|
|
|
|
দারুণ রোমহর্ষক |
শৌর্য, প্যাশন, সৌন্দর্য, নির্মমতা, ঐশ্বর্য, আধিপত্য, নিষ্ঠুর ঔদাসীন্য সব বিশেষণে
একচ্ছত্র অধিকার আর উত্তরাধিকার একমাত্র যার প্রাপ্য, তাহাই রোম। অনির্বাণ ভট্টাচার্য |
২১ এপ্রিল, রোমিউলাস-এর হাতে পত্তন হল রোমের। সাল নিয়ে মতবিরোধ আছে আজও, আছে রোমিউলাসকে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দেখার বেলায়ও, কিন্তু মোটামুটি সকলেই মেনে নিয়েছেন, যে রোমের জন্মদিন আজই। গল্প অনুযায়ী, যুদ্ধের দেবতা মার্স, রিয়া সিলভিয়া নামক এক রাজকন্যেকে ধর্ষণ করেন। জন্ম হয় যমজ ভাই রেমাস ও রোমিউলাস-এর। চাপে পড়ে তাদের পরিত্যাগ করেন রিয়া। আর তার পরই নাকি একটি মেয়ে নেকড়ে এসে তাদের রক্ষা করে। লায়েক হয়ে দু’ভাই টাইবার নদীর পাশেই একটি পাহাড় ঘেরা জায়গায় এসে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু তার পরেই রোমিউলাস ভাইকে খুন করে রোম স্থাপন করেন। এর পর রোম দিনকে দিন ফুলে-ফেঁপে উঠল। গ্রাম থেকে ক্রমে সে হল শহর, তার পর রাজত্ব, অভিজাততন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ঘুরে প্রবল সাম্রাজ্য পর্যন্ত। সমস্ত ইউরাপ, কিছুটা আফ্রিকা আর অনেকটা এশিয়া জুড়ে যে প্রতাপের বিস্তার রোম করেছিল, তার পুনরাবৃত্তি পরবর্তী কালে খুব একটা হয়নি। |
|
রোম যা চেয়েছে, যখন চেয়েছে স্রেফ মুঠো ভরে তুলে নিয়েছে। উল্টে প্রতিবাদ? রোমের জমানায় ও সব হত না। নতুন রাজ্য জয় করার পরই রোমান বাহিনি রাস্তায় নেমে কিছু লোককে খতম করত ঠান্ডা মাথায়। যুক্তি, ভবিষ্যতের বিদ্রোহ আটকানো। আর নাছোড় বিদ্রোহী যদি থেকেও যায়, তাকে মেরে সর্বসমক্ষে টাঙিয়ে রাখা হত। নিদর্শন, বাকিদের জন্য। অবশ্য এ সবের কোনও দরকারই হত না, যদি কেউ আগে থেকেই হাঁটু গেড়ে বশ্যতা মেনে নিত। মানত অনেকেই, গলায় ফাঁস লাগার চেয়ে তো ঢের স্বস্তির। রোমের হাতে হাতে ঘুরত এই ফাঁস, প্রতি মুহূর্তে অপেক্ষমাC, কখন গলায় পড়বে, কখন শক্ত হবে, কখন চুষে নেবে, শেষ বিন্দু।
তার পর, কালের নিয়মে সেই রোমও ভেঙে গেল। রেখে গেল একটা, না, অনেক রোমহর্ষক গল্প!
|
খেলা তখন |
গ্লেডিয়েটর মানেই বিক্রম, শৌর্য, গ্ল্যমার, রাসেল ক্রো? ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলেছে। গ্লেডিয়েটররা ছিল রোমান নাগরিকদের চুটিয়ে আনন্দ করার সেরা অপশন। আর রোমান সম্রাটদের খেলনাবাটি। দুই গ্লেডিয়েটর একে অপরকে টুকরো করে ফেলবে, আর এক সময় ঘিলু বের হয়ে পট করে মরে যাবে। সেই ছিন্ন দেহের ঠিক পাশেই আবার শুরু হবে পরের খেলা। টানটান মজা। তার পর খাঁচা থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে ক্ষুৎকাতর কিছু সিংহ। চার দিক দিয়ে হামলে পড়বে তারা, আর গ্লেডিয়েটররা বুঝতেও পারবে না। রক্ত, ঘাম, ব্যথা, অবসাদে তত ক্ষণে দৃষ্টি ঝাপসা ওদের। বাড়বে শুধু দর্শকের চিৎকার। আর চিৎকার করবে নাই বা কেন? এই ‘গেম্স’ দেখা নাগরিকের অধিকারের মধ্যেই যে পড়ত। রোমান সাম্রাজ্যের নিষ্ঠুরতার এর চেয়ে বড় দৃষ্টান্ত আর হয় কি? একটা ইন্ডাস্ট্রি যেন। সেটিকে সযত্নে লালন করার জন্য ছিল গ্লেডিয়েটরদের আলাদা স্কুল। |
|
‘গ্লেডিয়েটর’ ছবিতে রাসেল ক্রো |
