হাসপাতাল চত্বরেই ম্যারাপের তলায় আট-দশটা ইটের উনুনে গনগনে আগুন। তাতে বসানো প্রকাণ্ড সব হাঁড়িতে বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে। পাশে সার দিয়ে বসানো ওই রকম আরও প্রায় দেড়শো হাঁড়ি। সারা দিন ধরে রান্না চলবে। কাঠের জালে রান্না হওয়ায় গলগল করে ধোঁয়া উঠছে। পাশেই রাস্তার দু’পাশে পসরা নিয়ে বসে দোকানিরা। ফুল, আলোর মালা, রঙিন কাপড় দিয়ে মঞ্চ সাজানো হয়েছে। বসানো হয়েছে সাউন্ডবক্সও। কোনও অনুষ্ঠানবাড়ি নয়, এ ছবি রাজ্যের একমাত্র সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল এসএসকেএমের। বুধবার থেকেই ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে এমন ভূরিভোজের আয়োজনে ধোঁয়ার কুণ্ডলী জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ছে ওয়ার্ডের ভিতরেও। অগ্নি-বিধিকে থোড়াই কেয়ার করে খাস হাসপাতাল চত্বরেই এমন কর্মকাণ্ড চললেও ‘বারণ’ করার কেউ নেই। অথচ, হাসপাতাল চত্বরে রান্নার অনুমতি দেওয়া তো দূরে থাক, কাছাকাছি দূরত্বে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থাকার ফলে উনুন জ্বেলেও রান্নায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
আমরির অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতি এখনও টাটকা। তার পরেই হাসপাতালে অগ্নি-বিধি নিয়ে সতর্ক হওয়া স্বাস্থ্য দফতর বিয়েবাড়ির আসর বসানোর জন্য কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছিল বিধাননগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। সেখানেও হাসপাতাল চত্বরে ম্যারাপ বেঁধে রান্নাবান্না চলছিল। চলেছে হাসপাতাল থেকে তার টেনে বিদ্যুৎ নেওয়াও। সরকারি হাসপাতালে অনুষ্ঠান করা যাবে না বলে সেই সময়েই জানিয়ে দেন রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী। তাতে যে লাভ খুব একটা হয়নি, এসএসকেএমের এই ঘটনাই তা প্রমাণ করল বলে স্বাস্থ্য দফতরের একাংশ মনে করছেন। |
এই এসএসকেএমে অতীতে একাধিক ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। শেষ ঘটনাটি ঘটে মাসখানেক আগে। গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি আউটডোরে এসি মেশিন থেকে আগুন ও ধোঁয়া বেরোতে থাকায় নিউ ক্যাজুয়ালটি ব্লকের ইন্ডোরে ভর্তি রোগীদেরও আতঙ্কে বাইরে বার করে আনা হয়। তার পরেও অবশ্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে হাসপাতাল চত্বরের মধ্যে সার সার উনুন জ্বালিয়ে এবং নিয়ম ভেঙে হাসপাতাল থেকে বিদ্যুতের তার টেনে আলো জ্বালাতে কোনও সমস্যা হয়নি। অসুবিধা হয়নি সাউন্ডবক্স বসিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করার ক্ষেত্রেও।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, এসএসকেএম-সহ রাজ্যের কোনও সরকারি হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজের কিন্তু দমকলের কোনও ছাড়পত্র নেই। অতীতেও কোনও দিন ছিল না। আমরির ঘটনার পরেও এই ছাড়পত্রের ব্যাপারে স্বাস্থ্য দফতর আগ্রহী হয়নি। দমকলের ছাড়পত্র নেই বলে গত প্রায় তিন মাস ধরে রাজ্যের অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোম, ল্যাবরেটরির লাইসেন্স নবীকরণ স্বাস্থ্যভবন থেকে করা হচ্ছে না, অথচ সরকারি হাসপাতালের ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। প্রত্যেক মাসে হাসপাতালে যে ‘ফায়ার ড্রিল’ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা-ও কথার কথা হয়েই থেকে গিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতেই এসএসকেএমে অনুষ্ঠানের আয়োজন। যার জন্য মেন ব্লকের পাশের রাস্তায় কোনও অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়াতে পারছে না। উনুনের ধোঁয়া গলগল করে ঢুকছে মেন ব্লক ও ডার্মাটোলজি ভবনের বিভিন্ন তলায়। সমস্যা হচ্ছে রোগী ও তাঁদের পরিজনেদের।
এত কিছু হচ্ছে আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিছুই জানেন না? তাঁরা কী করে এর অনুমতি দিলেন? অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্র জানালেন, অনুষ্ঠানের আয়োজকেরা অনুমতির জন্য এসেছিলেন, কিন্তু তিনি অনুমতি দেননি। তাঁর কথায়, “ওঁরা বিদ্যুতের সংযোগও চাইলেন। আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছিলাম, হবে না। জেনারেটর বসিয়ে ওঁরা যেন আলাদা ভাবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেন।” তার পরেও কী করে হাসপাতাল থেকে তার টেনে সকলের চোখের সামনেই বিদ্যুৎ নেওয়া হল? হাসপাতাল চত্বরে উনুন জ্বালিয়ে রান্নাই বা হতে দেওয়া হচ্ছে কেন? প্রদীপবাবুর উত্তর, “অনেক দিন থেকেই এমন হচ্ছে। আমরা বাধা দিতে পারি না। তা হলে সমস্যা হবে।” স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “আমি তো এত কিছু জানতামই না। হাসপাতালে এ ভাবে রান্না কখনওই হতে পারে না। আমি খবর নিচ্ছি।” |