কেন্দ্রীয় সরকারের আর দায় এড়াইবার পথ থাকিল না। গত কয়েক মাসে যখনই ভারতের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বৃদ্ধির হার শ্লথ হইয়া যাইবার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হইয়াছে, সরকার আর পাঁচটি কারণের সঙ্গে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কথা উল্লেখ করিতে কখনও ভুলে নাই। ব্যাঙ্ক মূল্যস্ফীতির হারে লাগাম পরাইতে যে কঠোর আর্থিক নীতির পথে হাঁটিয়াছিল, সরকার তাহাকে বৃদ্ধির হারের গতিভঙ্গের একটি বড় কারণ হিসাবে দেখাইয়াছে। কথাটি ভুল নহে। ব্যাঙ্কের কঠোর আর্থিক নীতি দেশে বিনিয়োগকারীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলিয়াছে। ব্যাঙ্ক অবশ্য বাজেটের পূর্বেই সুদ বৃদ্ধি করা বন্ধ করিয়াছিল। দুই দফায় ক্যাশ রিজার্ভ রেশিয়ো কমাইয়া ইঙ্গিত দিয়াছিল, অদূর ভবিষ্যতে কঠোরতর নীতির সম্ভাবনা নাই। ইঙ্গিতটি ভ্রান্ত ছিল না। সম্প্রতি ব্যাঙ্ক রেপো রেট (যে সুদের হারে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে স্বল্পমেয়াদে ঋণ লয়) ৮.৫ শতাংশ হইতে কমাইয়া ৮ শতাংশ করিল। ব্যাঙ্কের দীর্ঘমেয়াদি সুদের হার ব্যাঙ্ক রেটও একই পরিমাণ কমিয়াছে। ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্ত বাজারের প্রত্যাশার অধিক হইয়াছে। বাজার অনুমান করিয়াছিল, সুদের হার সম্ভবত ০.২৫ শতাংশ কমিবে। ব্যাঙ্কের অতীত কঠোর নীতির অভিজ্ঞতা বাজারের প্রত্যাশাকে নিয়ন্ত্রণে রাখিয়াছিল। আর, বেহাল অর্থনীতি ব্যাঙ্ককে প্রত্যাশার অতিরিক্ত পথ হাঁটিতে কার্যত বাধ্য করিয়াছে। ব্যাঙ্ক তাহার দায়িত্ব পালন করিয়াছে। এই বার যাহা করিবার, কেন্দ্রীয় সরকারকেই করিতে হইবে।
ব্যাঙ্কের বর্তমান সিদ্ধান্তটি ঝুঁকিহীন নহে। মূল্যস্ফীতির রাক্ষস বধ এখনও নিতান্তই অসম্পূর্ণ। বস্তুত, ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচক ফের ঊর্ধ্বমুখী হইয়াছে। ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্ত বাজারে টাকার জোগান বাড়াইবে, এবং সেই বাড়তি জোগান স্বভাবতই মূল্যস্ফীতির পালে নূতন বাতাস জোগাইবে। কিন্তু, এর কম হারে সুদ কমাইলে তাহা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা নিতান্তই কম ছিল। অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট, ভারতে বাজারের কিছু অকুশলতার কারণে আর্থিক নীতিতে বেশ বড়সড় পরিবর্তন না হইলে শেষ পর্যন্ত তাহার ধাক্কায় তেমন জোর থাকে না। ফলে, দেশের বেহাল আর্থিক বৃদ্ধির হারকে আর্থিক নীতির মাধ্যমে কিছুমাত্র উৎসাহ দিতে হইলে ব্যাঙ্ক যাহা করিয়াছে, তাহাই কর্তব্য। বস্তুত, ব্যাঙ্ক যথেষ্ট সাবধানে পদক্ষেপ করিয়াছে। বাজারে প্রত্যাশা থাকিলেও এই দফায় আর ক্যাশ রিজার্ভ রেশিয়ো কমায় নাই। অর্থাৎ, বাজারে যাহাতে এক ধাক্কায় বিপুল পরিমাণ নগদ ঢুকিতে না পারে, ব্যাঙ্ক তাহা নিশ্চিত করিতে চাহিয়াছে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি দেখিলে অদূর ভবিষ্যতে যে সুদের হার আর কমিবে না, ব্যাঙ্ক তাহাও কার্যত জানাইয়া দিয়াছে। কিন্তু, ব্যাঙ্কের বর্তমান সিদ্ধান্তে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির গাঙে বান আসিবে, তাহা নিশ্চিত করিয়া বলা কঠিন। কেন্দ্রীয় সরকার তাহার ভর্তুকির বোঝা কমায় কি না, তাহাই এখন প্রশ্ন। ভর্তুকি বাড়িলে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বাড়ে। আর, রাজকোষ ঘাটতি বাড়িলে তাহা মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। সরকার বাজার হইতে বিপুল পরিমাণ ঋণ করিলে বেসরকারি বিনিয়োগকারীর পক্ষে ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে। তাহাতে আর্থিক বৃদ্ধির হারে ধাক্কা লাগে। কাজেই, সরকারকে ভর্তুকি কমাইবার কথা ভাবিতেই হইবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই কথাটি বলিতে দ্বিধা করে নাই। ব্যাঙ্ক জানাইয়াছে, আর্থিক বৃদ্ধির হারকে উৎসাহ দেওয়ার যে যৎসামান্য ক্ষমতা আর্থিক নীতির এখনও আছে, তাহা বজায় রাখিবার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। ব্যাঙ্কের বিবৃতির কিছু পরেই অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় জানাইয়াছেন, সরকার যথাসাধ্য করিবে। প্রশ্ন হইল, পেট্রোপণ্য হইতে সার, সবেতেই ভর্তুকি বজায় রাখিবার রাজনীতিকে অগ্রাধিকার না দিয়া অর্থনীতির কথা ভাবিবার সাহস কেন্দ্রীয় সরকারের হইবে কি না। এই প্রশ্নের উত্তরের উপরই ভারতের আর্থিক ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। |