|
|
|
|
|
|
|
মগজ-মেশিন-মানুষ |
অ্যালান ম্যাথিসন ট্যুরিং মানুষের মাথা কেমন করে যন্ত্রের মতো কাজ করে সে আলোচনার পথিকৃৎ।
কিন্তু এই ‘ইয়ার অব ইন্টেলিজেন্স’কে ঘিরে আলোড়িত বিশ্বে কোথায় তাঁর স্মৃতি? লিখছেন পথিক গুহ
|
সুইৎজারল্যান্ড সরগরম। নাহ্, প্রেসিডেন্ট প্রাইম মিনিস্টারের গোপন প্রেম নিয়ে নয়। নেহাতই এক গবেষণা ঘিরে। বিরোধীরা সমালোচনায় মুখর। এবং লুসান শহরে সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানী হেনরি মারক্র্যাম আপাতত একঘরে। অপরাধ? তাঁর গবেষণা প্রকল্পের জন্য বি-শা-ল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ। কত? ১ বিলিয়ন ইউরো। মানে, আমাদের মুদ্রার হিসেবে ৬,৭০০ কোটি টাকা। এক জন বিজ্ঞানীর একটা গবেষণার পিছনে এত ব্যয়! অন্যদের ল্যাবরেটারি শুকিয়ে মরবে যে। ক্ষুব্ধ সতীর্থরা তাই নেতা আমলাদের দ্বারস্থ।
শুধু মোটা বরাদ্দের জন্যই নয়, মারক্র্যাম বিতর্কের কেন্দ্রে আরও এক কারণে। হয়তো বা, আরও বড় কারণে। কী? তাঁর গবেষণার বিষয়। যার পোশাকি নাম ‘হিউম্যান ব্রেন প্রজেক্ট’। আসলে, মানুষের মস্তিষ্কের যাবতীয় কাজকর্ম এক সুপার কম্পিউটারে নকল করতে চান মারক্র্যাম। বিজ্ঞানীরা জানেন, মানুষের মাথার নেহাতই তিন পাউন্ড ওজনের ওই অঙ্গটি এই বিশ্বসংসারে সবচেয়ে জটিল যন্ত্র। তার মধ্যে শত শত রাসায়নিক বিক্রিয়া, বিদ্যুতের খেলা, সুইচ অন-অফ, কোটি কোটি সংকেতের আদানপ্রদান। যার সবটা মিলে এক জন মানুষ। তার হাসিকান্না, আনন্দ-বেদনা। এত কিছু স্রেফ সিলিকন চিপ-এ? তাদের মধ্যে খোদাই সারকিট-এ? এও কি সম্ভব? নাকি গবেষণার নামে দিবাস্বপ্নের পিছনে দৌড়? নাহ্, গবেষণার বাস্তব মাটিতে ঠাঁই পাওয়া উচিত নয় এমন অলীক প্রয়াসের। অর্থ বরাদ্দের দাবি যেমন আপত্তিকর, আইডিয়াও তেমনই বিরক্তিকর। বিতর্ক, অতএব, ঘোরতর।
কী আশ্চর্য সমাপতন! মস্তিষ্ক-বনাম-মেশিন ঘিরে এমন কাজিয়া কিনা এ বছরে? এই ২০১২ খ্রিস্টাব্দ যে বিশেষ এক জন বিজ্ঞানীর জন্মশতবর্ষ। সেই বিজ্ঞানী, যিনি নিজের গবেষণায় নতুন পথে চালনা করেছেন মানবিক, যান্ত্রিক, এমনকী সামরিক বুদ্ধি পর্যন্ত। যাঁর এ হেন কৃতিত্বকে কুর্নিশ জানিয়ে বিজ্ঞানের জার্নাল ‘নেচার’ দাবি করেছে, এ বছরটাকে ঘোষণা করা হোক ‘দি ইয়ার অব ইনটেলিজেন্স’। আলবার্ট আইনস্টাইন-এর চারটি জগদ্বিখ্যাত গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের শতবর্ষপূর্তি স্মরণে ২০০৫ সালকে যেমন ঘোষণা করা হয়েছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অব ফিজিক্স’।
