সংসদের সেন্ট্রাল হল। এসেছেন রাজ্যসভায় তৃণমূলের নতুন সাংসদ নাদিম-উল-হক। আর ক’দিন পরেই তাঁর শপথগ্রহণ, তারই খোঁজখবর নিতে। সেন্ট্রাল হলে তখন হাজির নীলোৎপল বসু। একটু দূরে বসে হান্নান মোল্লা। দু’জনেই সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
দু’বার রাজ্যসভার সাংসদ নীলোৎপল নাদিমকে বললেন, “এই সেন্ট্রাল হলে কোনও দলমতের ভেদাভেদ নেই। কিন্তু এখানে বসে আপনি আমার সঙ্গে চা খাবেন কি? আপনার নেত্রী তো আবার ফরমান জারি করেছেন!” নীলোৎপলের ‘কটাক্ষ’ হেসে ওড়ালেন নাদিম। বললেন, “আপনারা প্রয়োজনের থেকে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। ব্যাপারটা আসলে মোটেই তেমন নয়। দল এমন কোনও ফরমান দেয়নি আমাদের।”
সিপিএমের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক বয়কট করা নিয়ে তৃণমূলের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মন্তব্য ঘিরে শুধু রাজ্য রাজনীতি নয়, জাতীয় এমনকী আন্তর্জাতিক রাজনীতিও সরগরম। এই ফরমানের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছেন একনায়কতন্ত্রী সামরিক কমিউনিস্ট ঘেরাটোপে বন্দি উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধিও। তৃণমূল সূত্রের কিন্তু দাবি, রাজনৈতিক অস্পৃশ্যতায় তাদের দল বিশ্বাসী নয়। আর তার উদাহরণ হিসেবে ক’দিন আগের সেন্ট্রাল হলের চিত্রই তুলে ধরছে তারা।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে এ পর্যন্ত এক বারই সংসদে এসেছেন মমতা। সে দিন সেন্ট্রাল হলে তাঁকে ঘিরে চাঁদের হাট বসেছিল। দীর্ঘক্ষণ মমতার সঙ্গে আড্ডা মারেন সিপিআই সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্ত। হাল্কা সুরে তৃণমূল সাংসদদের বিরুদ্ধে নালিশ করে মমতাকে গুরুদাসবাবু বলেন, “আমি বলতে উঠলেই ওঁরা এমন বাধা দেন!” “আমি বলে দিচ্ছি, ওরা আর করবে না,” আশ্বাসবাণী শুনিয়েছিলেন মমতা। গুরুদাসবাবুর দলের সাংসদ ডি রাজা বলেন, “সে দিন শুধু আড্ডা দেওয়া বা চা খাওয়া নয়, মমতা তো আমাদের সঙ্গে ছবিও তুলেছিলেন।”
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কথায় “আমি তো সৌহার্দ্যের এই রাজনীতিতেই বিশ্বাস করি। গীতা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার অত্যন্ত হার্দিক সম্পর্ক ছিল। আমাকে স্নেহের চোখে দেখতেন ইন্দ্রজিৎ গুপ্তও। সিপিএমের সঙ্গে তৃণমূলের রাজনৈতিক বিরোধিতা আছে। কিন্তু আমরা সিপিএম-কে রাজনৈতিক ভাবে অস্পৃশ্য বলে মনে করি না। |
আমরাই তো রাজ্যে পারস্পরিক সৌজন্যের রাজনীতি ফিরিয়ে আনলাম। তখন জ্যোতিবাবু মুখ্যমন্ত্রী। জন্মদিনে দেখা করতে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলাম। মৃত্যুর আগেও অসুস্থ জ্যোতিবাবুকে দেখতে গিয়েছি। এখনও বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছি। কখনও রেজ্জাক সাহেব, কখনও অন্য নেতারা ফোন করেন। দেখা করতে আসেন। সকলের জন্যই আমার দরজা খোলা।”
রাজধানীতে কিন্তু এখন সর্বত্রই আলোচনা পশ্চিমবঙ্গ এবং মমতার সরকারকে নিয়ে। গত কাল জিমখানা ক্লাবে টাটা সংস্থার অন্যতম কর্ণধার অজয়কুমারের অবসরগ্রহণকে কেন্দ্র করে এক পার্টিতেও আমলা থেকে পত্রিকা সম্পাদক অনেকেরই প্রশ্ন, এত জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর কেন এই ঘৃণার রাজনীতি? অনেক প্রবীণ আমলা এবং সাংবাদিক বলেন, এক জন প্রশাসককে অনেক সময়ই নিচুতলার দলীয় নেতা অথবা আমলার ভুল থেকে ব্যক্তিগত দূরত্ব তৈরি করতে হয়। তাঁদের প্রকাশ্যে ভর্ৎসনা করতে হয়। তা না হলে তাঁকে এবং তাঁর দল বা সরকারকে সেই ভুলের মাসুল দিতে হয়।
গুজরাত দাঙ্গার পরে এই দূরত্ব রচনার কাজটাই করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। তিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ডেকে পাঠান। তার পর তাঁর উপদেষ্টারা সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন, প্রধানমন্ত্রী মোদীকে তিরস্কার করেছেন। বলেছেন, গুজরাতে যা চলছে, তাতে তিনি উদ্বিগ্ন এবং তার সঙ্গে সহমত নন। জ্যোতিবাবুও বহু ঘটনায়, ‘তাই নাকি’, ‘এমনটা হচ্ছে নাকি’, ‘দেখছি’, বলে দূরত্ব তৈরি করতেন।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা করছেন ঠিক তার উল্টো। দিল্লির রাজনৈতিক নেতারা মনে করছেন, সংবাদপত্রের উপরে ফতোয়া থেকে ব্যঙ্গচিত্র বিতর্ক, বা সামাজিক বয়কটের ফরমান কোনওটাই মমতার সঙ্গে আগাম আলোচনা করে হয়নি। যাঁরা এই সব বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন, তাঁরা মনে করেছেন, এর ফলে মমতা খুশি হবেন। ঘটনা হল, ব্যঙ্গচিত্রের জন্য অধ্যাপককে গ্রেফতারের বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী দূরস্থান, কলকাতার পুলিশ কমিশনার পর্যন্ত জানতেন না। পুলিশের অন্য এক অফিসার এক রাজনৈতিক নেতার
সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজটি করেছিলেন। আবার ‘ভোকাল টনিক’ দেওয়ার জন্য জ্যোতিপ্রিয় দলীয় বৈঠকে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা-ও যে মমতার অনুমতি নিয়ে এমন নয়। কিন্তু সমস্যা হল,
এই ঘটনাগুলি থেকে দূরত্ব রচনা করার বদলে মমতার মনে হয়েছে নেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করাটাই উচিত কাজ। কংগ্রেস নেতারা মনে করছেন, সিপিএমে এটা অনেক সময় প্রমোদ দাশগুপ্ত করেছেন।
বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী বলেন, “এনডিএ-তে মমতাকে দীর্ঘদিন ধরে দেখেছি। ক’দিন আগেও সংসদে লবিতে দেখা হয়েছিল। কিন্তু কখনওই মনে হয়নি যে তাঁর মধ্যে ঘৃণার রাজনীতি রয়েছে। আমরাও তো বরাবার বলে আসছি রাজনৈতিক অস্পৃশ্যতা বর্জনীয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর আমার প্রথম রাজ্য সফর ছিল কেরলে, ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের শেষকৃত্যে উপলক্ষে। ঘোরতর কমিউনিস্ট বিরোধী হয়েও সিপিএম নেতার অন্ত্যেষ্টিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কিন্তু সে দিন আমরা নিয়েছিলাম।” আডবাণীর মতে, তৃণমূল নেতারা অনেক কিছুই বলতে পারেন, কিন্তু মমতা ব্যক্তিগত ভাবে ঘৃণার রাজনীতির পক্ষে বলে মনে হয় না। শুধু আডবাণী নন, কংগ্রেস নেতা আহমেদ পটেল থেকে রাজীব শুক্ল, বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ থেকে এনসিপির তারিক আনোয়ার, জেডিইউ মুখপাত্র কে সি ত্যাগী সকলেই একবাক্যে বলছেন, “মূল ঘটনাটা জানি না। সংবাদমাধ্যমে যে ভাবে ফরমানের কথা বলা হচ্ছে সেটা কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু আমরা যারা মমতাকে জানি, তাদের কাছে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় যে তিনি এমনটা করতে পারেন।”
তৃণমূলের নেতা ডেরেক ও’ব্রায়ানের বক্তব্য, “আজ সামাজিক বয়কট নিয়ে তৃণমূলকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে, কিন্তু এই দস্তুর তো আসলে বামপন্থীদের। ‘শ্রেণি শত্রু’, ‘শ্রেণি হিংসা’ এই সব শব্দ তো কমিউনিস্ট অভিধানের অঙ্গ! অতি বামপন্থীরা এখনও শ্রেণি শত্রু হত্যায় বিশ্বাসী। দল থেকে বিতাড়িত ব্যক্তিকে সামাজিক ভাবে বয়কটের বিধান তাদের গঠনতন্ত্রে এখনও রয়েছে।”
রাজ্যে সিপিএমের দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের শাসনকালে প্রথমে কংগ্রেস তার পর তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা সন্ত্রাসের শিকার বলে অভিযোগ তৃণমূল নেতৃত্বের। তাঁদের দাবি, সেই কারণেই বিরোধী পক্ষে থাকাকালীন তাঁরা সিপিএম-কে বয়কট করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তৃণমূল নেতা তথা রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ের বক্তব্য, “রাজ্যে পালাবদল ঘটলেও গ্রামেগঞ্জে সিপিএমের অত্যাচার পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে বাধ্য হয়েই নেতাদের সুর কিছুটা চড়িয়ে রাখতে হচ্ছে। কিন্তু এখন সব মিলিয়ে তিলকে তাল করা হচ্ছে।”
বস্তুত তৃণমূলের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতার সঙ্গেই বাম নেতাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক। ডেরেকের নিজের ভাই ব্যারি সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত। সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের মামা গুরুদাস দাশগুপ্ত। এবং তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক মোটেই তিক্ত নয়। ফলে দিল্লিতে দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতারা সকলেই মনে করছেন বাস্তব এবং অবভাসের মধ্যে দূরত্ব অনেক।
মমতা-ঘনিষ্ঠ জ্যোতিপ্রিয় দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা করতে গিয়ে যে বিতর্ক বাধিয়েছেন, মমতা নিজে কখনওই সেই পথ ধরে চলেন না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এ ব্যাপারে বিরোধী পক্ষ থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের বিরোধিতার মুখেও তিনি বাজপেয়ী বা জ্যোতিবাবুর আদলে ওই মন্তব্যের নিন্দা করে বিতর্কের অবসান ঘটানোর রাস্তায় হাঁটেননি। নিজেই এর দায় নিয়েছেন। তাই সমস্যার দ্রুত সমাধান অধরাই থেকে গিয়েছে। |