকা জায়গাটায় এখন ধুলো, বালি, স্টোনচিপ, ইট। ‘খরস্রোতা’ হাউজিংয়ের হোর্ডিং-এ, কাগজের বিজ্ঞাপনে এই চত্বরটায় পার্ক, বুলেভার্ট, ওয়াটার বডি, পুল আঁকা। পরে এ সব হবে। ব্লক ওয়ানের নীচে প্রোমোটারের অস্থায়ী অফিসঘর, বিকাশ সে দিকে কয়েক পা এগিয়ে টের পায় পাশে বউ নেই। পিছন ফিরে দেখে, রাখি ঘাড় উঁচু করে অসম্পূর্ণ বহুতলগুলো দেখছে। বিকাশ গলা তুলে বলে, কী হল, এসো। কী দেখছ?
দৃষ্টি ওপরে রেখেই রাখি বলল, গত সপ্তাহে কোন ফ্ল্যাটটায় গিয়েছিলাম বলতে পারবে?
বিকাশ ফিরে আসে বউয়ের পাশে। সামনের পাঁচটা অ্যাপার্টমেন্টের একটার দিকে আঙুল তুলে বলে, ওই তো ব্লক থ্রি-র আট তলার মাঝের ফ্ল্যাটটা।
একদম রাইট। খুশির গলায় সমর্থন জানায় রাখি। তার পর বলে ওই ফ্ল্যাটটা থেকেই গঙ্গা সবচেয়ে ভাল দেখা যায়, তাই না?
কী করে বলি বলো। এখানে এত ক’টা ব্লক, শত শত ফ্ল্যাট, সব ক’টাতে তো আর যাইনি। যাওয়া... বলতে বলতে অফিস ঘর লক্ষ করে এগোয় বিকাশ, পাশে রাখি। নদীর পাশে হাউজিং বলে নাম ‘খরস্রোতা’। যদিও গঙ্গা এখানে একেবারেই শান্ত। নামে একটু বাড়াবাড়ি থাকেই। শুধু বাড়ি তো নয়, ক্রেতাদের উদ্দেশে খানিকটা স্বপ্নও বেচতে হয়।
অফিস ঘরে ঢুকে বিকাশ সোজা চলে গেল ম্যানেজারের টেবিলে। রাখি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, টেবিলের এ পারে মুখচেনা ছেলেটাকে দেখে ধড়াস করে উঠেছে বুক। এক গাল হাসি নিয়ে টুলে বসা ছেলেটা বলল, আগেরটা পছন্দ হল না বউদি?
গুম মেরে রইল রাখি, কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ঢোকার সময় বিকাশ খেয়াল করেনি ছেলেটাকে, প্রশ্নটা কানে গেছে, রাখির নীরবতায় মুখ ফেরায়। দ্রুত পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে ছেলেটাকে বলে, এখনও কোনও ডিসিশন নিইনি। আরও কয়েকটা দেখি।
হ্যাঁ, সে তো বটেই। বাড়ি পছন্দ করা মুখের কথা নাকি! একটু পজ নিয়ে ছেলেটি জানায়, আমি দাদা এখন এই প্রোজেক্টে চলে এসেছি। ওদের সঙ্গে ঠিক...