কে সেই বিজ্ঞানী যাঁর জন্য দাবি উঠেছে এ বছরের বিশেষ নামকরণের? আল্যান ম্যাথিসন ট্যুরিং। চিন্তা এবং বুদ্ধি জিনিসগুলো আসলে কী, তা বুঝতে জীবনভর ব্যস্ত ছিলেন তিনি। ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার স্বপ্ন একটা মস্তিষ্ক বানানো।’ ক্যান মেশিনস থিংক? এই প্রশ্ন তুলে শোরগোল ফেলেছিলেন ১৯৫০ সালে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধিমান যন্ত্র নিয়ে আজ যে এত মাতামাতি বিশ্বজুড়ে, তার গুরু তো তিনিই। বলেছিলেন, ‘এমন দিন আসবে, যখন মহিলারা তাদের ছোট্ট কম্পিউটার সোনাকে নিয়ে বিকেলে বসবে পার্কের বেঞ্চে। আর এ ওকে বলবে, শুনুন দিদি, আমার এই বিচ্ছুটা আজ সকালে কী মজার কথা বলেছে।’ নাহ, তেমন দিন হয়তো এখনও আসেনি। না আসুক, তাতে কী, আজ যে আপনি কি-বোর্ডে আঙুল বুলিয়ে ল্যাপটপে হাজারো কাজ করছেন, কোটি কোটি ডলারের সুপার কম্পিউটার থেকে হাজার টাকার মোবাইল ফোন যে কোনও না কোনও ভাবে আপনার খিদমতগিরি করছে, তার জন্য ধন্যবাদ অবশ্যই পাবেন ট্যুরিং।
আরও এক বড় কারণে ট্যুরিং বিশ্ববাসীর নমস্য। অ্যাটম বোমা নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘোরাতে বড় ভূমিকা তাঁর। আটলান্টিকে হিটলার বাহিনী তখন চালাচ্ছে লঙ্কাকাণ্ড। জার্মান সাবমেরিন ধ্বংস করছে একের পর এক মিত্রশক্তির যুদ্ধজাহাজ। নাজেহাল পরিস্থিতিতে সে দিন পরিত্রাতা হয়েছিলেন ট্যুরিং। আবিষ্কার করেছিলেন হেড কোয়ার্টার্স থেকে সাবমেরিনগুলিকে পাঠানো জটিল সাংকেতিক বার্তা বুঝে ফেলার কৌশল। এ সাফল্য বিরাট। আক্রান্ত হওয়ার আগেই ব্রিটিশ নৌবাহিনী আক্রমণ করছিল জার্মান সাবমেরিন। ঐতিহাসিকদের হিসেব, ওই সাফল্য বিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলত আরও দু’বছর।
বিবিধ ক্ষেত্রে এত অবদান যে বিজ্ঞানীর, জন্মশতবর্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে তৈরি হচ্ছে পৃথিবী। দেশে-দেশে ঘোষিত হয়েছে নানা অনুষ্ঠান সূচি। আয়োজনে পিছিয়ে নেই ভারত। গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শুধু নয়, ট্যুরিং শতবর্ষ পালিত হবে কয়েকটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাতেও। এমনটি তো হওয়ারই কথা।
হ্যাঁ, মায়ের গর্ভে ভ্রুণাবস্থা যদি জন্মলাভ হয়, তা হলে ট্যুরিং জন্মেছিলেন ভারতে। বাবা জুলিয়াস ট্যুরিং ছিলেন আই সি এস অফিসার। মা ইথেল সারা স্টোনি মরাঠা রেলওয়ের এক ইঞ্জিনিয়ারের মেয়ে। ছুটি কাটাতে ইংল্যান্ড যাওয়ার পথে জাহাজে ওদের দেখা। প্রেম এবং বছর না ঘুরতে বিয়ে। প্রথম সন্তান জন। স্ত্রী দ্বিতীয় বার অন্তঃসত্ত্বা হলে প্রথম বারের মতো জুলিয়াস আবার তাঁকে মাদ্রাজ থেকে পাঠিয়ে দিলেন ইংল্যান্ডে। প্যাডিংটন-এর নার্সিং হোমে ১৯১২ সালের ২৩ জুন ইথেল প্রসব করলেন দ্বিতীয় সন্তান। অ্যালান।
