ব্যাগ গুছিয়ে...
ক্যাঙারুর দেশে
দিনটা শুরু হয় সমুদ্রের ভেজা মাটিতে দৌড় আর সমুদ্রে সার্ফিং দিয়ে। আর শেষ হয় মধ্যরাতের হুল্লোড়ে।
ক্রিসমাস বা বর্ষবরণের দিন নয়, সারা বছর ধরে এটাই দৈনিক রুটিন, এই শহরের।
কয়েক বছর আগেও মূল ভিড়টা হত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত। তখন বসন্ত আর গ্রীষ্ম সেখানে। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার বিকেল থেকে রবিবার রাত পর্যন্ত শহরটা মেতে থাকত হুল্লোড়ে। এখন বছরের ৩৬৫ দিনই রাতে মাত্র চার ঘণ্টা ঘুমোয় শহরটা।
নামটা যখন প্রথম শুনি মনে হয়ে ছিল অরণ্যদেবের কাহিনির সোনাবেলার সমুদ্রতটের কথা। সেটা ছিল হনিমুন কাটানোর আদর্শ জায়গা। বালিতে নাকি মিশে থাকত সোনার কণা। সেই বালি সারা গায়ে মেখে নিলে অনন্ত যৌবন! তবে অরণ্যদেবের কাহিনির সোনাবেলা আফ্রিকার কোনও সমুদ্রতট। আর এই কাহিনির সোনাবেলা বা গোল্ডকোস্ট অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের একটি প্রমোদশহর।
কুইন্সল্যান্ডের মূল শহর ব্রিসবেন থেকে ঘণ্টাখানেকের যাত্রা। আগে স্রেফ প্রমোদশহর হিসেবেই পরিচিত ছিল। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরের শহরটি এখন অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এলাকা। পর্যটক ছাড়াও বিভিন্ন বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থার কনফারেন্সের জন্য অন্যতম প্রিয় শহর এখন এটি। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত শু্যটিং সুটও বটে।
সমুদ্রের বুকে যাঁরা ভেলায় নিজেদের ছেড়ে দিয়ে আপনমনে ভাসতে ভালবাসেন, কিংবা সমুদ্রে ঢেউয়ে চড়ার রোমাঞ্চ (সার্ফিং) অনুভব করেন, নৌকো চালাতে পছন্দ করেন, তাঁদের কাছে গোল্ডকোস্ট স্বর্গ। ট্যুরিজম অস্ট্রেলিয়ার সব প্রচারপত্রে গোল্ডকোস্টের পরিচিতি ‘সার্ফার্স প্যরাডাইস’ হিসেবে। সমুদ্র এখানে সারা বছর খুব শান্ত। বালুকাবেলায় সকাল সাতটা থেকেই সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে। সন্ধ্যা হতে হতে সাতটা। পাক্কা ১২ ঘণ্টার জন্য সমুদ্র উন্মুক্ত সবার জন্য। টোকিওর নাচাতা, দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক ইয়ং, স্পেনের আর্মান্দো কিংবা নেদারল্যান্ডসের জো-পল দের কাছে গোল্ড কোস্টের আকর্ষণ সারা বছরের। নাচাতা বলছিলেন, “আমার প্রথম পছন্দের সমুদ্র শহর কিন্তু এটাই।”
কিন্তু নামটা গোল্ডকোস্ট কেন? অরণ্যদেবের কাহিনির সোনাবেলার সমুদ্রতীরের মতো এখানেও কি বালিতে সোনার টুকরো পাওয়া যায়? কিংবা হলদেটে বালি সূর্যের আলোয় সোনার মতো জ্বলজ্বল করে বলেই এই সমুদ্রতটের নাম এমনটা? নাকাতা, পার্ক, আর্মান্দোরা তা জানেন না।
তবে কুইন্সল্যান্ড পর্যটন দফতরের গ্রেগ ক্লয়েডের বিশ্লেষণ, “এখানে জমির দাম গত কয়েক বছরে যে ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে যা সোনার দামকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাই এলাকার নাম গোল্ডকোস্ট। নামটা এখানকার সাংবাদিকদেরই দেওয়া।”
