কৌশিকের কথা মেনেও মমতার মুখাপেক্ষী কেন্দ্র
সংস্কারে বাধা জোটধর্ম, কবুল আর্থিক উপদেষ্টার
জোট রাজনীতির জটেই যে আটকে রয়েছে আর্থিক সংস্কার এবং সে কারণে এই সরকারের আর কিছু করার জো নেই, আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে সে কথাই কবুল করলেন কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু।
তাঁর এই মন্তব্য ঘিরে ঘরোয়া রাজনীতিতে প্রবল আলোড়ন তৈরি হয়। ফলে কৌশিকবাবু পরে ব্যাখ্যা দিয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে বিতর্ক থামেনি। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে সব থেকে বড় অভিযোগ, নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত দ্বিধাগ্রস্ত। খুচরোয় বিদেশি লগ্নি থেকে পণ্য পরিষেবা ও প্রত্যক্ষ কর বিধি চালু, সব ক্ষেত্রেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ শরিক ও বিরোধীদের বাধায় হোঁচট খেতে হয়েছে সরকারকে। কৌশিকবাবুর বক্তব্য সেই বিষয়টিকেই আর এক বার উস্কে দিল। প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এই মন্তব্যকেই সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণের আর একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। উল্টো দিকে, কংগ্রেস নেতারা এর মোকাবিলা করতে গিয়ে জানিয়েছেন, সরকার সংস্কারের পথ থেকে সরেনি। এমনকী, যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়াও মনে করেন, ২০১৪ সাল পর্যন্ত কোনও সংস্কার হবে না এমন ধারণা করার কোনও কারণ নেই। তবে মুখে সংস্কার জারি রাখার কথা বললেও ঘরোয়া ভাবে কিন্তু কৌশিকবাবুর বক্তব্যের সারবত্তা মেনে নিচ্ছে কংগ্রেস।
গত বুধবার আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনে কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এ যখন কৌশিকবাবু এই বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন প্রণব মুখোপাধ্যায়ও সে দেশে ছিলেন। অনেকেই মনে করছেন, সারসত্যটাই বলে দিয়েছেন কৌশিকবাবু। কারণ, তিনি রাজনীতিক নন, শিক্ষাবিদ। তাঁর পক্ষে এ কথাটা যত সহজে বলা সম্ভব, কংগ্রেস নেতাদের পক্ষে তা নয়। এবং সেটা যে নয়, তা বোঝা গিয়েছে এই বিতর্কের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন স্তরের কংগ্রেস নেতাদের সাফাই থেকেও। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া যেমন বলেছেন, “জোট রাজনীতিতে এমনটা (সংস্কারের গতি কমে যাওয়া) হতেই পারে।” একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, সংস্কার যে একেবারে হয়নি, তা নয়। একাধিক উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, “মেঘ যেমন আছে, তেমনই সূর্যের আলোও আছে।”
অহলুওয়ালিয়াও জানিয়েছেন, কিছু কাজ হয়েছে। কিছু কাজ হওয়ার পথে। তাঁর বক্তব্য, “আমি মনে করি না যে, ২০১৪ সালের আগে কিছু হবে না।”
মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টার এই বক্তব্য কিন্তু ঘরোয়া আলোচনায় অস্বীকার করতে পারছে না কংগ্রেস। প্রধান শরিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতেই যে সংস্কারের বহু সিদ্ধান্ত আটকে রয়েছে, সে কথাও কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের অজানা নয়। সম্প্রতি মার্কিন বণিকসভা ইউএস-ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিলের বক্তব্যেও এই বিষয়টি উঠে এসেছে। হোয়াইট হাউসের কাছে তাঁরা যে গোপন মেমোটি পাঠিয়েছেন, সেখানে বলা হয়েছে, আঞ্চলিক নেতানেত্রীদের দাপটে দিল্লির সরকার অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিধায় ভুগছে। এবং এমন পদক্ষেপ করছে, যাতে বিনিয়োগের পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে। তাঁদের সেই মেমো থেকে স্পষ্ট, বড় বাজার সত্ত্বেও ভারত সম্পর্কে মোহভঙ্গ হচ্ছে তাঁদের। কৌশিকবাবুর কথাতেও যেন প্রকারান্তরে তারই সুর।
যা নিয়ে বিতর্ক
ওয়াশিংটনে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু বলেছেন, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে সংস্কারের সম্ভাবনা নেই। কারণ, শরিকি বাধা, লাল ফিতের ফাঁস ও ক্রমাগত দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার আবহে আমলাদের অতি-সাবধানতা।
কৌশিক বসুর ব্যাখ্যা
আমার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। বলতে চেয়েছি:
শরিকি গণতন্ত্রে সংস্কার ও নীতি-নির্ধারণ শ্লথ হয়ে পড়েছে। এক দলীয় সরকার হলে এই সমস্যা হত না। আগামী ভোটে যদি এক দলের সরকার হয়, তবে তারা সংস্কার এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ইউরোপীয় ব্যাঙ্কগুলি যে ১.৩ লক্ষ কোটি ডলার ধার করেছে, তা শোধ করার সময়, অর্থাৎ ২০১৪-এ আবার বিশ্বজোড়া মন্দা হতে পারে। সেই সমস্যা কাটলেই ভারতের অর্থনীতি চিনের থেকেও বেশি গতিতে বৃদ্ধি পাবে।
থমকে থাকা সংস্কার
• বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির দরজা খোলেনি।
• প্রতিরক্ষায় বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি।