চাকরিসূত্রে জুলিয়াস থাকেন ভারতে। জন এবং অ্যালানের পড়ার ব্যবস্থা ব্রিটিশ পাবলিক স্কুলে। বাবা-মার আদর থেকে দূরে ছাত্রাবাসের কঠোর শৃঙ্খলার জীবন জন মেনে নিলেও, অ্যালানের তা মোটেই পছন্দ নয়। এবং বিরক্তি প্রকাশে সে অকুতোভয়। এক বার দুই ছেলের সঙ্গে দেখা করতে জুলিয়াস-ইথেল ইংল্যান্ডে। ফেরার সময় ছোট ছেলের চোখ ছলছল। তার গালে হাত রেখে ইথেলের মন্তব্য, ‘ভাল ছেলে হয়ে থাকবে, তাই তো?’ অ্যালানের স্পষ্ট জবাব, ‘হ্যা।ঁ তবে মাঝে মাঝে [এই উপদেশ] ভুলে যাব।’ |
|
১৯২০-র দশকে ব্রিটিশ পাবলিক স্কুলে গণিত বা রসায়ন-পদার্থবিদ্যার চেয়ে সাহিত্য-ইতিহাসের কদর বেশি। অ্যালান আবার ও সব বিষয়ে অমনোযোগী। তাই মোটেই শিক্ষকদের প্রিয়পাত্র নয়। তার ভাল লাগে কেমিস্ট্রির এক্সপেরিমেন্ট। আর মন পড়ে থাকে গণিতে। মাত্রাতিরিক্ত গণিতভক্ত বলে সতীর্থ বা শিক্ষকদের টিটকিরিও শুনতে হয় মাঝে মাঝে। বিরক্ত হেডমাস্টার অ্যালানের মাকে লেখেন, ‘পাবলিক স্কুলে পড়তে হলে ওকে অবশ্যই শিক্ষিত হতে হবে। ওর উদ্দেশ্য যদি হয় বিজ্ঞানবিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে ওঠা, তা হলে ও মিছেই সময় নষ্ট করছে এখানে।’ মা চিন্তায় পড়লেও, অ্যালান অবশ্য এমন মন্তব্যে উদাসীন। এই ছাত্রের কাছে গণিত সবচেয়ে মজার, কারণ তার নির্যাস হল যুক্তি। স্কুলের আই ডি কার্ডে স্বাক্ষর নেই। তা দেখে শিক্ষকের ধমক। অ্যালানের যুক্তি, ‘বাহ্ রে, কার্ডে যে স্পষ্ট নির্দেশ: ডোন্ট রাইট এনিথিং অন ইট।’
স্কুলে অ্যালানের একমাত্র বন্ধু সহপাঠী ক্রিস্টোফার মরকম। অ্যালানের মতোই যার প্রিয় বিষয় গণিত। এবং পদার্থবিদ্যা। দু’বিষয়ে ওর গভীর আগ্রহ দেখে অ্যালান মুগ্ধ। ওর কাছে কত কী শেখা যায়! প্রাণের এই বন্ধুটি হঠাৎ মারা গেল যক্ষ্মায়। অ্যালান শোকে পাথর। ক্রিস্টোফারের মাকে লেখা চিঠিতে তার মন্তব্য: ‘অন্য কারও সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা ভাবতে পারিনি। ওর পাশে আর সবাইকে নিতান্ত সাধারণ মনে হত। ...আমি জানি, অন্য কোথাও ওর সঙ্গে আবার দেখা হবে। আমরা আবার একসঙ্গে কাজ করব। যেমন করার কথা ছিল এখানে।’ ভদ্রমহিলার সঙ্গে অ্যালানের যোগাযোগ অক্ষত রইল বহুকাল। মৃত বন্ধুকে ঘিরে আলোচনা হল বহু বিষয়। এমনকী আত্মার অস্তিত্বও।
