মন্ত্রীর ছেলের বিয়ে। পরিচিত নেতাকে নিমন্ত্রণ করার ইচ্ছে। কিন্তু সেই নেতা তত দিনে দল ছেড়ে দিয়েছেন। সামাজিক অনুষ্ঠান হলে কী হয়, দল বলে কথা! তবুও সেই নেতাকে ফোন করলেন মন্ত্রী। বললেন, ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী আসবেন। সেখানে ওই নেতাকে আসতে বলার ‘একটু অসুবিধা’ আছে। নেতা যদি আলাদা করে বাড়িতে আসেন, ‘বাধিত’ হবেন!
তরুণ সাংসদের বিয়ে। নতুন জীবন শুরু করার সময় তিনি প্রণাম করতে চান রাজনৈতিক ‘গুরু’কে। কিন্তু ‘গুরু’ তখন দলছাড়া। তাঁকে পারিবারিক কোনও অনুষ্ঠানে ডাকা যাবে না। দলের ‘রীতি’। মনের ইচ্ছা মনেই রেখে বিয়ে সেরে নিলেন সাংসদ। অনুষ্ঠান আলো করে রইলেন দলের নেতা-মন্ত্রীরা।
‘পরিবর্তনে’র পশ্চিমবঙ্গ নয়। আবার খুব বেশি অতীতও নয়। এ সব উদাহরণ ‘প্রগতিশীল’ বামফ্রন্ট জমানার! দলের নাম সিপিএম!
সিপিএমকে ‘সামাজিক’ ভাবে এড়িয়ে চলার জন্য তৃণমূল মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ‘ফরমান’ নিয়ে হইচই হচ্ছে যে রাজ্যে, সেখানে এমন উদাহরণ অগুনতি। যেখানে কমিউনিস্ট-সুলভ ‘শৃঙ্খলা’ শৃঙ্খলের মতো বেঁধে ফেলেছিল সিপিএম নেতা-কর্মীদের ‘সামাজিক স্বাধীনতা’কে। সামাজিক-পারিবারিক অনুষ্ঠানে কাকে ডাকবেন, কাদের সঙ্গে ‘সম্পর্ক’ রাখবেন, কাদের আমন্ত্রণে ‘সাড়া’ দেবেন সবই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে দলের দ্বারা। মানবমুক্তির কথা বলে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরাই সামাজিক-পারিবারিক জীবনে ‘মুক্ত’ মেলামেশা করতে পারেননি! ‘বেছে’ নিতে হয়েছে। প্রেমের সম্পর্ক গড়ার আগেও দেখতে হয়েছে, কোন প্রেম ‘অনুমোদিত’। কোনটা তা নয়!
সেই ‘শৃঙ্খলে’র জন্ম কমিউনিস্ট পার্টির জন্মলগ্ন থেকেই। কথিত, কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজনের সময় পি সি জোশীর সঙ্গে সুশোভন সরকারের বিরোধ বেধেছিল ‘দলতন্ত্রে’র প্রভাব সর্বত্র প্রসারিত হওয়া নিয়েই। সিপিআইয়ে একই সমস্যা তৈরি হয়েছিল ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের সঙ্গে। আবার বঙ্গ রাজনীতির পুরনো কিস্সায় কথিত, নাট্যকার-অভিনেতা শম্ভু মিত্রের সঙ্গে কংগ্রেস নেতা অজয় মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের মেয়ে কল্যাণী মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্কের কণ্ঠরোধ করেছিল দলীয় ‘অনুশাসনে’র নিগড়ই (যদিও সিপিআই নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন অজয়বাবুর এক ভাই)। অজয়-বিশ্বনাথ দু’জনে থাকতেনও একই বাড়িতে। |
ঘটনাচক্রে, কল্যাণীর বিয়ে হয়েছিল পুরোদস্তুর কংগ্রেসি পরিবারেই! তাঁর স্বামী মোহন কুমারমঙ্গলম। যাঁর পিতা ছিলেন অবিভক্ত মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কংগ্রেস সভাপতি।
