|
|
|
|
কর্মযোগে দেড় হাজার বছর |
রোমানরা আগাগোড়া কাজের কথা বুঝে এসেছেন। যে কোনও বিদ্যাকে সহজ করে তোলা,
এবং তাকে কাজে লাগিয়ে ফেলা, এটাই তাঁদের স্বভাবধর্ম। চিরদীপ উপাধ্যায় |
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালে বত্রিশ বছরের তরুণ আলেকজান্ডারের মৃত্যু হল যখন, রোম তখনও ‘রিপাবলিক’। আরও প্রায় দুই শতাব্দী পরে, খ্রিস্টপূর্ব ১৪৬ সালে তিন নম্বর ‘পিউনিক ওয়র’-এ জয়ী হয়ে দক্ষিণের প্রতিদ্বন্দ্বী কার্থেজকে (এখনকার টিউনিসিয়ার একটি অংশ) আক্ষরিক অর্থে ধূলিসাৎ করে সেই মাটিতে নুন মিশিয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে রোমের অধীশ্বররা পূর্ব দিকে মুখ ফেরালেন। বেশি দিন লাগল না গ্রিসকে কব্জায় আনতে। মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী হাজির হওয়ার আগেই গ্রিসের ইতিহাস আর রোমের ইতিহাস মিলেমিশে একাকার।
সত্যিই একাকার। রোম গ্রিসকে দখল করল, এবং গ্রিসের হাতে বাঁধা পড়ল। তার সভ্যতা, তার সংস্কৃতি, তার মন, তার মনন, তার শিক্ষা, তার শিল্প, তার স্থাপত্য, তার দর্শন, সর্বাঙ্গে এবং সর্বান্তঃকরণে গ্রিসের অমোঘ প্রভাব। রোমান বর্ণমালা, যা আমাদের নিত্যসঙ্গী, গ্রিক অক্ষরেরই সন্তান। এমনকী রোমান দেবতারাও আসলে গ্রিক দেবতা, ভিন্ন নামে জিউস হলেন জুপিটার, আফ্রোদিতে হলেন ভিনাস, আথেনা হলেন মিনার্ভা, অ্যাপোলো স্বনামেই ধন্য হলেন। স্বর্গ মর্ত পাতাল গ্রেকো-রোমান সিভিলাইজেশন সর্বত্রগামী হল।
তবে কি সভ্যতার ইতিহাসে রোম সাম্রাজ্যের নিজস্ব অবদান শূন্য? যা আছে, সবই ধার-করা? মহামান্য জুলিয়াস সিজার অপরাধ নেবেন না, এক দিক থেকে ব্যাপারটা সে-রকমই বটে। সিসেরো, সেনেকা বা ট্যাসিটাস, এমনকী দাশর্নিক-সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস, সবাই খুব বুদ্ধিমান, পণ্ডিতও বটেন, কিন্তু নিজস্ব তত্ত্ব বা দর্শনের ভাণ্ডার তাঁদের কারওই সমৃদ্ধ নয়, তাঁরা বড়জোর বিচক্ষণ উপদেষ্টা, রাজপুরুষকে রাজ্যচালনার পরামর্শ দেন, মাকিয়াভেলি যথা। এবং তাঁরা নিজেদের ধারণার সমিধ সংগ্রহ করেছেন গ্রিক তাত্ত্বিকদের থেকে। কি বিদ্যাচর্চায়, কি শিল্পসাধনায়, হাজার বছরের ইতিহাসে বিশুদ্ধ ‘রোমান’ বলে কিছুই নেই। |
|
যেখানে দুর্বলতা, সামর্থ্যও সেখানেই। রোমানরা আগাগোড়া কাজের কথা বুঝে এসেছেন। বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চা? জগৎ ও জীবনের রহস্য সন্ধানের আনন্দ? দর্শনের দুরূহ তত্ত্ব বোঝার, অথবা না-বোঝার অতীন্দ্রিয় অনুভূতি? নাঃ, সে সবে তেমন মতি নেই তাঁদের। যে কোনও বিদ্যাকে সহজ করে তোলা, এবং তাকে কাজে লাগিয়ে ফেলা এটাই রোমানদের স্বভাবধর্ম। এই স্বভাবই রোমান সভ্যতাকে ধারণ করে রেখেছিল। গ্রিক দার্শনিকদের গভীর তত্ত্বচিন্তার ফসলগুলিকে তাঁরা পরিবেশন করলেন সহজ সরল কিছু সদুক্তির সমাহার হিসেবে, রোজ মন দিয়ে কয়েক বার আবৃত্তি করলেই যা মুখস্থ হয়ে যায়। গ্রিক এবং মিশরীয় বিজ্ঞানের গবেষণা