কথা বাড়াতে দেয় না বিকাশ। বলে, ভাল করেছ। তার পর ম্যানেজারকে মোলায়েম গলায় বলল, আজ আর এক বার ফ্ল্যাটটা দেখব। কয়েকটা অল্টারেশনের কথা মাথায় এসেছে।
ম্যানেজার ছেলেটা অবাক হয়। বলে, আমি তো ভাবলাম আপনারা ব্যাঙ্ক লোনের কাগজপত্র নিয়ে এসেছেন। আবার সেই আট তলা সিঁড়ি ভাঙবেন! কী দরকার! আমার টেবিলে প্ল্যান আছে, আপনাদের সাড়ে আটশো মাপের নীচের দিকে কিছু মডেল ফ্ল্যাটও আছে, ওগুলোর কোনও একটা দেখে নিয়ে কী ধরনের চেঞ্জ চান বলুন, কতটা কী করতে পারা যাবে বলে দিচ্ছি।
না, ঠিক এই ফ্ল্যাটটায় না দাঁড়িয়ে অল্টারেশনের ডিসিশন নিতে পারব না। আলো-বাতাস কোন পাশ দিয়ে আসছে, আর এক বার বুঝে নিতে হবে।
বিকাশকে সাহায্য করতে চেনা মুখের ছেলেটা বলে উঠল, দাদা বউদি খুব খুঁতখুঁতে আমি জানি।
ছেলেটার কমেন্ট কানে নিল না ম্যানেজার, দ্বিধা সংশয় সহ বলল, কনস্ট্রাকশন কমপ্লিট হয়নি। অত উঁচুতে উঠবেন! আগের দিনের মতো সঙ্গে যে কাউকে দেব, তারও উপায় নেই। বাবলুকে এখনই একটা কাজে পাঠাতে হবে।
শেষ কথাটা চেনা মুখের ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলা হল। বিকাশ গদগদ গলায় বলে, না, না, কাউকে সঙ্গে দেওয়ার দরকার নেই। আমরা তো আগের দিন সব দেখেই গিয়েছি। আজ জাস্ট একটু চোখ বুলিয়ে নেব। বেশিক্ষণ থাকবও না।
ম্যানেজার ব্যাজার মুখে পিছনের দিকে হাত বাড়িয়ে র্যাক থেকে দুটো হলুদ হেলমেট নামিয়ে আনল। বলল, এ দুটো কিন্তু পরবেন। ব্লক টু-তে ওপরের দিকে কাজ চলছে।
ঘাড় নেড়ে হেলমেট দুটো যে যার হাতে নিয়ে বিকাশ, রাখি নেমে এল লনে। বিকেলের রোদে গাঢ় হলুদ ছোপ। চার পাঁচ পা এগিয়ে রাখি বলল, আমাদের ব্যাপারটা বোধ হয় বুঝে গেল বাবলু। এ বারে প্রোমোটারের লোকটাকে বলবে।
বিকাশ কথাটা একেবারেই পাত্তা দিল না। তিন নম্বর ব্লক লক্ষ করে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ধুর, কিছুই বোঝেনি।
না গো, বাবলুকে আমি আগের কেন, তার আগের ফ্ল্যাট দেখতে গিয়েও দেখেছি।
ওটা তোমার গিল্টি ফিলিং থেকে মনে হচ্ছে। আগেরটাতেই দেখেছ।
মনে খচখচানি থাকলেও রাখি আর কিছু বলে না। দু’জনে পায়ে পায়ে আগের দিনের ব্লকটার কাছে এসে পড়ে। কাছাকাছি পুরোদমে কাজ চলছে। শোনা যাচ্ছে বসত নির্মাণের শব্দ, মিস্ত্রিদের গলার আওয়াজ। বিকাশ তিন নম্বর ব্লকে ঢুকতে গিয়েও থেমে যায়। রাখিকে বলে, পিছনটা এক বার টুক করে দেখে নাও তো, কেউ দেখছে কি না। আজ ভাবছি চার নম্বরটা দেখব। রিভার সাইড ওপেনিং ওটারই বেশি।
রাখি চটজলদি পিছনটা দেখে নিয়ে বলে, না, কেউ দেখছে না। তবে হেলমেটটা পরে নেওয়া ভাল। হেলমেট পরিনি দেখে কেউ হয়তো দৌড়ে আসতে পারে।
সিঁড়ি ভেঙে আট তলায় উঠে এল বিকাশ, রাখি। চাতালে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে ওরা। হেলমেট দুটো এখন রাখির হাতে। ফ্লোরে চারটে ফ্ল্যাটের স্ট্রাকচার। দেওয়াল অর্ধেক উঠে থেমে আছে। রাখি ডান দিকের ফ্ল্যাটটা বেছে নিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। মেঝেতে হেলমেট রেখে, চার দিক তাকিয়ে নৃত্যের ভঙ্গিমায় এক পাক ঘুরে নিল। বলে উঠল, কী দারুণ না! বিকাশের সাড়া না পেয়ে চোখ গেল দরজায়, সিমেন্টের ফ্রেমে বাঁ হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিকাশ। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে রাখি জিজ্ঞেস করে, কী হল, খুব হাঁপিয়ে গেছ? কষ্ট হচ্ছে?