রাজ্যেরই এক প্রবীণ বাম নেতার কথায়, “সমাজ, পরিবার, ব্যক্তি জীবন সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার যে প্রবণতা কমিউনিস্ট পার্টিতে দীর্ঘ দিন চালু থেকেছে, তার আমদানি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। স্তালিনের দল চালানোর পদ্ধতিকে ধ্রুব সত্য বলে মনে করে এ দেশেও সেই রীতিই মেনে চলা হয়েছে। কেউ কমিউনিস্ট হলেই তার আর অন্য কোনও সত্তা নেই এই বিশ্বাস তৈরি করা হয়েছে সেখান থেকেই। কমিউনিস্ট হলে ধর্মবিশ্বাস রাখা যাবে না, এক দিক থেকে ভেবে দেখতে গেলে তা-ও কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী।” তাঁর বক্তব্য, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হলে বিয়ে করতে গেলেও দলের ‘অনুমোদন’ নিতে হবে, এই ‘অনুশাসন’ প্রায় বিনা প্রশ্নেই মেনে চলা হয়েছে সিপিএম বা সিপিআইয়ে! তবে সিপিএমের রাজ্য কমিটির এক সদস্যের বক্তব্য, “বিয়ে করতে অনুমোদন নিতে হয়, এটা একটা ‘মিথ’। আসলে দলকে জানাতে হয়। এক কমরেড ব্যক্তিসত্তা থেকে পারিবারিক সত্তায় গেলেন, এটা দলের গোচরে আনতেই এই রেওয়াজ। এর মানে এই নয় যে, দল পাত্রীও ঠিক করে দেয়!”
অধুনা সিপিএম সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট যেমন তাঁর পাত্রী নির্বাচনের পরে প্রথামাফিক দলকে ‘অবহিত’ করেছিলেন। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য জানাচ্ছেন, প্রকাশ ও বৃন্দা কারাট (অধুনা পলিটব্যুরো সদস্য) দলকে জানিয়েছিলেন, তাঁদের বিবাহোত্তর জীবন ‘দলের স্বার্থে’ই পরিচালনা করবেন! দলের মধ্যেই কথিত, ‘সচেতন ভাবে’ই কারাট-দম্পতি সন্তান নেননি। আবার দলের মধ্যেই তামাশা আছে, কারাট-পরিবারের রাতের মেনু ঠিক করতেও নাকি ‘ঘরোয়া পলিটব্যুরো’র বৈঠক বসে! ‘দলের স্বার্থে’ই রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু শেষ পর্যন্ত অকৃতদার রয়ে গেলেন কি না, তা নিয়েও সিপিএমের অন্দরে নানা জল্পনা!
বিলিতি শিক্ষায় শিক্ষিত প্রকাশ-বৃন্দারা অনেক কিছুই সহজে পেরেছেন। পাশ্চাত্য শিক্ষার ‘উদারতা’ থেকেও তাঁর পূর্বসূরিরা যার অনেক কিছুই পারেননি। জোশীদের দৃষ্টান্ত সে কথাই বলে। আবার এই একুশ শতকেও পুরনো আমলের সেই ‘সঙ্কীর্ণতা’ অনেক ক্ষেত্রেই ছায়া ফেলেছে। উদাহরণ সমীর পূততুণ্ড। সিপিএমেরই একটি সূত্রের বক্তব্য, সমীরবাবু দল ছেড়ে পিডিএস গঠন করার পরে তাঁর দাদা (দক্ষিণ ২৪ পরগনা সিপিএমের নেতা) সঞ্জয় পূততুণ্ডের উপরে দলীয় স্তরে ‘চাপ’ সৃষ্টি করা হয়েছিল ব্যক্তিগত সম্পর্ক না-রাখার জন্য। ঘটনাচক্রে, সমীরবাবুর জীবনসঙ্গিনী অনুরাধা দেবও সেই সিপিএম করার সময় থেকেই তাঁর সঙ্গে আছেন!