যেখানে লড়াইয়ের সঙ্গেই শেখানো হত, হেরে মৃত্যু বরণ করার টেকনিকও। টেকনিক সহজ। লড়াইয়ে হারার পর যদি সবার ইচ্ছে হয়, একটু মৃত্যু দেখলে মন্দ হয় না, তবে সেই হেরোকে হাঁটু গেড়ে বসতে হবে জয়ী গ্লেডিয়েটরের সামনে। আর তখন হেরোর গলার নলিটা কেটে দেওয়া হবে। হেরো কোনও চিৎকার করবে না, করবে শুধু দর্শক, সম্রাট। এখানেই শেষ নয় কিন্তু। নিথর দেহ যে সত্যিই নিথর, তা বুঝতে এক জন এসে হেরোর খুলি ফাটিয়ে দেবে। এ বার স্বস্তি সম্রাটের। আর তাতেও যদি সম্রাটের মন না ভরে, তা হলে ক্যালিগুলা’র মতোও করতে পারেন। অন্য কোনও গ্লেডিয়েটর স্টকে ছিল না বলে, দর্শকাসনের প্রথম পাঁচটি রো-কেই সিংহের সামনে ফেলে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। দ্য শো মাস্ট গো অন।
|
রুটি ও সার্কাস |
দাপট মানে কী, বুঝতে গেলে যে কোনও রোমান সম্রাটের ছবিই যথেষ্ট। অমন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে আর কেউ? জুলিয়াস সিজার তো স্বনামধন্য, কিংবা অগাস্টাস, অথবা নিরো, তার পর সেই নরপিশাচ, ক্যালিগুলা। আবার আমরা অনেকেই জানি না গেইয়াস মারিয়াস-এর কথা, যাঁর জমানায় রোমান বাহিনী অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। পৃথিবীতে অনেক সাম্রাজ্যই এসেছে, গেছে, কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী এতটা দাপটের ইতিহাস রচনা করতে পারেনি আর কেউ। এমনকী যখন সাম্রাজ্য অস্তাচলের দিকে হাঁটি হাঁটি পা পা, তখনও তার জাঁক দেখে দুনিয়ার দু’নয়ন বিস্ফারিত হয়েছে, গায়ে কাঁটা দিয়েছে। |
|
কী ছিল এই দাপটের রহস্য? শাসনের দক্ষতা? সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে ক্ষমতার ধারে কাছেও ঘেঁষতে না দেওয়া? অবাধ্যতার অ দেখলেই মার মার করে দণ্ড নামিয়ে আনা নতমস্তকের ওপর? সুস্পষ্ট এবং কঠোর আইনের শাসনে গোটা দেশ এবং সাম্রাজ্যকে বেঁধে ফেলা? না কি, সেই ‘রুটি ও সার্কাস’-এর মোক্ষম দাওয়াই? রোম সাম্রাজ্যের কাছে শেখা যে অস্ত্র দিয়ে শাসকরা আজও শাসিতের মন ভুলিয়ে রাখতে যত্নবান?
|
রোম্যান্স? ছিঃ |
রোমান মহিলারা কেমন ছিলেন? পুরনো ছবি দেখে তো অবিশ্বাস্য মনে হয়, কিন্তু ছবির পিছনের আবেগ অন্য কথা বলে। যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে রোমান মহিলাদের থাকাটা জরুরি ছিল, কিন্তু ওই অবধিই। তাঁদের খুব একটা কাজকর্ম ছিল না। থাকবে কী করে, তাঁরা তো জীবনের প্রতিটা মুহূর্তেই কোনও এক পুরুষের অধীনেই থাকতে অভ্যস্ত। বাবা, স্বামী, ছেলে, নয়তো রাষ্ট্রের ঠিক করে দেওয়া কোনও পুরুষ! রোম যখন প্রজাতন্ত্র ছিল, তখন আবার পাবলিক ব্যাঙ্কোয়েট-এ মহিলাদের ওয়াইন খাওয়া মানা ছিল। ওঁদের জন্য আঙুরের রস। আর সেখানে ছেলেরা হেলান দিয়ে বসলেও মেয়েদের তেমন করে বসা ছিল নিষিদ্ধ। ওঁদের বেলায় সোজা শিরদাঁড়া। আর এই শিরদাঁড়াই অত্যন্ত দুর্বল মনে করা হত সেই সব পুরুষদের, যাঁরা নিজ নিজ স্ত্রী’র প্রেমে পাগল হয়ে পড়তেন। কারণ প্রেম তো পুরুষকে মেয়েলি করে তোলে। নিজের স্ত্রীর সঙ্গে অবাধ যৌনতাও তাই। যৌনতা চলতে পারে একমাত্র সন্তান ধারণের জন্য। অনেকটা মুখ-নাক কুঁচকে তেতো গেলার মতো। কিন্তু বাড়ির পুরুষ যদি পোষা ক্রীতদাসীর সঙ্গে উদ্দাম আনন্দে মেতে ওঠে, তা হলে যৌনতা জিন্দাবাদ। মেয়েরাও অনেকেই লুকিয়ে-চুরিয়ে কোনও ক্রীতদাসের সঙ্গে একলা ঘরে ঢুকত নির্ঘাত, শুধু ধরা না পড়লেই হল।