১৯৩৯ সাল। বিরক্তির স্কুলজীবন শেষ করে ট্যুরিং চলে এলেন কেমব্রিজের বিখ্যাত কিংস কলেজে। ১৯৩৪ সালে ওখান থেকে গণিতে ফার্স্ট ক্লাস অনার্স। আর তার তিন বছর পর ‘প্রসিডিংস অব দ্য লন্ডন ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি’ জার্নালে সেই বিখ্যাত পেপার। যার ফলে দিন বদলের সূচনা।
কী সেই পেপার? সোজা কথায়, ট্যুরিং উত্তর দিলেন সে সময় বিশ্ববিখ্যাত জার্মান গণিতজ্ঞ ডেভিড হিলবার্ট-উত্থাপিত এক মহাপ্রশ্নের। কঠিন অঙ্ক কষার চেয়ে গণিতের ভিত নিয়ে চিন্তিত ছিলেন হিলবার্ট। সেই সূত্রে ১৯২৮ সালে পণ্ডিতদের উদ্দেশে ছুড়ে দিয়েছিলেন একটা প্রশ্ন। গণিতে দাবির ছড়াছড়ি। ২+২=৪ ঠিক এটা যেমন একটা দাবি, তেমনই ২+২=৫ ভুল এটাও একটা দাবি। শুনতে যতই সহজ মনে হোক, এ সব দাবি প্রমাণ করতে হয় যুক্তির প্যাঁচপয়জার দিয়ে। বহু কসরৎ করে। ট্যুরিং জানতে চেয়েছিলেন, এমন কোনও নিয়মনীতি বা কৌশল কি আছে, যা অনুসরণ করে এগিয়ে গেলে স্পষ্ট ধরা পড়বে, কোনও দাবি ঠিক না ভুল? তাঁর বিখ্যাত পেপারে ট্যুরিং প্রমাণ করলেন, তেমন কোনও কৌশল থাকতে পারে না। গণিতের ভিত চুরমার করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট এই আবিষ্কারটি।
নাহ্, শুধু ওটুকু বললে ওই আবিষ্কারের ঠিক মূল্যায়ন হয় না। শুধু গণিতের ভিত ভেঙে ক্ষান্ত হলে ট্যুরিং বিখ্যাত হতেন কেবল পণ্ডিত মহলে। সীমাবদ্ধ থাকতেন কেতাবে, সেমিনারে। সারা পৃথিবীর কিছু থাকত না তাঁকে নিয়ে মাতামাতির। জার্নালে ৩৬ পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপা পেপারে ট্যুরিং যা বললেন, তা মূল্যবান হলেও, তার চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, তিনি কী ভাবে তা বললেন। নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে ট্যুরিং টেনে আনলেন মানুষের গণনা কৌশলের মূল নির্যাস। সংখ্যা তো আসলে কতকগুলো কালির দাগ বা চিহ্ন। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করতে বসে আমাদের মস্তিষ্ক ওই চিহ্নগুলিকেই নাড়াচাড়া করে। কী ভাবে করে? প্রত্যেকটা পদক্ষেপকে ভেঙে ভেঙে, তা দেখিয়ে দিলেন ট্যুরিং। এ বার মানুষের বদলে এক মেশিন কল্পনা করলেন তিনি। এবং দেখিয়ে দিলেন ওই মেশিন হুবহু নকল করতে পারে মানুষের গণনা কৌশল। শুধু তা-ই নয়, যে মেশিন কষতে পারে অঙ্ক, সে আবার খেলতে পারে দাবা। এক যন্ত্রে অনেক কাজ। ১৯৩৭ সালে ট্যুরিং-এর মনগড়া মেশিনই আজকের কম্পিউটারের ব্লু-প্রিন্ট।
