রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে এবং প্রশাসন রাজনৈতিক ‘হস্তক্ষেপমুক্ত’ থাকছে না বলে প্রতি দিনই অভিযোগ করছে সিপিএম। কিন্তু আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ চাইছে না রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। শাসক ভূমিকায় থাকার সময়ে এই বিষয়ে তাদের যা অবস্থান ছিল, বিরোধী আসনে গিয়েও তার পরিবর্তন হয়নি।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে প্রশাসন পরিচালনা এবং আইনশৃঙ্খলার হাল খারাপ হওয়ার আরও কিছু দৃষ্টান্ত শুক্রবার পেশ করেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। এই ব্যাপারে বারেবারে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েও যে লাভ হয়নি, সে কথাও ফের জানান। তা হলে কি তাঁরা এর পরে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ দাবি করবেন? সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য সূর্যবাবু বলেন, “কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে কখনও মনে করি না। আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়। রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়ে কেন্দ্রের কোনও ভাবেই হস্তক্ষেপ উচিত নয়। ওঁদের (তৃণমূল) মতো কথায় কথায় ৩৫৫ বা ৩৫৬ ধারা আমরা চাই না। যেটা তাঁরা ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের পর থেকে আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে প্রতিদিন দাবি করতেন! ১৯৭৭-এর পর থেকেও অনেক বার করা হয়েছে।”
রাজ্যের এক্তিয়ারে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সিপিএমের ‘নীতিগত অবস্থান’ বরাবরের। কিন্তু অতীতে যখন সিপিএম ওই কথা বলত, তার অধিকাংশ সময় তারাই রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল। মমতার সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সূর্যবাবু স্পষ্ট করে দেন, পরিস্থিতি বদলালেও এই বিষয়ে তাঁদের অবস্থান বদলায়নি। সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যায়, বিরোধী দল হিসাবে তারা যে তৃণমূলের চেয়ে অনেক বেশি ‘দায়িত্বশীল’, তা-ই তুলে ধরা তাদের লক্ষ্য। গত এক বছরে বেশ কিছু ঘটনায় সূর্যবাবুরাও রাজ্যপালের কাছে গিয়েছেন। রাজ্যপাল তো কেন্দ্রের-ই প্রতিনিধি? সূর্যবাবুর জবাব, “রাজ্যপালের কাছে গিয়েছি রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে, কেন্দ্রের প্রতিনিধি বলে নয়। সেই সব বিষয়েই গিয়েছি, যেখানে রাজ্যপালের কিছু করণীয় থাকতে পারে।” আলিমুদ্দিনে বিরোধী দলনেতা জানান, তৃণমূলেরই হাতে বর্গা জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে সোনারপুর-রাজপুর এলাকার তৃণমূল কর্মীর পরিবার তাঁর কাছে এসেছিলেন। তাঁরা ঘটনার বিহিত চেয়ে চিঠি লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রীকেই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে চিঠি ও অভিযোগ জমা দিতে গেলে তাতে ‘নেওয়া যাবে না’ ছাপ মেরে দেন সচিবালয়ের এমন এক কর্মী, যাঁর বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় অভিযোগ আছে! সূর্যবাবুর কথায়, “প্রশাসন কী রকম হস্তক্ষেপমুক্ত ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তারই দৃষ্টান্ত এগুলো!”
রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, মহিলাদের উপরে অত্যাচার হচ্ছে, গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ হচ্ছে বলে অভিযোগ বাম শরিক সিপিআইয়েরও। দলের রাজ্য পরিষদের বৈঠকে এই ব্যাপারে আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক সুধাকর রেড্ডি। তিনি এ দিন বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে আমরা দেশ জুড়ে প্রচার করব। যে ভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র হরণ করা হচ্ছে, সরকারের মধ্যে ক্রমেই অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, তা নিয়ে সকলের প্রতিবাদ করা উচিত।” রেড্ডির মতে, সরকার ‘নিরাপত্তাহীনতা’য় ভুগছে বলেই সব ব্যাপারে ‘অসহিষ্ণু’ হয়ে পড়ছে। রাজ্য সম্পাদক মঞ্জুকুমার মজুমদার বলেন, “যে উচ্ছেদ-বিরোধী আন্দোলন করে, দলতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলে মমতা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, ক্ষমতায় এসে তিনি সেই কাজই করছেন!”
রাজ্য সরকারের ‘অগণতান্ত্রিক’ মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে শাসক জোটের শরিক কংগ্রেসও। গত ১১ মাসে সরকার অনেক ভাল কাজের চেষ্টা করলেও পার্ক স্ট্রিট কাণ্ড, রঙ্গচিত্র-কাণ্ডে সরকার যে ভূমিকা নিয়েছিল, তা শুধরে নেওয়া দরকার বলে এ দিন উত্তরবঙ্গে বাগডোগরার বিহারমোড়ে এক জনসভায় বলেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। সভায় কংগ্রেস সাংসদ দীপা দাশমুন্সি বলেন, সরকার ভুল করলে শরিক হিসাবে তার ‘দায়’ কংগ্রেসের উপরেও এসে পড়ছে। দীপার কথায়, “কোথাও ভুল হচ্ছে দেখলে তাই আমরা সমালোচনা করছি।” গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের প্রতিবাদে দক্ষিণ কলকাতা জেলা কংগ্রেস এ দিনই মালা রায়ের নেতৃত্বে গোলপার্ক থেকে গড়িয়াহাট এবং সেখান থেকে যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত মৌন মিছিল করেছে।
বিরোধী ও জোট শরিকের সমালোচনার মধ্যেও ‘টাইম’ পত্রিকায় বিশ্বের প্রথম একশো জন ‘প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে’র তালিকায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা স্থান পেয়েছেন। এই প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী যে ‘প্রভাবশালী’, কটাক্ষ-সমেত তা ‘স্বীকার’ করেছে প্রধান বিরোধী দল! এই সংক্রান্ত প্রশ্নে সূর্যবাবু বলেন, “স্থান পেয়েছেন, এই নিয়ে কী বলার আছে! আমি স্থান পাওয়ার যোগ্যও নই। আর ওই পত্রিকা থেকে যদি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হত, আপত্তি করতাম। তার পরেও নাম ছাপলে আইনজীবীর পরামর্শ নিতাম!” কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ‘প্রভাবশালী’, এটা কি তাঁরা অস্বীকার করেন? বিরোধী দলনেতার বক্তব্য, “উনি যে প্রভাবশালী, তা নিয়ে তো সন্দেহ করতে পারি না! প্রভাব সু-কু, অনেক রকম হয়! তবে ওই তালিকায় আরও অনেকের সঙ্গে (যেমন, মোল্লা ওমর) ওঁর নাম আছে। আগে হিটলারও প্রচ্ছদে ছিলেন!” মার্কিন পত্রিকা বা আমেরিকার অনুষঙ্গের সম্পর্কে বামেদের বিরাগ অবশ্য সুবিদিত! ঘটনাচক্রে, মমতা ‘টাইমে’ স্থান পাওয়ায় তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে ট্যুইট করেছেন গুজরাতের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যিনি নিজেও সম্প্রতি ওই পত্রিকার প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছিলেন। |