|
শহরের মধ্যে দেশ |
একটা শহরের ভিতরে একটা আস্ত সার্বভৌম রাষ্ট্র? হ্যাঁ, তার নাম ভ্যাটিকান সিটি। রোমান ক্যাথলিক চার্চের সদর দফতরটি রোমের একটি অংশ, ১১০ একর জমির ওপর অবস্থিত এই ‘দেশ’-এর জনসংখ্যা ৮০০। এখন অবশ্যই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, কিন্তু চিরকাল এমনটা ছিল না। পোপের সঙ্গে কত যে সংঘাত লেগেছিল রোমান সম্রাটদের, তার ইয়ত্তা নেই। লড়াই ক্ষমতার। লড়াই দাপটের। লড়াই আগে কথা বলার। |
|
পোপ মনে করতেন, তিনি ভগবানের বার্তা সাধারণের কাছে পৌঁছে দেন, ফলে তাঁরই তো প্রাধান্য পাওয়া উচিত। কিন্তু সে যুক্তি রোমান সম্রাট শুনবেন কেন? ব্যস, বেধে যেত ধুন্ধুমার কাণ্ড। পোপের প্রাপ্য আর সিজারের প্রাপ্য নিয়ে মাঝে মাঝেই কাজিয়া তুঙ্গে। অবস্থা আরও জটিল হয়, যখন স্বয়ং পোপ ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে এক বহিরাগত রাজার পক্ষ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘হোলি রোমান এম্পায়ার।’ যার সম্পর্কে ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছিলেন: neither holy, nor Roman, nor an empire.
|
দাস, স্পার্টাকাস |
যে কোনও রোমান বাড়িতে ক্রীতদাসের সংখ্যা বলে দিত, তিনি কতটা বিত্তশালী, বা সমাজের কত উঁচু স্তরে তাঁর জায়গা। রোমানরা যে রাজ্য জয় করত, সেখানকার বহু মানুষকে দাসে পরিণত করত। ক্রমে গড়ে উঠল ক্রীতদাসের বাজার। সম্রাট ও তাঁর অনুচররা জিতে-আনা-দাসদাসীদের অনেককেই বিক্রি করে দিতেন সেখানে, রাজভাণ্ডার স্ফীত হত। স্বয়ং জুলিয়াস সিজার এক বার একটি প্রদেশ জয় করে সেখানকার হাজার পঞ্চাশ অধিবাসীর সবাইকে দাসব্যবসায়ীদের কাছে বেচে দিয়েছিলেন। ক্রীতদাসদের ওপর অত্যাচারের রেওয়াজ কতটা ব্যাপক ছিল, ইতিহাসে সেটা স্পষ্ট নয়, কিন্তু দাসেরা পালিয়ে যাবে বা দল বেঁধে বিদ্রোহ করবে, এই আশঙ্কা প্রভুদের নিত্যসঙ্গী ছিল। দাস বিদ্রোহের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ নাম অবশ্যই স্পার্টাকাস। খ্রিস্টপূর্ব ৭১ সালে তাঁকে দমন করে এবং তাঁর অনুগামী কয়েক হাজার ক্রীতদাসকে রাজপথের ধারে ক্রুশবিদ্ধ করে তবে সম্রাটের শান্তি হল।
|
সাক্ষাৎ বিবেক |
পাবলিক
কী বলবে, কেমন করে থাকবে, কোন সীমা পর্যন্ত এগোবে, সে কথা বলে দেওয়ার জন্যে এখন অনেক বিগ ব্রাদার, বিগ সিস্টার (স্ত্রী-পুরুষ সাম্যের খাতিরেই লেখা হল, আর কোনও অভিসন্ধি নেই।)। কিন্তু রোমে এ সব সামলাবার জন্য ছিল আস্ত একটা পদ। সেন্সর। এদের মূল কাজ ছিল রোমের সমস্ত নাগরিকের হাল-হকিকতের খোঁজ রাখা। কার আলমারিতে কত সোনা থেকে কার বাড়িতে নতুন ক্রীতদাস এল, কে বিয়ের বয়স হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে করছে না, সব। |
|
সেন্সর যদি মনে করে, কারও অমুক বয়সে বিয়ে করতে হবে আর তার পর তমুক সময়ে সন্তান ধারণ করতে হবে, তা হলে সব্বাইকে সে কথা শুনতে হবে। তাতে কারও কিছু বলার ছিল না, কারণ বলতে গেলেই যে মহা-পানিশমেন্ট। চাবুক নয় বটে, কিন্তু তার চেয়েও ভয়ানক সামাজিক মর্যাদা হারানোর লজ্জা। |
|
|
|
|
|