কল্পনার ব্লু-প্রিন্ট থেকে বাস্তবের যন্ত্র তৈরি হতে সময় লাগল না। কারণ, ঘাড়ের ওপর যে এসে পড়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ইংল্যান্ডে তৈরি হল ‘কলোসাস’। যা পড়তে পারে জার্মান গুপ্তচরদের সাংকেতিক ভাষা। আমেরিকা বানালো ‘এনিয়াক’। যা আগাম হিসেব কষে শূন্যে গোলাগুলির পথ। কাজে যতই লাগুক, ও সব মেশিন বড্ড সেকেলে। সেকেলে যন্ত্রকে যিনি আধুনিক রূপ দিলেন, তিনি হাঙ্গেরির গণিতজ্ঞ জন ফন নয়ম্যান। হিটলারের ভয়ে দেশ থেকে পালিয়ে আগেই যিনি আশ্রয় নিয়েছেন আমেরিকায়। বিশ্বযুদ্ধ শেষ। শুরু হয়েছে রুশ-মার্কিন ঠান্ডা লড়াই। আমেরিকা বানাতে চায় মহাশক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা। সে জন্য কষতে হবে জটিল অঙ্ক। চাই গবেষণা। সেনাবাহিনী থেকে ফন নয়ম্যান পেলেন মোটা আর্থিক অনুদান। বন্ধু গবেষককে তিনি বললেন, ‘আই অ্যাম থিংকিং অ্যাবাউট সামথিং মাচ মোর ইমপর্ট্যান্ট দ্যান বম্বস, আই অ্যাম থিংকিং অ্যাবাউট কম্পিউটারস।’ অঙ্ক কষার জন্য মঞ্জুর করা অনুদানে তৈরি হল উন্নত যন্ত্র। সেনাবাহিনী পেল বোমা। ফন নয়ম্যান পেলেন আধুনিক কম্পিউটার। কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
কম্পিউটার নামের যে যন্ত্রটা অ্যাটলাসের মতো ঘাড়ে নিয়ে বসে আছে একবিংশ শতাব্দীর উন্নত পৃথিবী, তার ইতিহাস এত পুরনো, তার পিছনে অবদান এত জনের, যে বিশেষ কোনও এক জনকে তার জনক আখ্যা দেওয়া মুর্খামি। তবু, মুখের মিছিলে ট্যুরিং কোথায়? প্রশ্নটার উত্তর দিয়েছেন প্রযুক্তির ঐতিহাসিক জর্জ ডাইসন। বলেছেন, ‘ডিজিটাল কম্পিউটারের ইতিহাসকে ভাগ করা যায় দুই পর্বে। ওল্ড টেস্টামেন্ট আর নিউ টেস্টামেন্ট। ১৬৭০-এর দশকে গটফ্রিড উইলহেলম লিবনিৎজ-এর নেতৃত্বে ওল্ড টেস্টামেন্টের দেবদূতেরা উপহার দিয়েছিলেন যুক্তি। আর ১৯৪০-এর দশকে জন ফন নয়ম্যানের নেতৃত্বে নিউ টেস্টামেন্টের দেবদূতেরা বানিয়েছিলেন মেশিন। দুই যুগের পয়গম্বরদের মাঝে যিনি বিরাট ভূমিকায় দাঁড়িয়ে, তিনি হলেন অ্যালান ট্যুরিং।’
এত বড় সেতুবন্ধে যিনি স্থপতি, তাঁর অবদান কেন প্রায় অজানা? দোষী অনেকটাই ট্যুরিং নিজে। ‘পাবলিশ-অর-পেরিশ’ যুগ তখনও আসেনি। গবেষকরা পড়িমরি করে জার্নালে পেপার ছাপতে দৌড়ন না। আর নিজের কৃতিত্বের ঢাক পেটানো থেকে দূরে থাকতে চান ট্যুরিং। ফলে যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে। গবেষণার জগতে বহু উল্লেখিত তাঁর দু’টি পেপার ১৯৩৭ (কম্পিউটিং) এবং ১৯৫০ (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) সালে প্রকাশিত। কিন্তু, তার মাঝখানে? দীর্ঘ ফাঁক। ১৯৬৪, ’৪৭ এবং ’৪৮ সালে কম্পিউটার বানানোর দীর্ঘ পরিকল্পনাগুলি রয়েছে অপ্রকাশিত নোট হিসেবে। ১৯৩৬ সালের কল্পিত মেশিনকে ১৯৪৫ সালের বাস্তব কম্পিউটারে রূপান্তরের কৌশল তিনি বুঝেছিলেন এমন দাবি করে কোনও জার্নালে পেপার লেখেননি ট্যুরিং। ঔদাসীন্যের সাজা তো মিলবেই।