এক প্রাক্তন বাম সাংসদের ব্যাখ্যা, “বাইরে থেকে যেমন ভাবা হয়, ব্যাপারটা তেমন দমবন্ধ-করা নয়। এই অনুশাসনের যখন শুরু, তখন কমিউনিস্টদের একসঙ্গে কমিউনে থাকতে হত। পার্টি অনেক ছোট ছিল। তা ছাড়া, ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ মেনে চলারও একটা ঝোঁক ছিল। সেই প্রেক্ষিতের সঙ্গে বর্তমান যুগ মেলে না।” সিপিআইয়ের বর্ষীয়ান নেতা গুরুদাস দাশগুপ্তের অবশ্য দাবি, ব্যক্তি জীবনের উপরে দলের ‘নিয়ন্ত্রণ’ কদাপি ছিল না! ছাত্র নেতা হিসেবে গুরুদাসবাবু অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন ১৯৫২ সালে। জ্যোতি বসু যে রাজ্য কাউন্সিলের সম্পাদক ছিলেন, সেই ১০১ জনের কমিটিতে প্রমোদ দাশগুপ্ত, চারু মজুমদারদের সঙ্গে তিনিও ছিলেন। তাঁর কথায়, “আমার ৬০ বছরের পার্টি জীবনের অভিজ্ঞতায় এমন কোনও নিয়ন্ত্রণ দেখিনি। যাঁকে বিয়ে করেছি (জয়শ্রী দাশগুপ্ত), তাঁর বাবা কংগ্রেস করতেন। অতুল্য ঘোষের ডান হাত ছিলেন। তা বলে কি আমার সঙ্গে শ্বশুরের সম্পর্ক ছিল না?” প্রবীণ সিপিআই সাংসদের বক্তব্য, এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টির গোড়ার দিকের নেতা-নেত্রীরা এসেছিলেন কংগ্রেস বা কংগ্রেস পরিবার থেকেই। তাই ‘ছোঁয়া’ বাঁচানোর চেষ্টা সম্পর্কে যা বলা হয়, তার বেশির ভাগই ‘রটনা’। যেমন, সিপিআই নেত্রী রেণু চক্রবর্তী যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন। তিনি বিধানচন্দ্র রায়ের ভ্রাতুষ্পুত্রী, সেই ‘সত্য’ তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারে ‘বাধা’ হয়নি।
তবে বর্ষীয়ান এক কমিউনিস্ট নেতাই জানাচ্ছেন, দলের নেতা-কর্মীরা নিজেদের মতো করে জীবন চালাতেই পারেন। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তি জীবনের কোনও বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রশ্ন উঠলে দলে ‘আলোচনা’ হতেই পারে। কারণ, রাজনৈতিক বা সামাজিক দিক থেকে কোনটা ‘উপযুক্ত’ নয়, তা নিয়ে দলের মতামত থাকতে পারে। সিপিএমের একাংশের মতে, এটাই মোক্ষম অস্ত্র! ‘নৈতিক অধঃপতনে’র দায়ে কার উপর কী ভাবে খাঁড়া নামবে, কেউ জানে না! এক নেতার কথায়, “কেউ বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক রাখছে বা বিবাহিত মহিলা অথবা পুরুষের সঙ্গে কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে, দলের কাছে এমন অভিযোগ এলে দল কিছু বলতেই পারে! কিন্তু জ্যোতিপ্রিয়রা যা বলছেন, তা বাংলা কেন, গোটা দেশের সংস্কৃতি বিরুদ্ধ!”
বামপন্থী ‘ভুক্তভোগী’রা অবশ্য জানেন, ‘সংস্কৃতি’র উৎস কোথায়! |