এত দিন ছিল চড়া তাপমাত্রা। এ বার তার দোসর হল অতিরিক্ত আর্দ্রতা। এই ‘জুটি’র দাপটে হাসফাঁস অবস্থা কলকাতা-সহ গোটা দক্ষিণবঙ্গের। আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়ে দিয়েছে, রবিবার পর্যন্ত এমন অস্বস্তিকর অবস্থা চলবে। ভাগ্য ভাল উত্তরবঙ্গের। সেখানে আগামী দু’দিন ভারী ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছেন আবহবিদেরা। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের জন্য আপাতত বরাদ্দ ‘অস্বস্তি’ই।
শুধু তাপমাত্রা চড়া থাকলে শরীর তা অনেকক্ষণ সহ্য করে নেয়। কিন্তু একাধারে বেশি তাপমাত্রা এবং অত্যাধিক আর্দ্রতার সঙ্গে বেশিক্ষণ যুঝতে পারে না শরীর। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শারীরবিদ্যার শিক্ষকেরা বলছেন, আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে ত্বক থেকে ঘাম দ্রুত বাষ্পীভূত হয়। বাষ্পীভূত হওয়ার সময়ে ত্বক থেকে তাপ শুষে নেয় ঘাম। তখন বাতাসের গতি বেশি হলে বাষ্পীভবনের হারও বেড়ে যায়, শরীরও দ্রুত ঠান্ডা হতে শুরু করে। ফলে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলির ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে না। কিছুটা হলেও স্বস্তি ফেরে। |
কিন্তু উচ্চ তাপমাত্রার সঙ্গে অত্যাধিক আর্দ্রতা থাকলে ঘাম ত্বক থেকে দ্রুত বাষ্পীভূত হতে পারে না। ফলে ঘাম জমে যায় ত্বকের উপরে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান দেবাশিস সেনের ব্যাখ্যায়, অত্যধিক আর্দ্রতায় ঘাম বাষ্পীভূত না হওয়ায় ত্বকের তাপমাত্রাও কমতে পারে না।
ফলে ঘর্মগ্রন্থিগুলি আরও বেশি করে ঘাম সৃষ্টি করে। শরীর থেকে দ্রুত জল বেরিয়ে যেতে থাকে। তার সঙ্গে বেরিয়ে যায় নুন। ফলে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলির ভারসাম্য নষ্ট হতে শুরু করে। মানুষ দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে সেই চাপ হৃৎপিণ্ড নিতে পারে না। দেবাশিসবাবুর মন্তব্য, এমতাবস্থায় হিট স্ট্রোকের শিকার হতে পারেন অনেকে।
আবহবিজ্ঞানীরা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতার নিরিখে একটি সূচক তৈরি করেছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘অস্বস্তিসূচক’। এর পরিমাপ হয় ডিগ্রি সেলসিয়াসে। কলকাতার ক্ষেত্রে ওই সূচক ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাত্রা ছাড়ালেই মানুষের অস্বস্তি বাড়তে থাকে। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলেন, দিনের বিভিন্ন সময়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা কত, তার উপরে নির্ভর করে অস্বস্তিসূচকের মাত্রা। |
শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটাতেই অস্বস্তিসূচক স্বাভাবিকের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দুপুরে তা ছিল স্বাভাবিকের থেকে ১০-১১ ডিগ্রি বেশি। বৃহস্পতিবারেও অস্বস্তিসূচক সকাল থেকেই বেড়ে গিয়েছিল। এবং আজ, শনিবারও তা একই রকম থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন আবহবিদেরা।
কেন এই অবস্থা? আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বায়ুমণ্ডলের নীচের স্তরে একটি ঘূর্ণাবর্ত রয়েছে, যা ওড়িশা থেকে উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশে রয়েছে আরও একটি ঘূর্ণাবর্ত। এর ফলে বঙ্গোপসাগর দিয়ে হুহু করে জলীয় বাষ্প ঢুকছে ঠিকই, কিন্তু তা দক্ষিণবঙ্গের উপর দিয়ে গিয়ে জমা হচ্ছে উত্তরবঙ্গে। তাই উত্তরবঙ্গে আগামী দু’দিন ব্যাপক ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর।
শুধু বেশি আর্দ্রতাই নয়, ঝাড়খণ্ড থেকে গরম বাতাস ঢুকে পড়ছে সংলগ্ন দক্ষিণবঙ্গে।
ফলে তাপমাত্রা বেশিই থাকছে। এই চড়া তাপমাত্রা এবং অত্যাধিক আদ্রর্তার জেরে লাফিয়ে বেড়েছে অস্বস্তিসূচক।
এই অবস্থা কাটবে কবে? আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, সুরাহা মিলতে পারে তিনটি পরিস্থিতিতে। এক, ঝাড়খণ্ডে পশ্চিমী বায়ুর যে প্রভাব চলছে, তার বদল ঘটলে। দুই, বঙ্গোপসাগরে কোনও নিম্নচাপ অক্ষরেখা তৈরি হলে। এবং তিন, এখন বায়ুমণ্ডলের নীচের স্তরে যে ঘূর্ণাবর্ত রয়েছে, তা সরে গিয়ে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে নতুন কোনও শক্তিশালী ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হলে। |
অস্বস্তি থেকে বাঁচতে |
• শশা, তরমুজ জাতীয় ফল বেশি করে খান |
|
• রাস্তায় ছাতা নিয়ে বেরোন,
রোদ চশমা পরুন |
• ঘন ঘন নুন, চিনি মেশানো
জল কিংবা
লেবু-জল খান |
|
|
• রাস্তার
কাটা ফল, মশলাদার খাবার খাবেন না • গামছা বা হাল্কা তোয়ালে দিয়ে ঘন ঘন ঘাম মুছুন • হাল্কা রঙের সুতির পোশাক পরুন • বার বার বাতানুকূল ঘর থেকে বাইরে
বেরোবেন না |
|
|
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা জানাচ্ছেন, এই সময়ে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ অক্ষরেখা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান ঘূর্ণাবর্তটি সরে গিয়ে নতুন কোনও জোরালো ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হওয়ার মতো পরিস্থিতিও আগামী ৪৮ ঘণ্টায় (রবিবার পর্যন্ত) নেই। আর ঝাড়খণ্ডের বায়ুপ্রবাহের বদল কবে হবে, তা নির্ভর করছে কাশ্মীর সীমান্তে অপেক্ষা করা তীব্র পশ্চিমী ঝঞ্ঝার গতিপ্রকৃতির উপরে। ওই পশ্চিমী ঝঞ্ঝার জন্য গোটা উত্তর-পশ্চিম ভারতে ছড়িয়ে রয়েছে মেঘ। ওই মেঘের জেরেই উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের বায়ুপ্রবাহের পরিবর্তন হয়েছে।
কাজেই, ঝাড়খণ্ডের বায়ুপ্রবাহ কখন কেমন থাকবে, তা নির্ভর করছে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার গতিপ্রকৃতির উপরেই।
আবহবিদদের আশা, সোমবার গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের উপরে একটা নতুন ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হবে। আর সেটাই মানুষকে উদ্ধার করবে এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে। কালবৈশাখী নয়, আঞ্চলিক ভাবে বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হয়ে বৃষ্টি নামতে পারে বলেই মনে করছেন তাঁরা। |