হায়, জনারণ্যে ট্যুরিং অখ্যাত থাকার মূলে কারণ যে আছে আরও। এবং তা যে ব্যক্তিগত ঔদাসীন্যের চেয়েও বড়। জীবনে ট্যুরিং যে পেয়েছিলেন এক ভয়ঙ্কর শাস্তি। সমাজের কশাঘাত। যার ফলে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন ব্রাত্য। আইনের চোখে, এমনকী, ঘৃণ্যও। সে কাহিনি এক বিষাদসিন্ধু। তার ট্র্যাজিক হিরো অন্য এক ট্যুরিং। এ বার তাঁর গল্প বলা যাক। |
|
অকালমৃত্যুর পরেও যাঁর আত্মাকে জাগিয়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন ট্যুরিং, সেই ক্রিস্টোফার মরকম-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল কী রকম? জীবনীকার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতজ্ঞ অ্যান্ড্রু হজেস মনে করেন, ওটা ট্যুরিং-এর জীবনে ‘প্রথম প্রেম’। হ্যাঁ, সমকামী ছিলেন তিনি। একের পর এক পুরুষ সঙ্গী এসেছিল তাঁর জীবনে। ১৯৪০ বা ’৫০-এর দশকের ব্রিটেনে যা ঘৃণ্য। এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। শাস্তি সত্যিই শেষমেশ পেলেন ট্যুরিং।
১৯৫২ সালের ২৩ জানুয়ারি। ছিঁচকে চুরি হল ট্যুরিংয়ের অ্যাপার্টমেন্টে। খোয়া গেল সামান্য কিছু জিনিস। একটা শার্ট, প্যান্ট, কয়েক জোড়া জুতো, শেভিং সেট, একটা কম্পাস। সব মিলিয়ে দাম ৫০ পাউন্ড হবে। থানায় ডায়েরি করলেন ট্যুরিং। শুরু হল পুলিশি তদন্ত। আর ফল হল উল্টো। অভিযোগ অনুযায়ী, চোর এমন এক যুবক, যার বন্ধুর নাম আরনোল্ড মারে। পুলিশ জানতে পারল, এই আরনোল্ড ট্যুরিং-এর যৌনসঙ্গী। তদন্তকারী গোয়েন্দারা ভেবেছিলেন, তথ্য ফাঁসে ট্যুরিং মরে যাবেন লজ্জায়। তারা বিস্মিত। ট্যুরিং কণামাত্র লজ্জিত নন। মনে করেন না, তাঁর আচরণ গণ্য হতে পারে অপরাধ। গোয়েন্দাদের বরং বললেন, সমকামিতা আইনসিদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে। বার বার সাক্ষাতে ওরা যেন তাঁর বন্ধু। দু’এক বার ওদের বাজিয়ে শোনালেন বেহালা।
এমন অপরাধী ওরা আগে দেখেনি। গ্রেফতার হলেন ট্যুরিং।