দুষ্টুমির হাসি সমেত বিকাশ মুখে শব্দ করে, টিং টং, টিং টং...
হেসে ফেলল রাখি। ভ্রু নাচিয়ে বলল, ও, বুঝেছি। তার পর দৌড়ে গেল মিছিমিছি দরজা খুলতে।
ঘরে ঢুকে সোফায় অফিসব্যাগ ছুড়ে ফেলার ভঙ্গি করল বিকাশ। মিথ্যে মিথ্যে টাইয়ের নট আলগা করতে লাগল।
রাখি ঠোঁট চেপে হাঁসছে। যেখানে মিথ্যে ব্যাগ ছুড়ে ফেলা হয়েছে, সেই দিকে তাকিয়ে রাখি বলে, নন্দিতাদের ড্রয়িং-এ যে রকম সোফা আছে, ওখানে খুব মানাবে। কর্নারে প্যাঁচা আঁকা কাঠের র্যাক। শান্তিনিকেতনে যেমন দেখেছিলাম।
কথাগুলো নতুন নয়, অন্য ফ্ল্যাটবাড়ি দেখতে গিয়ে বিকাশ আগেও শুনেছে। ঝুলবারান্দায় গিয়ে বেশি এগোয় না বিকাশ, রেলিং বলতে প্যারাপেটের গার্ড। পিছিয়ে এসে ঘরের জানলার খোপে বসে পড়ে। বুক ভরে নদীর বাতাস নিয়ে বলে, এই ব্লকের ভিউ সবচেয়ে ভাল। সাউথ-ইস্ট কতটা ওপেনিং! পুরো বালিব্রিজটা দেখা যাচ্ছে, নিবেদিতা সেতু, দক্ষিণেশ্বর। এই কমপ্লেক্সটা তো আগেভাগে বুক হবেই। ...রাখি কিছু বলছে না দেখে ঘাড় ফেরায় বিকাশ, বউ এখন কিচেন স্পেসে। কী এত খুঁটিয়ে দেখছে, ওই জানে!
হাওয়া বাঁচিয়ে সিগারেট ধরাল বিকাশ। অনেকটা ধোঁয়া ছেড়ে নিয়ে গলা তোলে, কী হল, চা দাও।
রাখি বলল, দিচ্ছি রে বাবা, দিচ্ছি। হাতমুখও তো ধুলে না। অফিসে আজ ক’কাপ হয়েছে শুনি?
রাখির নিখুঁত অভিনয়ে হেসে ফেলে বিকাশ। রাখি বেরিয়ে এসেছে কিচেন স্পেস থেকে। হাঁটুর ওপর এক পা তুলে নাচাতে নাচাতে বিকাশ মৌজ করে সিগারেট খাচ্ছে। অভিনয় ভেঙে রাখি বলল, ওঃ, একেবারে নবাবি মেজাজ!
এ বার দু’জনেই হো হো করে হেসে ওঠে। হাসি আচমকা থেমেও যায়। সিঁড়ি দিয়ে কারা যেন উঠে আসছে, পায়ের আওয়াজ। রাখি দৌড়ে যায় দরজার বাইরে। সিঁড়ির কাছে এসে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখে, উঠে আসছে এক কাপল। ফিরে আসে ঘরে। বিকাশকে বলে, দু’জন আসছে। এই ফ্ল্যাটটাই বুক করেনি তো?
চলো, বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। বলে বিকাশ দরজার দিকে এগোয়। রাখির যেন ইচ্ছে করছে না ঘরটা ছেড়ে যেতে।
ছেলেমেয়ে দু’টি উঠে এসেছে ওপরে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রাখিদের দিকে। প্রমাগ গোনে রাখি, ঠিকই আন্দাজ করেছিল, এটা ওদেরই বুক করা ফ্ল্যাট।
রাখিকে নিশ্চিন্ত করে যুগল ওপরের সিঁড়ির দিকে এগোয়। বিকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে রাখি প্রায় ভাবলেশহীন ভাবে বলে, ওদের নয়, ওরা আরও ওপরের।
বিকাশ ফিরতে থাকে আগের জায়গায়। রাখি বলে, এই আট তলার পরেই তো সব লাক্সারি ফ্ল্যাট। আঠেরোশো, দু’হাজার স্কোয়ার ফুট। স্পেশাল অ্যামেনিটিস। ওদের অনেক টাকা, বলো?
