|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
কার্টুন একটা তৃতীয় ভূমি, একটা আশ্রয় |
শিলাদিত্য সেন |
টোকাই আর রফিকুন নবী, শুভেন্দু দাশগুপ্ত।
প্রাপ্তিস্থান: ৪৯/২৪/২ প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শা রোড, কলকাতা ৩৩। মূল্য অনুল্লেখিত। |
যাক! ভোট শেষ... বললেন ভদ্রলোক। শুনে টোকাই বলে: হ’। আবার আমরা যে যেমন আছিলাম তেমন থাকনের দিনে ফেরত...। কার্টুনটায় দাঁড়ানো ভদ্রলোকের একটু দূরেই জঞ্জালের ডাস্টবিন, তাতে কাক বসে, আর ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে টোকাই। তারও পিছনে উঁচু উঁচু বাড়ি, সে সব বাড়ির উপর দিয়ে পাখির ওড়াউড়ি। (নীচের ছবিটি)। টোকাইয়ের নাম বাংলাদেশে সকলেই জানেন, যাঁরা কার্টুন দেখেন। ছদ্মনামে টোকাইয়ের এই কার্টুন আঁকেন রনবী।
রনবী হলেন রফিকুন নবী। তিনি শুধু নামকরা ব্যঙ্গচিত্রীই নন, চিত্রকরও। বাংলাদেশের সরকারি চিত্রবিদ্যাচর্চা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। শুভেন্দু দাশগুপ্ত তাঁর কার্টুনের কর্মকাণ্ড নিয়ে শুধু বই-ই লেখেননি, প্রকাশও করেছেন টোকাই আর রফিকুন নবী (সঙ্গে প্রচ্ছদের ছবি)।
|
|
শুভেন্দুর সঙ্গে কথোপকথনে রফিকুন জানান যে, এই ধরনটা যে খুব ভেবেচিন্তে করেছিলেন তা নয়। ‘পথশিশু, অনাথ, উইটি, তোয়াক্কা করে না, বেয়াদপি করে না, মজার মজার কথা বলে।’ এই যে টোকাই, সে শুধু সামাজিক কথাই বলে, তাতে সরাসরি রাজনীতি না থাকলেও সামাজিক অনুষঙ্গের তো একটা রাজনীতি থাকেই। সামরিক শাসক এরশাদ তাই ফতোয়া দিয়েছিলেন: টোকাই যেন না আঁকা হয়!
রফিকুন কী ভাবে পেয়েছিলেন টোকাইকে? লিখছেন ‘আট-ন’ বছরের একটা ছেলে। কোথায় থাকতো, কোথা থেকে আসতো জানা ছিল না। আমার বাসার ঠিক উল্টো দিকের টিনের বাসাটার এক চিলতে বারান্দায় মনের সুখে গড়াগড়ি দিত সারাদিন। পরনে চেক লুঙ্গি। মোটা পেটটায় কষে বাধা। মাথায় ছোট করে ছাঁটা খাড়া খাড়া চুল। সময় নেই, অসময় নেই চিৎকার করে গান গাইতো। রাস্তায় পথচারীকে কখনো অহেতুক কিছু প্রশ্ন করা আর ঘড়ি হাতে লোক দেখলেই সময় জানতে চাওয়াটা ছিল তার নিত্যদিনের অভ্যেস।’ এ সবই ’৬৮-’৬৯-এর কথা। বাংলাদেশ তখনও হয়নি, রাস্তার আর কটা ছিন্নমূল বাচ্চার মতোই ছেলেটিকে দেখতেন রফিকুন, হঠাৎ এক দিন হারিয়ে গেল ছেলেটি। বাংলাদেশ হওয়ার পর অন্য পাড়ায় থাকেন রফিকুন, সেখানে ‘বিকালে বাসার সামনের মাঠে ছেঁড়া একটি বস্তা ঘাড়ে আট-ন বছরের ছেলেকে দেখে চমকে উঠলাম। সাত-আট বছরের আগের সেই বিস্মৃত পেটমোটা ছেলেটির কথা মনে পড়ে গেল। একই বয়স, একই রকম ফোলা পেটে চেক লুঙ্গি খাটো করে ন্যাড়া করা মাথা। কি আশ্চর্য মিল।’ ব্যস্ জন্ম নিল টোকাই।
টোকাইয়ের জন্ম নিয়ে রফিকুন জানাচ্ছেন ‘‘শেষ পর্যন্ত কার্টুন আঁকার প্রাথমিক পদ্ধতিটাই গ্রহণ করতে হয়েছিলো। অর্থাৎ বৃত্তাকার আউট লাইনে মাথা আর তাতে ফোটা দিয়ে নাক চোখ এবং মুখের অভিব্যক্তি আনতে ‘প্রথম দিনের চাঁদ’-এর মতো লাইন দেওয়ার নিয়মটাই নিতে হয়েছিলো। খাড়া খাড়া চুল বা একেবারে ন্যাড়া মাথা কোনটাই ভাল আসছিলো না...।’’
কার্টুনে ‘ছোটলোক’ টোকাই এই শিরোনামে একটা অধ্যায়ই লিখেছেন শুভেন্দু, তাতে তার মত: ছোটলোক শরীর, ছোট শরীর যেমন হয়, তেমন করেই আঁকা টোকাই। ছোটলোকদের প্রতিবেশ বা অবস্থান থেকে রনবী-র কার্টুনে চলে এসেছে টোকাই ছোটলোক চরিত্র, থাকে ছোটলোক ভূমিতে। তাকে ভদ্রলোকের ভাষার বিপ্রতীপে দাঁড় করিয়ে দেন রনবী। ভদ্রলোকরা টোকাইয়ের কাছে ‘আপনাগো’, ছোটলোকরা ‘আমাগো’। ছোটলোক বলে নিজেকে সে ‘মানুষ’ বলে না, ‘মানুষ’ তার কাছে একটা ‘ভদ্রলোক’ বিষয়। ক্ষমতাসীনেরা কত রকমের একটেরে প্রকল্প বানায় ‘মাতৃভূমি’ ‘মানুষ’ ‘দেশবাসী’ বা ‘বাঙালি’, ইত্যাদি ইত্যাদি। টোকাই এ সবের বিপরীতে, এক হতে চায় না, অবস্থান বদলও চায় না।
বিশ্লেষণ করতে-করতে পরের অধ্যায় ‘টোকাই একটা আশ্রয়’-এ প্রায় সিদ্ধান্তেই পৌঁছন শুভেন্দু: ‘কার্টুন একটা তৃতীয় ভূমি। সরকারি ক্ষমতার ভূমি, রাজনীতিক দলের আধিপত্যের ভূমির বাইরে আর একটা ভূমি।... কার্টুন এক আশ্রয়, যা করতে ইচ্ছে করে করা যায় না, যা বলা দরকার বলতে পারা যায় না, যা ভাবা প্রয়োজন ভাবা যাচ্ছে না এসবের আশ্রয় কার্টুন।’... একটু পরিসর, এরপর শেষ দু’টি লাইন শুভেন্দুর: ‘রফিকুন নবীর কার্টুন টোকাই বাংলাদেশের মানুষদের আশ্রয়। আমাদেরও।’ |
|
|
|
|
|