তিন সপ্তাহ পরে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচার। কাগজে রেডিয়োয় খবর। ছুটে এলেন দাদা জন ট্যুরিং। তিনি শোকাহত। মর্মাহত ট্যুরিংয়ের কিছু সহকর্মীও। তারা জানতেন না ওঁর ব্যক্তিগত জীবন। সবার এক পরামর্শ। নিজেকে অপরাধী ঘোষণা করুন ট্যুরিং। প্রার্থনা করুন ক্ষমা। এ বারে ট্যুরিং মর্মাহত। কে বলল তিনি অপরাধী? অনুতপ্ত? এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখলেন, ‘এমন এক সমস্যায় পড়েছি, যার সম্ভাবনা আমি চিরকাল ভেবেছি। যদিও মনে হত, তা সত্যি হওয়ার সুযোগ দশের মধ্যে এক। এক যুবকের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের অভিযোগ আমি আদালতে স্বীকার করতে চলেছি। কী ভাবে এটা জানাজানি হল, তা এক দীর্ঘ ও আকর্ষণীয় কাহিনি। যা নিয়ে এক দিন একটা ছোটগল্প লিখব, এখন তোমাকে বলার সময় নেই। এ সব থেকে নিঃসন্দেহে আমি বেরিয়ে আসব ভিন্ন এক মানুষ হিসেবে। কেমন মানুষ, তা অবশ্য বলতে পারছি না।’
ম্যাজিস্ট্রেট ঘোষণা করলেন রায়। শাস্তি হতে পারত জেল। তার বদলে তিনি দিলেন দাওয়াই। সমকামিতার ব্যাধি(!) সারাতে ট্যুরিংকে নিয়মিত নিতে হবে হরমোন ইনজেকশন। শুরু হল মর্মান্তিক প্রক্রিয়া। এবং প্রতিক্রিয়া। সুঠামদেহী মানুষটা এ বার রীতিমত রোগা। দেহে নারীসুলভ অঙ্গের উঁকি। এ ছাড়াও মানসিক নির্যাতন। তাঁর পিছনে সর্বক্ষণ সাদা পোশাকে পুলিশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রুশ-মার্কিন ঠান্ডা লড়াই তুঙ্গে। স্টেট সিক্রেট জানেন, এমন সমকামী মানুষেরা সর্বত্র সন্দেহের শিকার। কারণ, ফাঁদে ফেলে বিদেশি গুপ্তচরেরা নাকি ওদের থেকে সহজে হাতিয়ে নেয় তথ্য। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বুঝি ক্রমশ হয়ে উঠল সহ্যাতীত। এক দিন সকালে পরিচারিকা এসে দেখলেন, বিছানায় পড়ে আছে ট্যুরিংয়ের মৃতদেহ। পাশে রয়েছে কামড়ে-খাওয়া একটা আপেল। যাতে মেশানো
হয়েছিল পটাশিয়াম সায়নাইড। ৪১ বছর বয়সে মৃত্যু।
৮ জুন ১৯৫৪।
জীবনের মতো তাঁর মরণ ঘিরেও বিতর্ক। জীবননাশের ওই বিশেষ পদ্ধতি কেন? অনেকের বিশ্বাস, তাঁর প্রিয় ফিল্ম ‘স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ভস’ থেকে আইডিয়া পেয়েছিলেন ট্যুরিং। কিন্তু ওই ছবিতে নায়িকা আপেল খেলেও, মারা তো যাননি। বরং ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সে ঘুম ভাঙান এক রাজপুত্র এসে। আত্মার অস্তিত্বে আস্থাবান ট্যুরিং কি তবে ঘুমোতে চেয়েছিলেন ফের জেগে ওঠার আশায়? কে জানে, হয়তো বা। অ্যাপল কোম্পানির লোগো নিয়েও প্রশ্ন অনেকের। আপেলের ছবিটি কি ট্যুরিংকে কুর্নিশ জানাতে? কম্পিউটার-নির্মাতা সংস্থা অবশ্য উড়িয়ে দেয় সন্দেহ। বলে, ওটা আইজাক নিউটন স্মরণে। তা হলে ওই আপেল একটু কামড়ে খাওয়া কেন? কীসের স্মরণে? ট্যুরিং? নাকি জ্ঞানবৃক্ষের ফল?