গ্রেগের কথার সূত্র ধরে গোল্ডকোস্ট পর্যটন সংস্থার পক্ষে লিডিয়া ল্যাটিমার-এর মন্তব্য, “বিশ্বের সব নামকরা হোটেল সংস্থা এখানে নিজেদের ব্যবসা বাড়াচ্ছে। দিনকে দিন নতুন নতুন হোটেল সংস্থা আসছে। তাদের জন্য জমির ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। গোল্ডকোস্টের পরিধি বাড়চ্ছে। আর তাই জমির দাম বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে।”
একটি ফরাসি হোটেল সংস্থা ২৩ তলার পাঁচতারা হোটেল তৈরি করেছে গোল্ডকোস্টের সমুদ্রতীরে। প্রতিটি ঘর থেকেই দেখা যায় সমুদ্র। তাদের ওই হোটেলের জনসংযোগ ম্যানেজার ববি ক্যাকেটা বললেন, “আগে শুধু পর্যটকেরা আসতেন। এখন পর্যটন শিল্পের শো-কেস গোল্ডকোস্ট। তাই বিভিন্ন দেশের আধিকারিকরা আসছেন। সিনেমার শুটিং হচ্ছে। বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা নিজেদের কাজের জন্য বেছে নিচ্ছে এই সমুদ্রতটকে।” ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে ওই হোটেলে তাই ঠাঁই নেই। ইতালির একটি সংস্থাও বিশাল হোটেল তৈরি করেছে এখানে। দিনে সওয়া লাখ টাকা খরচ করেও এখানে থাকছেন পর্যটকেরা। “হোটেলব্যবসার পাঠ নিতে অনেক সংস্থাই এখন লোক পাঠাচ্ছে গোল্ডকোস্টে,” মন্তব্য গ্রেগ ক্লয়েডের।
ব্রিসবেন শহরের শহরতলি হিসেবে গড়ে ওঠা গোল্ডকোস্ট এখন নিজেই একটি পরিপূর্ণ শহর। শহরের নিজস্ব পুলিশ প্রশাসন রয়েছে। রয়েছে জনগণকে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আলাদা আলাদা দফতর। শহরে প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ। প্রকাশ্যে সিগারেট খান না কেউ। নীল সমুদ্র, ২২-২৩ তলা বাড়ির মাঝে মাঝে সবুজ মাঠ। পাম গাছের ছড়াছড়ি শহরতলিটায়। আর এই সব গাছে সারা দিন খেলে বেড়ায় প্যারাকিটেরা। লাল-সবুজ-কালো-বেগুনি রঙের টিয়া জাতীয় পাখিগুলির জন্য দিনের বেলাটা রঙিন হয়ে থাকে শহরটা। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যায় প্যারাকিটেরা। শহরকে আলোকিত করে রঙ-বেরঙের নিয়নের আলো। সমুদ্রের ধারটা ছাড়া সারা শহরটাই উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করে পুরো রাত।
কিন্তু পরিবার নিয়ে গেলে ছেলেমেয়েরা কি তেমন মজা পাবে ওই সমুদ্রতটে?
সমুদ্র একঘেয়ে হয়ে গেলে তার দাওয়াইও রয়েছে। ব্রিসবেন ও গোল্ডকোস্টের মাঝে তৈরি হয়েছে বিনোদনকেন্দ্র ড্রিমওয়ার্ল্ড। সেখানে নানা ধরনের রোমাঞ্চকর খেলা রয়েছে। রয়েছে নানা ধরনের বন্যপ্রাণীকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ। দেখা যাবে কী ভাবে পোষ মানা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার দিব্যি ওঠাবসা করছে মানুষের সঙ্গে। মানুষের নির্দেশে গাছের ডালে রাখা মাংসের টুকরো লাফিয়ে পাড়ছে কিংবা লাফ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে পরিখা। মানুষের উপস্থিতি মোটেই বিরক্তি উৎপাদন করছে না ওদের।
আমাদের দেশে কোনও বন্যপ্রাণীকে এ ভাবে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। সরকার নিয়ন্ত্রিত চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কোথাও রাখা নিষেধ বাঘ-সিংহের মতো মাংসাশী প্রাণীদের। ও দেশে এ সবের পাট নেই। সব চিড়িয়াখানাগুলিই বেসরকারি। আর পর্যটনের স্বার্থে বাঘ ও অন্য পশুদের নিয়ে খেলা দেখাতে পারে যে কেউ-ই।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.