পুস্তক পরিচয় ১...
নিজেকে নিয়ে হাসতে ভুলে গিয়েছি
বাঙালির রঙ্গব্যঙ্গচর্চা, সম্পাদনা: চণ্ডী লাহিড়ী। পত্র ভারতী, ২৫০.০০
কাফী খাঁ সমগ্র, প্রথম খণ্ড, সম্পা: বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়, প্রদীপ গরাই। লালমাটি, ৫০০.০০
সদাই মরে ত্রাসে
ওই বুঝি কেউ হাসে।


বাঙালির ফেসবুকে এখন জমিয়ে চলছে এই দু-লাইন। চিরন্তন বঙ্গীয় রামগরুড়েরা পুনর্বার অতিসক্রিয় হয়েছেন। ত্রাস থেকে ছড়াচ্ছে সন্ত্রাস। আর তার ফলে বাঙালির প্রায় শুকিয়ে আসা একটি ঐতিহ্যের মড়ার উপর পড়ছে খাঁড়ার ঘা। ঠিক এমনই এক দারুণ বৈশাখে ফিরে এল বাঙালির রঙ্গব্যঙ্গ চর্চা। সম্পাদক চণ্ডী লাহিড়ী তাঁর ‘কৈফিয়ৎ’-এর শুরুতেই স্পষ্ট লিখেছেন: ‘একটানা তিনশো বছর রঙ্গ-ব্যঙ্গ চর্চার পর নতুন সহস্রাব্দে পা দিয়েই বাঙালি-জীবনে রঙ্গ-ব্যঙ্গ হারিয়ে গেল। সংবাদপত্রে তো কোথাও নেই, সাময়িকপত্র যেগুলি রঙ্গ-ব্যঙ্গ নিয়ে বেঁচে আছে সেগুলিও বড়ই ক্ষণজীবী। সমূহ-বিনষ্টির ঠিক আগে আমাদের রঙ্গব্যঙ্গ চর্চার ধারাটির একটি নির্ভরযোগ্য দলিল তৈরি হওয়া দরকার। এতদিন অসুবিধা ছিল। জাতপাত নিয়ে বা হাস্যরসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সেক্স নিয়ে আলোচনা করলে রক্ষণশীলরা তেড়ে আসতেন। রক্ষণশীলরা আপাতত পরলোকগত হওয়ায় আলোচনা অনেক সহজ হয়েছে।’
অবিশ্যি, অতিসম্প্রতি, নতুন অসুবিধার জন্ম হয়েছে। অপছন্দের ব্যঙ্গ বা ব্যঙ্গকারীকে তেড়ে মেরে ডান্ডা ঠান্ডা করে দেওয়ার নয়া উদ্যোগ শুরু হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে বাঙালির রঙ্গব্যঙ্গ চর্চার এই ছোট সংকলনটি দুটি উপকার ঘটাতে পারে। এক, মৃতপ্রায় এক ঐতিহ্যকে নতুন করে আলোয় আনা। দুই, হাস্যোজ্জ্বল ইতিহাসটিকে সামনে রেখে সহনশীলতার সুবুদ্ধিটিকে জাগিয়ে তোলা। দ্বিতীয়টি ধর্মের কাহিনির অন্তর্গত, আমাদের তাতে বিশেষ হাত নেই। বরং নতুন এই সংকলনে কতটা ধরা গেল সেই ঐতিহ্যকে, দেখা যাক সেটাই।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত থেকে স্বপ্নময় চক্রবর্তী বড় কম সময় ধরেননি সম্পাদক, প্রায় দুশো বছর। এই দুশো বছরে বাঙালির রঙ্গব্যঙ্গ চর্চার পরিচয় দিতে গিয়ে বেছে নেওয়া হয়েছে পঁচিশটি লেখা। তার মাঝে মাঝে বহু লেখা লিখেছেন সম্পাদক নিজে। সে সব লেখার অনেকটাই সংকলিত লেখা ও লেখক প্রসঙ্গে, কিছু বা আপাত অপ্রাসঙ্গিক। লেখার হেডপিস বা টেলপিস তো বটেই, তা ছাড়াও চণ্ডী লাহিড়ীর বহু ‘তীর্যক’ কার্টুন ও স্কেচ ছড়িয়ে আছে পাতায় পাতায়। আছে কয়েকটি পুরনো কার্টুনও। ‘জন্মভূমি’ পত্রিকার অজ্ঞাত শিল্পী, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, বিনয়কুমার বসু, পিসিয়েল বা কাফী খাঁ-র উপভোগ্য (অধুনা বিপজ্জনক) কার্টুনগুলি এই সুযোগে আরও এক বার দেখা হয়ে যায়। কিন্তু বইটি বড় অগোছালো। চ. লা.-র তূণে বাঘা বাঘা তির, কিন্তু তূণটি গুছিয়ে তোলা হয়নি। ঊনবিংশ শতকের আমদানি ভিক্টোরিয়ান শুচিতায় আক্রান্ত নন চণ্ডীবাবু, ফলে বহু তথাকথিত ‘অশ্লীল’ গ্রাম্য ছড়া বা প্রবাদ বাদ দেননি তিনি। নাগরিক ব্যঙ্গের সঙ্গে সেই রঙ্গ আলোচনার একটা ভিন্ন পরিসর তৈরি করেছে। তবে কোনও নিয়ম মেনে রচনাগুলি সাজানো হয়নি। তার সম্পাদকীয় কৈফিয়ৎ, ‘এই গ্রন্থের পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের হলেও যেহেতু একসঙ্গে সব লেখা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি সেজন্য...’। অবশ্য রচনা নির্বাচনে একটা নিয়ম আছে, অপঠিত বা স্বল্পপঠিতের অগ্রাধিকার। তবু কালীপ্রসন্ন সিংহ, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, সুকুমার রায়কে বাদ দিয়ে বাঙালির রঙ্গব্যঙ্গ চর্চা হয় কী করে সেটাও ভাবা দরকার।

