রাজ্যে ‘পরিবর্তনে’র জমানায় সরকারি অনুষ্ঠানে বিরোধী দলের নেতাদের না-ডাকাটাই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি।
বৃহস্পতিবার উল্টো ছবি দেখা গেল উত্তর ২৪ পরগনায়।
বসিরহাটে ‘কিষাণ ক্রেডিট কার্ড’ বিলি করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাবরা, মিনাখাঁ, বনগাঁ এবং ব্যারাকপুর এই চার জায়গায় ‘কিষাণ মান্ডি’ তৈরির কথা ঘোষণা করেন। রিমোটের মাধ্যমে তিনি প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। তার পরে চারটি জায়গায় স্থানীয় প্রশাসনের তরফে অনুষ্ঠান হয়। তিনটি জায়গায় তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠানে ছিলেন সিপিএম নেতারাও! মিনাখাঁতে তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে সিপিএমের অভিযোগ। ব্লক প্রশাসন অবশ্য তা মানেনি।
কাকতালীয় ভাবে, এই ঘটনা ঘটেছে যে জেলায়, সেখানকার পর্যবেক্ষক রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। কয়েকদিন আগেই তিনি দলের এক কর্মিসভায় ফরমান দিয়েছেন, সিপিএমের সঙ্গে ‘সামাজিক’ সম্পর্ক না-রাখতে। সেই নিরিখে প্রশাসনের তরফে সিপিএমের নেতাদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোটাই ‘ব্যতিক্রম’। যেমন ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ সে সব অনুষ্ঠানে সিপিএমের নেতাদের সঙ্গেই তৃণমূল নেতা-বিধায়কদের উপস্থিতিও। যাকে ‘ইতিবাচক ব্যতিক্রম’ বলেই বর্ণনা করতে চান রাজনীতির সঙ্গে জড়িত লোকজন। ‘উন্নয়নের’ স্বার্থে এমন ব্যতিক্রম আরও কাম্য বলে শাসক শিবিরেরই একাংশের অভিমত। |
কয়েক মাস আগে এই উত্তর ২৪ পরগনারই জেলাসদর বারাসতে এসে প্রশাসনিক বৈঠক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। সেই বৈঠকে জেলা সভাধিপতি সিপিএমের ভরত দাস আমন্ত্রণ পাননি। কিছু দিন আগে বারাসত স্টেডিয়ামেও মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সংখ্যালঘুদের জন্য একগুচ্ছ প্রকল্প ঘোষণা ও অনুদান প্রদান অনুষ্ঠানে বিরোধী দলের কাউকে দেখা যায়নি। এমনকী, এদিনই বসিরহাটে মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি কোনও সিপিএম নেতাকে। অথচ, মুখ্যমন্ত্রীরই অনুষ্ঠানে ‘অঙ্গ’ ব্লক প্রশাসনের আয়োজিত অনুষ্ঠানে বনগাঁ কৃষি-খামারে শিলান্যাস অনুষ্ঠানে বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক সুরজিৎ বিশ্বাস, প্রাক্তন বিধায়ক গোপাল শেঠ, তৃণমূলের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সৌমেন দত্ত এবং জেলা পরিষদের দুই তৃণমূল সদস্যের পাশে দেখা গিয়েছে পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী দলনেতা গোবিন্দ মণ্ডলকেও। রাজ্যে ক্ষমতা বদলের পর সিপিএম অবশ্য কখনওই ‘বয়কটের রাজনীতি’তে যায়নি। প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ অমিতাভ নন্দী এদিন জানিয়েছেন, তাঁরা সরকারি অনুষ্ঠান বয়কট করেন না। তৃণমূলই বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন সরকারি অনুষ্ঠান বয়কট করত। তিনি বলেন, “সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদের ভূমিকা রয়েছে বলেই আমরা মনে করি। যাঁরা আমন্ত্রণ পেয়ে অনুষ্ঠানগুলিতে গিয়েছেন, তাঁরা ঠিকই করেছেন।”
