নিজস্ব সংবাদদাতা • চুঁচুড়া |
হুগলিতে ওষুধ কেলেঙ্কারিতে জড়িত অভিযোগে প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি সিপিএম নেতা অসিত পাত্রকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
চুঁচুড়া থানায় ভারপ্রাপ্ত জেলাশাসক আর আলিয়াস ভেজের দায়ের করা এফআইআরের ভিত্তিতে মঙ্গলবার গভীর রাতে পুড়শুড়ার জঙ্গলপাড়ায় বাড়ি থেকেই গ্রেফতার করা হয় অসিতবাবুকে। গোলমালের আশঙ্কায় রাতেই অসিতবাবুকে চুঁচুড়ায় নিয়ে আসা হয়। বুধবার তাঁকে হাজির করানো হয় চুঁচুড়া জেলা আদালতে। জামিনের আবেদন নাকচ করে বিচারক তাঁকে ১৪ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। অসিতবাবুর কঠোর শাস্তির দাবিতে এ দিন থানার সামনে এবং আদালত চত্বরে দফায় দফায় বিক্ষোভ দেখান তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। দু’জায়গায় সিপিএম নেতা-কর্মীদের সে ভাবে দেখা যায়নি। |
আদালতে অসিতবাবু। নিজস্ব চিত্র। |
সরকারি টাকা আত্মসাৎ, সই জাল, অপরাধ চেপে যাওয়া এবং আর্থিক দুর্নীতি এই চারটি ধারায় মামলা হয়েছে অসিতবাবুর বিরুদ্ধে। এ দিন আদালত চত্বরে অসিতবাবু অবশ্য দাবি করেন, “উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি চক্রান্তের শিকার। ওষুধ কেনায় নিশ্চয়ই কিছু গরমিল হয়েছে। সঠিক ভাবে তদন্ত হওয়া দরকার। তা হলে আসল তথ্য জানা যাবে।” একই সুরে সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরীও দাবি করেন, “এখন নানা ভাবে আমাদের দলীয় নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করা হচ্ছে। এক দিকে যেমন তাঁদের মারধর করা হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনই মিথ্যা মামলায় ফাঁসাচ্ছে রাজ্য সরকার। এ ক্ষেত্রেও চক্রান্ত হয়েছে।” তিনি বলেন, “অসিতবাবুকে সব রকম সাহায্য করা হবে। দল তাঁর পাশে রয়েছে।” অবশ্য, ২০০৯ সালে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠামাত্র দলের নির্দেশেই সভাধিপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন অসিতবাবু। তখন দল ব্যবস্থা নিয়েছিল কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে সুদর্শনবাবু জানান, কিছু অনিয়মের অভিযোগ অসিতবাবুর বিরুদ্ধে উঠেছিল। তা তাঁর পদের পক্ষে অবমাননাকর। সেই কারণে তাঁকে সরানো হয়েছিল।
পুলিশ ও প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৯ সালে তৎকালীন মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (সিএমওএইচ) ভূষণ চক্রবর্তী চুঁচুড়া থানায় দায়ের করা লিখিত অভিযোগে জানান, সরকারি বিধি না মেনে এবং তাঁকে কিছু না জানিয়ে তৎকালীন জেলা সভাধিপতি অসিতবাবু নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনেছেন। একই অভিযোগ তিনি স্বাস্থ্য দফতরেও জানান। জেলার সরকারি হাসপাতালগুলির ওষুধপত্র এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার যে ‘পারচেজ কমিটি’ রয়েছে, পদাধিকার বলে অসিতবাবু ছিলেন তার প্রধান। নিয়মিত সরবরাহের প্রয়োজন ছাড়াও বিভিন্ন জরুরি পরিস্থিতিতে ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ ক্ষমতা ছিল। তিনি সেই ক্ষমতারই অপব্যবহার করেন বলে অভিযোগ। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের নির্দেশমতো অর্থ দফতর এবং ভিজিল্যান্স কমিশনও আলাদা ভাবে তদন্ত শুরু করে। জেলা পরিষদের অর্থ দফতরের কয়েক জন অফিসারকে ওই কেলেঙ্কারির জন্য সাসপেন্ড করা হয়। দলের নির্দেশ মেনে ওই বছরেরই জুন মাসে সভাধিপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন অসিতবাবু। |