• থমকে রয়েছে বিমা ও ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের সংস্কার।
• এখনও আটকে পণ্য-পরিষেবা কর ও প্রত্যক্ষ কর বিধি।
কংগ্রেস নেতৃত্ব এ সবই জানেন। আবার এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি, তাতে তাঁদের পক্ষে মমতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। বরং মমতাকে আরও সময় দেওয়ারই পক্ষপাতী তাঁরা। দল মনে করছে, যে রাজনৈতিক অবস্থান থেকে লড়াই চালিয়ে তৃণমূল নেত্রী ৩৪ বছরের বামশাসন শেষ করে ক্ষমতায় এসেছেন, রাতারাতি তাঁর পক্ষে সেই অবস্থান বদল করা সম্ভব নয়। এ জন্য তাঁকে সময় দিতে হবে। তাই এই মুহূর্তে মমতা সংস্কারে সায় না দিলেও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এখনও তাঁর সঙ্গে জোট বেঁধে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে কংগ্রেস নেতৃত্বের মত। আগামিদিনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও মমতার সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে কংগ্রেসের কাছে। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজ্য রাজনীতিতেও ‘একলা চলো’ নীতি নিয়ে লাভ হবে না বলেই দিল্লি কংগ্রেসের মত।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সিপিএম ও কংগ্রেসের মূল্যায়ন হুবহু এক। বিমান বসু-সূর্যকান্ত মিশ্ররা যেমন মনে করছেন, মমতার কার্টুন বা সংবাদমাধ্যমের উপর ফতোয়া নিয়ে যাবতীয় বিতর্ক শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যেই আটকে থাকছে। গ্রামে মমতার জনপ্রিয়তায় এখনও টোল পড়েনি। একই ভাবে কংগ্রেসও মনে করছে, গত দশ মাসে মমতার যদি জনপ্রিয়তা কমেও থাকে, তাতে সিপিএম বা কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা বাড়েনি। কংগ্রেসের শহুরে ভোট এবং সিপিএমের গ্রামীণ ভোটে ভাগ বসিয়েই ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। এখন আবার সেই ভোট যার যার কাছে ফিরে এসেছে, এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়। আগামী জুন মাসে রাজ্যের ছ’টি পুরসভায় নির্বাচন। মমতার জনসমর্থনে ধস নেমেছে কি না, সেটা তার ফল থেকেও যাচাই হবে না। তা ছাড়া রাজ্যে কংগ্রেসে নেতৃত্বের সঙ্কটও রয়েছে। সরকার থেকে বেরিয়ে এলে সে ক্ষেত্রে দলে ভাঙনও ধরতে পারে।
তা হলে সংস্কারের কী হবে? কংগ্রেস মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারি বলেন, “আর্থিক সংস্কারকে বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দেখতে হবে। আমেরিকা-ইউরোপে মন্দা এখনও কাটেনি। সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের সংসদের দুই কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতাও নেই।” বিজেপির কিন্তু পাল্টা অভিযোগ, মনমোহন-সরকার আসলে ঐকমত্য গড়ে তোলার কৌশলটাই হারিয়ে ফেলেছে। অরুণ জেটলির যুক্তি, “শুধু শরিক নয়, বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলি সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব নিয়ে বিরোধী দলকেও চটিয়ে দিচ্ছে এই সরকার।” জবাবে মনীশ বলেন, “মমতা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ শরিক। আমরা আশা করি, সংস্কারের ভাল দিকগুলি সম্পর্কে আমাদের শরিকরাও অবহিত।” জেটলি আবার জানিয়েছেন, জোট-সরকারের বাধ্যবাধকতাই একমাত্র কারণ নয়। এক দিকে সনিয়া গাঁধী, অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী দু’টি ক্ষমতার কেন্দ্র তৈরি হওয়াতেই সিদ্ধান্তহীনতা দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্রের মন্ত্রীরাও শুধু আগামী লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত সরকারকে টিকিয়ে রাখার কাজই করে যাচ্ছেন।
কংগ্রেসের সমস্যা হয়েছে, কৌশিকবাবুর বক্তব্যকে তাঁরা পুরোপুরি খারিজও করে দিতে পারছে না, আবার একেবারে সমর্থনও করতে পারছে না। কংগ্রেসের তরফে তাই যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, বিমা, পেনশন বা ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে আর্থিক সংস্কারটাই একমাত্র সংস্কার নয়। খাদ্য সুরক্ষা বিল বা সকলের জন্য শিক্ষার বন্দোবস্ত করাটাও সংস্কারের কর্মসূচি। গত আট বছর ধরে মনমোহন-সরকার সেই সংস্কারের পথ থেকে সরে আসেনি। সংবাদমাধ্যমের একাংশ জানিয়েছে যে, কৌশিক বসু বলেছেন, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে সংস্কারের পালে হাওয়া লাগবে।
কিন্তু আজ বিতর্কের মুখে তিনি জানান, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে সংস্কারের কোনও সম্পর্ক তিনি তুলে ধরেননি। ২০১৪ সালটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ইউরোপ তথা গোটা বিশ্বে ওই বছর আর এক দফা মন্দার ধাক্কা আসতে পারে। সেই মন্দা কেটে গেলে ভারতের অর্থনীতি চিনের থেকেও বেশি গতিতে বৃদ্ধি পাবে। তবে জোট-সরকারের বাধ্যবাধকতার জন্য যে সংস্কারের গতি রোধ হয়েছে, সেই অবস্থান থেকে সরছেন না কৌশিক।
আর সেটাই বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির নির্যাস।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.