বোমা ফেটে এক দম্পতি-সহ তিন জনের মৃত্যু নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর শুরু হয়েছে বর্ধমানের মঙ্গলকোটে। বিস্ফোরক তৈরির সময়ে এমন ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান। যদিও মৃতদের দলীয় কর্মী দাবি করে তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ, সিপিএমের লোকজন তাঁদের খুন করেছে। সিপিএমের পাল্টা দাবি, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই এই ঘটনা।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বুধবার রাতে মঙ্গলকোটের ধারসোনা গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় বিস্ফোরণের আওয়াজ পান প্রতিবেশীরা। পাড়ার শেষ প্রান্তে, মাঠের ধারে মেহের শেখের (৩৪) বাড়িতে গিয়ে গ্রামবাসীরা দেখেন, তিনি, তাঁর স্ত্রী আস্পিয়া বিবি (২৯) এবং তাঁদের পড়শি কুরবান শেখ (৩০) ও তাঁর স্ত্রী রশিনা বিবি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। বাসিন্দারাই তাঁদের কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। রাতেই মেহের, কুরবান ও আস্পিয়া বিবির মৃত্যু হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন রশিনা বিবি। |
মেহের ও কুরবানকে তাঁদের দলের সক্রিয় কর্মী দাবি করে মঙ্গলকোটের তৃণমূল নেতা মেহবুব চৌধুরীর অভিযোগ, “একশো দিনের কাজ নিয়ে সিপিএমের সঙ্গে গোলমাল চলছিল। সে জন্যই ওঁদের বোমা মেরে খুন করা হল।” তৃণমূলের মঙ্গলকোট ব্লক সভাপতি অপূর্ব চৌধুরীরও অভিযোগ, “গ্রাম দখলের রাজনীতি করার জন্য সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরা পরিকল্পনামাফিক এই কাজ করেছে।” একই অভিযোগ করেছেন জেলা তৃণমূল সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথও। তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, ওই রাতে বাড়িতে বসে কুরবানের সঙ্গে গল্প করছিলেন মেহের। আস্পিয়া বিবি ও রশিনা বিবি কাঁথা স্টিচ ও বিড়ি বাঁধার কাজ করছিলেন। সেই সময়ে বাইরে থেকে দুষ্কৃতীরা বোমা ছুড়ে পালিয়ে যায়।
যদিও হাসপাতালে তৃণমূল নেতাদের সামনেই মেহের শেখের ভাই হাসেম শেখ বলেন, “তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্যই তিন জনকে মরতে হল।” স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ওই এলাকায় তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন মেহবুব চৌধুরী ও ইরফান শেখ। গ্রাম উন্নয়ন কমিটির সচিব ইরফান বৃহস্পতিবার দাবি করেন, “আমরা পুরনো তৃণমূল কর্মী। তিন জনের মৃত্যুর পরে আমাদের সিপিএমের লোক বলে প্রচার হচ্ছে। আসলে মেহের, কুরবানেরা আমাদের খুন করার জন্য বোমা বাঁধছিল।”
ঘটনার সময়ে বাড়িতেই ছিলেন মেহের শেখের দুই কিশোরী মেয়ে হাসিনা খাতুন ও আশা খাতুন। তাদের কথায়, “রাতে খাওয়া-দাওয়ার পরে আমরা ঘুমোচ্ছিলাম। এমন সময়ে প্রচণ্ড জোরে আওয়াজ হয়। বাড়ি নড়ে ওঠে। ভয় পেয়ে আমরা ঘর থেকে বেরোইনি। পরে পাড়ার লোকজন এসে আমাদের বের করে।” নিজেদের বাড়িতে ঘুমোচ্ছিল কুরবানের দুই মেয়েও। তাঁদের খবর দেওয়া হয় এ দিন সকালে। |
গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মেহের শেখের বাড়ির চাল উড়ে গিয়েছে। চার দিকে রক্তের দাগ। ঘরের সামনে এক চিলতে বারান্দায় গর্ত হয়ে রয়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সুতলি দড়ি ও পাথরের টুকরো। বুধবার গভীর রাতেই পুলিশ বোমা তৈরির উপকরণ ও একটি বোমা উদ্ধার করেছে। এ দিন সকালে ঘটনাস্থলে যান বর্ধমান রেঞ্জের ডিআইজি বাসব তালুকদার, জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা-সহ পুলিশ আধিকারিকেরা। ডিআইজি মৃতদের মেয়েদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। পরে তিনি বলেন, “ঘটনাস্থল দেখে ও লোকজনের সঙ্গে কথা বলার পরে মনে হচ্ছে, বিস্ফোরক তৈরির সময়ে এই ঘটনা ঘটেছে। বিস্ফোরক তৈরির কিছু নমুনা মিলেছে। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা পরীক্ষা করার পরে বিশদে জানা যাবে।” এ দিন বিকেলে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ দল ওই গ্রামে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে।
রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের অভিযোগ, “সিপিএম চক্রান্ত করে আমাদের লোকজনকে বোমা ছুড়ে মারল। মহিলারাও বাদ গেল না!” ধারসোনা গ্রামের বাসিন্দা তথা মঙ্গলকোটের সিপিএম বিধায়ক শাহজাহান চৌধুরীর অবশ্য দাবি, “এই ঘটনার সঙ্গে সিপিএমের কোনও সম্পর্ক নেই। এটা তৃণমূলের অন্তর্কলহের ফল। মৃতেরা যে বোমা বাঁধছিল, তা পুলিশও জানিয়ে দিয়েছে।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমল হালদারের বক্তব্য, “গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ঢাকার জন্য এ সব কথা বলছেন মন্ত্রী।” |
বৃহস্পতিবার অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি। |