“অল কোয়ায়েট...”। ১৯৫৪। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর সরকারি বিধিনিষেধ তথা পুলিশি জুলুম করে প্রতিবাদ দমন।
কাফী খাঁর কার্টুনে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন পুলিশমন্ত্রী কালীপদ মুখার্জিকে দেখা যাচ্ছে। (বই থেকে)
আর একটি কথা, পরের সংস্করণ ছাপবার আগে এক জন সতর্ক গ্রন্থ-সম্পাদককে দিয়ে বইটি দেখিয়ে নেওয়া দরকার। সম্পাদক এক বার বলেছেন উর্দুতে ফাজিল মানে পণ্ডিত, আবার বলেছেন ফার্সিতে ফাজিল মানে পণ্ডিত। আবার পরক্ষণেই বলছেন, পাঠানদের আমল থেকে শব্দটি বাংলায় চলছে। অসঙ্গতিই হাস্যরসের উৎস, কিন্তু তথ্যে এমন অসঙ্গতি মোটে ভাল না। নিখাদ গুল জাতীয় কয়েকটি হাস্যকর ভুল তথ্যও আছে। যেমন, ‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বপ্নপ্রয়াণ লিখলেন। বঙ্গদর্শনে নবপর্যায়ে একটি চিঠি ছাপা হল। ইচ্ছে করেই বঙ্কিম এই চিঠিটা ফেলে না দিয়ে পত্রস্থ করলেন...’। ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা, বঙ্গদর্শন নবপর্যায়ের সঙ্গে বঙ্কিমের কোনও সম্পর্ক নেই, ওটি রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত।
বাবুরাম সাপুড়েদের এই কালে তুলনায় উজ্জ্বলতর উদ্ধার কাফী খাঁ সমগ্র। প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী, পিসিএল আর কাফী খাঁ নামে যিনি একদা বঙ্গ-কার্টুনের দুনিয়া মাতিয়ে রেখেছিলেন, তাঁর সব ধরনের ছবি এবং লেখা খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশের উদ্যোগের এটি প্রথম। ছোটদের পাততাড়ি, খোকার হাতী, রবির আবির্ভাব, দেশবন্ধুর কথা, আশুতোষের গল্প ইত্যাকার নিরীহ নির্দোষের পাশাপাশি এ বইয়ের সবচেয়ে বড় সম্পদ ‘পোলিটিক্যাল কার্টুন’ অংশটি। সংবাদপত্রের লুপ্তপ্রায় পৃষ্ঠা থেকে তারা এই বার একটা সংগ্রহযোগ্য চেহারা পেল, বিশেষ আশার কথা। চল্লিশের ভয়াবহ বস্ত্রসংকট, হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ, খাদ্যসংকট সমাধানে খাদ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের ‘ব্যর্থতা’, ইজরায়েলের জন্ম বিবিধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় ও ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে উপভোগ্য, বুদ্ধিদীপ্ত কার্টুনগুলি এই সময়ের প্রশ্নগুলোকে আরও এক বার উস্কে দেয়।
ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে, ধ্রুপদী সাহিত্যের অনুষঙ্গ এনে কী উপভোগ্য কার্টুন তৈরি করা যায় তার একটি আশ্চর্য উদাহরণ এ বইয়ের তিনশো আটাত্তর পৃষ্ঠায়। বিধানচন্দ্র রায় গালিভারের মতো বপু নিয়ে শুয়ে আছেন, তার উপরে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে কিংবা নাচানাচি করছে লিলিপুটেরা, তাদের কারও কারও হাতে ধরা ব্যানারে লেখা টিচার্স মার্চ, নার্সেস মার্চ, লেফটিস্টস মার্চ। ক্যাপশন ‘গালিভার্স ট্রাবলস’। কিংবা আর একটি, কংগ্রেস সভাপতি অতুল্য ঘোষ হাতে চাকি-বেলন-চাটু নিয়ে গ্রামবাসীদের দিকে ধেয়ে যাচ্ছেন আর হাড়গিলে চেহারার মানুষগুলো পালাচ্ছে। খাদ্যসংকটে রুটি খাওয়া অভ্যেস করতে বলেছিলেন অতুল্যবাবু, তাই এই কার্টুন, যার নাম ‘গমের অভিযান’!
এ সবই, বুদ্ধির এই দীপ্তি, নিজেকে নিয়ে হাসতে পারার ক্ষমতা, কেমন যেন ‘ভ্যানিশ’ করে গেল গত দুই দশকে। বাঙালি এখন বড় স্পর্শকাতর, মাঝেমধ্যেই আসরে নামে বাবুরাম সাপুড়েরা। তবু, হাস্যবিস্মৃত এই সময়েও বাঙালির আত্মবিস্মৃতির অপবাদ কিছুটা ঘোচাবে ব্যঙ্গলেখা ও ছবির এই দু’টি সংকলন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.