বিকাশ কোনও উত্তর না দিয়ে জানলার খোপে বসে আর একটা সিগারেট ধরায়। এখানে পাখি আই লেভেলে ওড়ে। কখনও বা উড়ন্ত পাখির পিঠ দেখা যায়।
ওপরের ফ্ল্যাটগুলোয় এক বার যাবে?
রাখি পিঠের কাছে এসে বলল কথাটা। বিকাশ মুখ না ঘুরিয়ে একটু সময় নিয়ে বলে, কী হবে গিয়ে?
এখানে এসেই বা কী হচ্ছে? আমাদের কাছে আঠেরোও যা আঠেরোশোও তাই।
বিকাশ চুপ করে থাকে। আকাশের মেঘে, নদীর জলে এখন অস্তরাগ। একটা ভুটভুটি নৌকো ঘাট পার হচ্ছে। ফের রাখি বলে ওঠে, চলো না যাই। আরও ওপর থেকে লাক্সারি ফ্ল্যাটে দাঁড়িয়ে কেমন লাগে দেখি জায়গাটা।
কিছুটা অনিচ্ছা আর আলস্য নিয়ে জানলার খোপ থেকে নেমে আসে বিকাশ।
ন’তলায় এসে কোনও ফ্ল্যাটে ঢুকল না রাখি। বলল, চলো, দশ তলাতে যাই। নামতে কষ্ট হবে না।
দশ তলায় উঠে আসে বিকাশ, রাখি। মুখোমুখি ফ্ল্যাটটায় ঢুকতে গিয়ে আঁতকে ওঠে দু’জনে। তবে নিঃশব্দে। রাখির মুখ চেপে ধরেছে বিকাশ। সামনে যে দৃশ্য দেখছে, কোনও ধরনের আওয়াজ উঠলেই মারাত্মক ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যারা সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছিল ওপরে, এখন তারাই নিজেদের হাত বাঁধছে রুমালে। ছেলেটার ডান, মেয়েটার বাঁ হাত। ওরা এখন ঝুলবারান্দায়। কব্জির বাঁধন আরও জোরালো করতে মেয়েটা দাঁত আর এক হাত দিয়ে আঁটছে গিঁট। ছেলেটা তাকিয়ে আছে শূন্যে।
বিকাশ বিড়াল পায়ে এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার ঘাড়, ছেলেটার কলার চেপে ধরে। এক হ্যাঁচকায় ওদের টেনে ছুড়ে ফেলে ঘরের মেঝেতে। বিকাশের যে এত গায়ের জোর, জানা ছিল না রাখির, পুরো তাজ্জব বনে গেছে! দ্রুত বিহ্বলতা কাটিয়ে রাখি ছুটে গিয়ে আগে ওদের বাঁধন খুলতে থাকে। খুলেই রুমালটা এমন ভাবে ঢুকিয়ে ফেলে ব্যাগে, যেন আত্মহননকারীর মুখ থেকে ফিরিয়ে নিল বিষ।

তিন
পরের শনিবার উল্টো অস্বস্তি শুরু হয়েছে বরুণার। দুপুরের খাওয়ার পাট শেষ হয়ে এখন প্রায় বিকেল। ছেলে-বউমার বেরোনর কোনও উদ্যোগ দেখছেন না। রাখি কিছুক্ষণ হল রান্নাঘরে ঢুকেছে, চায়ের জল বসাল হয়তো। ওরা কি আজ বেরোবে না? এক বছরের মধ্যে এ রকম তো কখনও হয়নি। কারণটা ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে বরুণার। একই সঙ্গে অভিমান হচ্ছে এই ভেবে, কোথায় যায় যখন বলে না, কেন যাচ্ছে না, জিজ্ঞেস করে নিজে ছোট হওয়ার দরকার কী? গত শনিবার ওরা ফেরার পর আবারও এক ফাঁকে ছেলের পকেট, বউমার ব্যাগে সার্চ করেছেন বরুণা। কোনও সূত্র পাওয়া যায়নি। রাখির ব্যাগ থেকে পাওয়া গেল অচেনা একটা রুমাল। কেনা নয়, ব্যবহার করা। সেই প্রশ্নের নিস্পত্তি হল না, আবার এক প্রশ্ন, কেন বেরোচ্ছে না আজ?