ধৃত অসিত পাত্রকে ‘ধিক্কার’ জানাচ্ছেন তৃণমূল কর্মীরা। ছবি: তাপস ঘোষ। |
সম্প্রতি ভিজিল্যান্স কমিশনের জয়েন্ট সেক্রেটারি ভারপ্রাপ্ত জেলাশাসককে অসিতবাবুর বিরুদ্ধে একটি রিপোর্ট পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন। সেই রিপোর্টে প্রাথমিক ভাবে ৪ লক্ষ ৩ হাজার ৭২৮ টাকা গরমিলের উল্লেখ রয়েছে। ওই রিপোর্টের ভিত্তিতেই মঙ্গলবার সকালে থানায় এফআইআর দায়ের করেন ভারপ্রাপ্ত জেলাশাসক। পুলিশ সুপারের কাছেও সেই রিপোর্টের প্রতিলিপি পাঠানো হয়।
প্রশাসনের দাবি, তদন্তে দেখা গিয়েছে, যে সময়ের ওই ঘটনা, তখন অত ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার পরিস্থিতি তৈরি হয়নি জেলায়। বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকার ওষুধ কেনা হয়েছিল।
তন্তুজের মতো সংস্থার থেকে প্রয়োজন ছাড়া প্রায় ৩০ হাজার মশারি, ব্যান্ডেজ, তুলো কেনা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত জেলাশাসক বলেন, “ভিজিল্যান্স কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতেই অসিতবাবুর বিরুদ্ধে এফআইআর করেছি। পুলিশ তদন্ত করছে। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।” পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী জানান, জেলাশাসকের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতেই গ্রেফতার করা হয় অসিতবাবুকে। বর্তমানে অসিতবাবু সিপিএমের পুড়শুড়া জোনাল কমিটি এবং জেলা কমিটির সদস্য। কৃষকসভার নেতৃত্বও দিতেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৩ এবং ২০০৮ সাল থেকে ২০০৯-এর জুন মাস পর্যন্ত দু’দফায় জেলা সভাধিপতি ছিলেন। |
ওষুধ-কেলেঙ্কারি |
|
“নানা ভাবে দলীয় নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করা হচ্ছে। মারধর করা হচ্ছে। মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও চক্রান্ত হয়েছে। অসিতবাবুকে সব রকম সাহায্য করা হবে। দল তাঁর পাশে আছে।”
সুদর্শন রায়চৌধুরী। সিপিএমের জেলা সম্পাদক। |
|
|
“পুলিশ সঠিক ভাবে তদন্ত করলে অনেক রাঘব বোয়াল ধরা পড়বে। জেলা সিপিএমের সর্বোচ্চ নেতারা যুক্ত ছিলেন। আদালতের কাছে অসিতবাবুর সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। বিচারব্যবস্থার উপরে আস্থা আছে।”
তপন দাশগুপ্ত। জেলা তৃণমূল সভাপতি। |
|
|
“অনেক দিন আগেই অসিতবাবুকে গ্রেফতার করা উচিত ছিল। উনি কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন। এর পিছনে ওঁর দল এবং প্রশাসনের লোকজনও রয়েছেন। আশা করি, তদন্তে সে সব উঠে আসবে।”
দিলীপ নাথ। জেলা কংগ্রেস সভাপতি। |
|
|
“উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ফাঁসানো হয়েছে। আমি চক্রান্তের শিকার। নিশ্চয়ই কিছু গরমিল হয়েছে। সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার। তা হলে আসল তথ্য জানা যাবে।”
অসিত পাত্র। প্রাক্তন সভাধিপতি। |
|