দিন কয়েক আগে যে হাবরায় দলীয় নেতা-কর্মীদের সিপিএমের সঙ্গে ‘সামাজিক সম্পর্ক’ না-রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয়, এ দিন সেই হাবরারই কৃষি-খামারে শিলান্যাস অনুষ্ঠানে তৃণমূল নেতাদের পাশে দেখা গিয়েছে বেড়গুম-১ পঞ্চায়েত প্রধান সিপিএমের সুমন সরকারকে। আত্মীয় বিয়োগের ফলে থাকতে পারেননি হাবরা-১ পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী দলনেতা সিপিএমের অসীম ঘোষ। তবে তিনি অনুষ্ঠানের আয়োজনে ছিলেন বলেই পঞ্চায়েত সমিতি সূত্রে খবর। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হাবরা-১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের জাকির হোসেন বলেন, “এলাকার উন্নয়ন ও সৌজন্যের খাতিরে ব্লকের ৭টি পঞ্চায়েত প্রধানদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।”
ব্যারাকপুর-১ ব্লকের অনুষ্ঠান হয় বড়া কৃষি-খামারে। ভাটপাড়া ও বীজপুরের দুই তৃণমূূল বিধায়ক অর্জুন সিংহ ও শুভ্রাংশু রায় ছাড়াও ছিলেন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সিপিএমের রঞ্জিৎ মালো, কর্মাধ্যক্ষ (শিক্ষা) তাপস বিশ্বাস ও মামুদপুর পঞ্চায়েতের প্রধান সিপিএমের শামিমা বিবি। সিপিএমকে আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে অর্জুন বলেন, “প্রশাসনিক উদ্যোগ। সিপিএম নেতারা এসেছিলেন। এ নিয়ে বলার কিছু নেই।” মিনাখাঁর অনুষ্ঠানে সিপিএমের কাউকে দেখা যায়নি। দলের মিনাখাঁ-১ লোকাল কমিটির সম্পাদক দিলীপ রায়ের দাবি, “আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তাই কেউ যাননি। আমন্ত্রণ জানানো হলে অবশ্যই যেতাম।” দিলীপবাবুর দাবি খারিজ করে বিডিও শ্যামল পাল জানান, সকলকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। হাবরা-১ ব্লকের বিডিও তপনকুমার ঘোষ বলেন, “কাদের আমন্ত্রণ করা হবে, সে ব্যাপারে সরকারি নির্দেশ ছিল না। জেলাশাসক বলেছিলেন, স্থানীয় ভাবে সকলকে নিয়ে অনুষ্ঠান করতে।” বনগাঁর বিডিও কৃষ্ণপদ হালদারও বলেন, “সরকারি নির্দেশ ছিল না। স্থানীয় ভাবেই সকলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।”
জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল বলেন, “এটা সরকারি অনুষ্ঠান। এ জন্য আমন্ত্রণপত্র ছাপানো হয়নি। কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। যাঁরা উপস্থিত হয়েছেন, তাঁরা বিজ্ঞাপন দেখে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। দল দেখে কাউকে ডাকা বা বাদ দেওয়া হয়নি।” কিছু দিন আগে বারাসত স্টেডিয়ামে সংখ্যালঘুদের জন্য প্রকল্প ঘোষণা ও অনুদান প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে বিরোধী দলের কাউকে দেখা যায়নি কেন? জেলাশাসক জানান, ওই অনুষ্ঠানটি ছিল রাজ্য সংখ্যালঘু দফতর ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে। ওই অনুষ্ঠানেও কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যেতেও বারণ করা হয়নি। আর জ্যোতিপ্রিয়র বক্তব্য, “প্রশাসনিক অনুষ্ঠান ছিল। আমন্ত্রণ প্রশাসন জানিয়েছে। এটা আমাদের (তৃণমূলের) কোনও বিষয় নয়।”
|
(সহ প্রতিবেদন: নির্মল বসু) |