বিছানা থেকে উঠেই পড়লেন বরুণা। রুমালটা রেখেছিলেন তোষকের নীচে, হাতে নিয়ে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন। রাখির পিঠের দিকটা দেখা যাচ্ছে। গ্যাস উনুনে চা-ই বসিয়েছে। বরুণা বললেন, এখন চা! তোমরা আজ বেরোবে না?
মুখ না ফিরিয়ে রাখি বলল, না, মা।
কেন? শরীর খারাপ? বিকাশ তো ভালই আছে, ঘুমোচ্ছে।
না, ঠিকই আছি। চা খাবেন তো? বসিয়েছি।
আসল উত্তরটা জানা যাচ্ছে না। ধৈর্য হারিয়ে বরুণা হাতের রুমালটা তুলে বললেন, এটা কার বলো তো বউমা? আমাদের তো নয়। কোথা থেকে এল? বসার ঘরে পেলাম।
ঘাড় ফিরিয়ে রুমালটা দেখে রাখি। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, ওটা স্বপ্নে পেয়েছি।
বরুণা জানেন স্বপ্নে কোনও বস্তু পাওয়া যায় না। স্বপ্নাদেশে পাওয়া যায়। রাখি হয়তো সেটাই বলতে চাইল। যদিও স্বপ্নাদেশে রুমাল পাওয়া জীবনে প্রথম শুনলেন বরুণা। ব্যাপারটা আরও বিশদে জানতে ইচ্ছে করছে। ঠিক কী জিজ্ঞাসা করবেন, ভেবে উঠতে পারছেন না।
রাখি বুঝতে পারছে, শাশুড়িকে বেশ ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে সে। রুমালটা যে উনি ব্যাগ থেকে বার করেছেন, সেটাও বুঝেছে। সেই রাগেই কথাটা আলটপকা মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। এমনিতেই তার মন ভাল নেই। আজ কোনও ফ্ল্যাট দেখতে যাওয়া হবে না। কোনও দিনই যাবে না, ঠিক করেছে স্বামী-স্ত্রী মিলে। গত শনিবার যাদের বাঁচিয়েছে, তাদের স্বপ্নের ঘর অনেক উঁচুতে বাঁধা ছিল। হঠাৎ বিপর্যয়ে দু’জনের স্বপ্ন তছনছ হয়ে যায়। হতাশা এমনই গ্রাস করেছিল, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে স্বপ্নের বারান্দা থেকেই ঝাঁপ মারবে।
প্রোমোটারের অফিসে কিছু জানায়নি রাখিরা। জানালে ওই দু’জন পুলিশি ঝামেলায় পড়ত। যুগলকে ওদের আত্মীয়দের হাতে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরেছিল বিকাশ, রাখি। আসার পথেই ঠিক করে নেয়, ফ্ল্যাট দেখতে যাওয়া এ বার থেকে বন্ধ। আর ওই বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনও কথা হয় না।
স্বপ্নাদেশের রুমাল পেলে কী হয় বউমা? জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলেন না বরুণা।
রাখি নিরুত্তর থাকে। শাশুড়িকে খামোকা কনফিউজ করে কী লাভ! মনে মনে বলে, ওই রুমালে স্বপ্নের কান্না মুছতে হয়।
খানিক অপেক্ষার পর বরুণা যখন বুঝলেন উত্তর পাওয়া যাবে না, ফিরতে থাকলেন নিজের ঘরের দিকে। রুমালটা সাবধানে গুছিয়ে রেখে দিতে হবে। যতই হোক স্বপ্নাদেশে পাওয়া বলে কথা। হারিয়ে না যায়।

ছবি: সুমন চৌধুরী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.