জুলাই মাসে লন্ডন শহরে বসবে অলিম্পিক্সের আসর। তখনও অনেকের মনে পড়বে ট্যুরিংয়ের স্মৃতি। নিয়মিত দৌড়োতেন তিনি। অংশ নিতেন ম্যারাথন রেস-এ। অসুস্থ না হলে ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিক্সে ম্যারাথন দৌড়ে অবশ্যই ইংল্যান্ডের প্রতিনিধি হতেন ট্যুরিং। তখন তাঁর ব্যক্তিগত রেকর্ড ২ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট। সে বারে সোনাজয়ীর চেয়ে ১১ মিনিট পিছনে।
১৯৬৭ সালের পর থেকে ব্রিটেনে সমকামিতা আর অপরাধ নয়। ২০০৯ সালে দেশজুড়ে দাবি উঠেছিল, ১৯৫২ সালের রায়ের জন্য ব্রিটিশ সরকার ক্ষমা চাক। তা মেনেছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন। বলেছিলেন, ‘ওঁর প্রতি ঘোর অন্যায় আচরণ করেছিলাম আমরা। যা ঘটেছিল, তার জন্য আমি এবং আমরা যে গভীর দুঃখিত, তা বলার সুযোগ পেয়ে আমি খুশি।’
জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দাবি উঠেছিল আবার। পসথু্যমাস পারডন বা মরণোত্তর শাস্তি মকুবের। দাবি খারিজ করেছেন ব্রিটিশ আইনমন্ত্রী লর্ড ম্যাকনালি। বলেছেন, ‘সে সময়ের আইনে যা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তার পরিপ্রেক্ষিতে ট্যুরিং ন্যায্য ভাবেই অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। তিনি জানতেন তাঁর আচরণ আইন-বিরোধী। এটা বেদনাদায়ক যে, তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করাটা আজকের বিচারে নিষ্ঠুর এবং অকল্পনীয়। যুদ্ধকালে তাঁর অবদান ভাবলে তো আরও বেশি করুণ। কিন্তু সে সময়ের আইনে তাঁর বিচার প্রয়োজনীয় ছিল। তা ছাড়া, আমাদের বহু দিনের নীতি হল, ইতিহাসকে বদলানোর চেষ্টা না করে, যা ঠিক করা যাবে না, তাকে ঠিক না করে, বরং এটা মেনে নেওয়া যে, ও রকম অপরাধী সাব্যাস্তের ঘটনা আগে অনেক ঘটেছে।
হোক না আর্জি খারিজ। জন্মশতবর্ষে ট্যুরিং কিন্তু আমাদের উদ্দেশে ছুড়ে দিয়েছেন অনেকগুলো গূঢ় প্রশ্ন। এক জন মানুষ বড় মাপের না হলে কি সমকামিতা-সংলগ্ন ‘কলঙ্ক’ থেকে মুক্তি পাবেন না? বড় হলে, কত বড় হতে হবে তাকে? কম্পিউটারের অন্যতম জনক হলে চলবে? নাকি যুদ্ধকালে দেশকে বাঁচাতেও হবে?
আর, ইতিহাস অমোঘ? বর্তমান কি তা হলে চিরকাল অতীতের ক্রীতদাস? |
|
|
|
|
|