রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধের একটি বিশেষ পুরস্কার প্রতি বছর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মনমোহন সিংহের সরকার। এই পুরস্কার কাকে দেওয়া হবে, তা ঠিক করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি শীর্ষ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির অন্যতম দুই সদস্য হলেন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী। এখানেই শেষ নয়। প্রধানমন্ত্রী রাজ্যসভা ও লোকসভায় বিরোধী দলের দুই নেতা সুষমা স্বরাজ এবং অরুণ জেটলিকেও কমিটির বাকি দুই সদস্য হিসেবে মনোনীত করেছেন।
এই কমিটির প্রথম বৈঠক এখনও হয়নি। তবে কমিটির সদস্যরা অনেকেই মনে করছেন, এই পুরস্কারের প্রথম প্রাপক এমন কেউ হোন, যিনি আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধকে বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাতে গোটা দুনিয়ার কাছে রবীন্দ্রনাথের নামাঙ্কিত একটি সম্মানের মাধ্যমে শান্তি এবং মৈত্রীর বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারবে ভারত।
এই আন্তর্জাতিক সম্মান প্রদানের সিদ্ধান্ত যেমন সম্পূর্ণ অভিনব, তেমনই বিজেপির দুই সংসদীয় নেতাকে এমন একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় রেখে মনমোহন সিংহ সচেতন ভাবে একটি রাজনৈতিক বার্তা দিতে চেয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকে। তা হল, রাজনৈতিক ঐকমত্যের বার্তা।
প্রশাসন পরিচালনার জন্য বেশ কিছু সাংবিধানিক পদ মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন কমিটিতে বিরোধী নেতাদের রাখা হয়। কিন্তু তার বাইরে এ ধরনের কমিটিতে বিরোধী নেতাদের রাখাটা বাধ্যতামূলক নয়। সে ক্ষেত্রে অরুণ জেটলি ও সুষমা স্বরাজকে সামিল করে আসলে কী বার্তা দিতে চেয়েছেন মনমোহন?
কংগ্রেস সূত্র বলছে, জোটধর্ম রাখতে গিয়ে মনমোহন-সরকার শরিকদের চাপের কাছে বারবার নতিস্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে। সরকার বাঁচাতে গিয়ে আর্থিক সংস্কার থেকে শুরু করে কোনও কঠোর অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তই যে নেওয়া যাচ্ছে না, সে কথা কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা কৌশিক বসুও কবুল করেছেন। আমেরিকাও সম্প্রতি ভারতের পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে একই ধরনের
কথা বলেছে।
দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আসন্ন। রাষ্ট্রপতি পদে নিজেদের প্রার্থীকে জেতাতে গেলে কংগ্রেসের প্রয়োজন আঞ্চলিক দলগুলির সমর্থন। এই অবস্থায়, বিরোধী দল বিজেপির সঙ্গে সংঘাতের আবহকে একটু লঘু করে দুই বৃহৎ জাতীয় দলের মধ্যে ঐকমত্য রচনায় উৎসাহী হয়েছেন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। যদি বিজেপির সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করা যায়, তবে বহু ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণে সুবিধা হতে পারে। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে কংগ্রেসের বিপযর্য়ের পর মনমোহনের এই উদ্যোগ আরও বেড়েছে।
কংগ্রেসের একটা অংশ অবশ্য এখনও মনে করে যে, বৃহৎ দলকে সঙ্গে রাখার ব্যাপারে মনমোহন সিংহের এই প্রচেষ্টা ভাল, কিন্তু বিজেপি কি তাতে সাড়া দেবে?
নাকি তারাও আঞ্চলিক দলগুলিকে উস্কে কংগ্রেসকে দুর্বল করে ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইবে?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নরেন্দ্র মোদীর ট্যুইট করা কি তারই লক্ষণ নয়?
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনুরাধা চেনয় বলেন, “সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নয়, জোট রাজনীতির কল্যাণে এখন কেন্দ্রের থেকে কে কতটা আদায় করে নিতে পারে সেটাই প্রধান হয়ে উঠেছে! এ এক বিপজ্জনক প্রবণতা। এই প্রবণতা কেন্দ্রকে দুর্বল করে দিলে কিন্তু সমস্যা বাড়বে বই কমবে না।”
মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনগুলিতে আঞ্চলিক দলগুলির মুখ্যমন্ত্রীরা কিন্তু এই ধরনের যুক্তিকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, কংগ্রেসের অবিচারের জন্যই যুক্তরাষ্ট্রীয় দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে হচ্ছে। এমনকী কিছু ক্ষেত্রে প্রাপ্য সম্মান না পাওয়ারও অভিযোগ তুলেছেন অনেকে। যেমন ক’দিন আগে ভারত সফরে আসা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির সঙ্গে তাঁর মধ্যাহ্নভোজের আসরে বিজেপির শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানান প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে তৃণমূল বা অন্য কোনও জোট শরিককে আমন্ত্রণ জানাননি তিনি। সে দিনও এই ঘটনায় তৃণমূলের নেতাদের অভিযোগ ছিল, কংগ্রেস বিজেপিকে ডাকে, অথচ শরিকদের পাত্তা দেয় না! তাঁরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, এত বড় একটা কূটনৈতিক ঘটনায় শরিকদের কেন ডাকা হবে না?
রবীন্দ্রনাথের নামে আন্তর্জাতিক সম্মান দেওয়ার কমিটিতেও শরিক-প্রতিনিধি নেই। তার বদলে লোকসভা এবং রাজ্যসভার দুই বিরোধী নেতাকে সামিল করে প্রধানমন্ত্রী কি ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার দ্বিমেরুকরণকেই গুরুত্ব দিতে চাইলেন? |