কাজে লাগিয়ে তাঁরা নানান কাজের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করলেন। পাথরে বাঁধানো রোমান রাজপথ পরিবহণ, বাণিজ্য এবং যোগাযোগের আশ্চর্য উন্নতি ঘটাল, সাম্রাজ্য ধরে রাখার কাজটাও বহুগুণ সহজ করে তুলল। তৈরি হল অ্যাকুইডাক্ট দূর থেকে নদীর জল নিয়ে আসার পাকা বন্দোবস্ত, ফসলের খেতে জলসেচের সঙ্গে সঙ্গে জনপদে অফুরন্ত জলের জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা হল। যাকে আজ আমরা ‘কোয়ালিটি অব লাইফ’ বলে আদিখ্যেতা করি, দেড় হাজার বছর আগে সে বস্তু কোথায় পৌঁছেছিল, রোমান আমলের নাগরিক স্নানাগার (‘বাথ’)-এর ধ্বংসাবশেষ দেখলে এখনও সেটা দিব্যি টের পাওয়া যায়।
এই পাটোয়ারি বুদ্ধি নরলোক ছাড়িয়ে প্রসারিত হয় দেবলোকেও। রোমান সম্রাটরা ক্রমে নিজেদের ওপর দেবত্ব আরোপ করলেন, হয়ে উঠলেন চলমান ঈশ্বর। |
|
এই দৈব মহিমা সাম্রাজ্যকে বহুগুণ টেকসই করেছিল। তবে দেশ এবং কালের গণ্ডি অতিক্রম করে বেঁচে থাকার অতুলনীয় নিদর্শন হিসেবে রোমের যে উত্তরাধিকারটি প্রাতঃস্মরণীয়, সেটি হল আইন। গ্রিক পণ্ডিতরাও সমাজবিধি, রাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিস্তর ভেবেছিলেন, কিন্তু তাঁদের ভাবনার ভরকেন্দ্র ছিল জাস্টিস বা ন্যায়। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নীতি কী ভাবে ন্যায়সম্মত হবে, সেই বিষয়ে তাঁরা যুগান্তকারী চিন্তা করেছিলেন। রোমানরা অন্য ধাতের, ন্যায়নীতির দার্শনিক বিচার নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামালেন না, তাঁরা রাজ্যশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় নানা বিধান স্থির করে সেগুলি লিখে ফেললেন। রাজত্ব বিস্তারের শুরুতেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল এক ডজন সারণি ‘টুয়েলভ টেবলস’। প্রথম যুগে কাঠের, পরে ব্রোঞ্জের ফলকে খোদাই করা হল সম্পত্তি থেকে চুক্তি, দাম্পত্য থেকে ক্রীতদাস, বিভিন্ন বিষয়ে আইনকানুন। তার পর যেখানেই রোমান অধিকার জারি হল, সেখানেই প্রকাশ্য স্থানে ফলকগুলি প্রতিষ্ঠা করা হল। রোমান বিধি ছড়িয়ে পড়ল সাম্রাজ্যের হাত ধরে। ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাস্টিনিয়ান দণ্ডবিধিকে একটা সংহত রূপ দিলেন, ‘কোডেক্স কনস্টিটিউশনাম’ হয়ে উঠল পশ্চিম দুনিয়ার যাবতীয় আইনের কেন্দ্রবিন্দু।
সন্দেহ নেই, রোম গ্রিসের সন্তান। সন্দেহ নেই, মন এবং মননের বিচারে সন্তান তার জননীকে অতিক্রম করতে পারেনি, বস্তুত তার কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু যে উত্তরাধিকার সে পেয়েছে, তাকে কাজে লাগিয়ে এমন এক সাম্রাজ্য সে তৈরি করেছে, ইতিহাসে যার তুলনা মেলা ভার। প্যাক্স ব্রিটানিকা বা প্যাক্স অ্যামেরিকানা শেষ বিচারে প্যাক্স রোমানা-র উত্তরসূরি মাত্র, দেড় হাজার বছরের সঙ্গে দুই বা এক শতাব্দীর তুলনা হয় নাকি? নাবালক, নাবালক!
হয়তো রোম সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিস্পর্ধী পীতসাগরের তীরে বাড়ছে। তত্ত্বচিন্তায় কালহরণ না করে কাজের কাজগুলো চটপট সেরে ফেলতে রোমানদের জুড়ি যদি কোথাও থাকে, তবে তার নাম চিন। তা হলে, অতঃপর, প্যাক্স চিনা? |
|
|
|
|
|