কাজের নিরিখে এগারো মাসে কত দূর এগোল নতুন সরকার? উত্তর দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। তাঁর কথায়, “নির্বাচনের আগে যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তার ৯০% কাজ করে ফেলেছি আমরা। এখন আগামী চার বছর শুধু ‘মনিটর’ করতে হবে।”
সোমবার নিজের সরকারের কাজকে ১০০-য় ১০০ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ৪৮ ঘণ্টা পরে তার থেকে ১০% কমিয়ে ‘মার্কশিট’-এ নিজের সরকারকে ৯০ দিলেন। সরকারের এক বছর পূরণ করতে এখনও এক মাস বাকি।
বুধবার রাজ্যের মন্ত্রী ও সচিবদের নিয়ে টাউন হলে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর নিজের ওই ‘মূল্যায়ন’-এর সঙ্গেই ছিল বিভিন্ন দফতরের কাজের পর্যালোচনা। মোটামুটি সব দফতরকে নিয়েই ‘তৃপ্ত’ মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “সরকারের কাজে আমি সন্তুষ্ট।” ভিতরে মন্ত্রী-আমলাদের তিনি বলেছেন, “আমরা অনেক ভাল কাজ করেছি। এক বছর পূর্তি উপলক্ষে যে বই বেরোবে, তাতে যেন ওই ‘সাফল্য’ প্রতিফলিত হয়।”
তবে সংবাদমাধ্যমের একাংশের ‘সমালোচনায়’ তিনি যে ক্ষুব্ধ, বৈঠকে তা-ও পরিষ্কার করে দেন মমতা। বলেন, “সংবাদমাধ্যমের একাংশ আমাদের কথা লিখবে না। তাই আমাদের কাজের প্রচার আমাদেরই করতে হবে।” সাম্প্রতিক কালে সরকারের নানা কাজ নিয়ে যে সমালোচনা হচ্ছে তাতে গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই একাধিক আমলার মতে, এ দিনের বৈঠকে সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
ক্ষমতায় আসার পর এই নিয়ে তিন বার মন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রথম দিকে দু’টি বৈঠক হয়েছে তিন মাস অন্তর। এ দিনেরটা ছিল ছ’মাসেরও বেশি সময়ের পর। প্রায় এক বছরের মাথায় ডাকা বৈঠকে দফতরগুলির কাজের কতটা কাটাছেঁড়া করবেন মুখ্যমন্ত্রী, তাই নিয়ে খানিক সংশয়ে ছিলেন মন্ত্রী-আমলারা। কিন্তু বৈঠক শেষে প্রায় প্রত্যেকেই এক মত, ‘‘আজ ‘অন্য মুড’-এ ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।” বৈঠকের পরে মমতা বলেন, “কোন দফতর ভাল কাজ করছে, কারা পিছিয়ে আছে, তা পর্যালোচনা বৈঠকে জানা যায়।” তাঁর বক্তব্য, কয়েকটি দফতর খুব ভাল কাজ করছে। তবে কয়েকটি দফতরের কাজে কিছু সমস্যাও হচ্ছে।
খাদ্যসামগ্রীর ফলন বৃদ্ধি ও সংগ্রহ, যুবকল্যাণ দফতরের কাজ এবং ১০০ দিনের প্রকল্পে ৩৩ দিন অবধি কাজ দিতে পারায় পঞ্চায়েত দফতরের প্রশংসা করেছেন মমতা। তাঁর দাবি, “৩৩ দিন কাজ দিতে পারাটা দেশের মধ্যে রেকর্ড।” নিয়োগে দুর্নীতি ঠেকাতে স্টাফ সিলেকশন কমিশন তৈরি, এক হাজার স্কুলকে উন্নীত করা, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নিরপেক্ষতা বজায় রাখা নিয়েও সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। রাজ্যের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে গোটা প্রশাসনকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেছেন, “এ বার বিদ্যুৎ সঙ্কট তো হবেই না। উল্টে আমরা ‘বিদ্যুৎ ব্যাঙ্ক’ করতে পেরেছি।” আর, জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি নিয়ে খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম প্রশংসা করেছেন বলে সভাকে জানান মমতা। |
প্রশাসন চালাতে গিয়ে কোথায় অসুবিধা হচ্ছে? মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে অনেক সচিবই লোকবল কম থাকার কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে কোনও আশার কথা শোনাতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী। ক্ষমতায় এসে এ পর্যন্ত প্রায় তিন লক্ষ চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু এ দিন সচিবদের উদ্দেশে খানিকটা হালকা সুরেই মমতা বলেন, “লোক নেই তো আমি কী করব? তা হলে তো মঙ্গলগ্রহ থেকে লোক আনতে হয়।”
সব ‘ভাল’-এর মধ্যে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন দফতর-সহ আরও দু’একটি দফতরের কাজের মৃদু সমালোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের নিজস্ব ওয়েবসাইট ‘বাংলার মুখ’-এ কেন বিভিন্ন দফতর সর্বশেষ তথ্য ‘আপলোড’ করে না, সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি। সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি বই প্রকাশিত হবে। এ জন্য প্রতিটি দফতরের কাছে কাজের খতিয়ান চাওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৮টি দফতর সেই হিসেব দেয়নি। এর মধ্যে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীরই স্বরাষ্ট্র এবং শিল্প দফতর। আজ, বৃহস্পতিবারের মধ্যে ওই সব দফতরকে তথ্য জমা দিতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন, “সরকারের কাজ নিয়ে বই বেরোচ্ছে। সেই বই দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে।”
টাউন হলে আমলাদের নিয়ে বৈঠকের আগে এ দিন মহাকরণে মন্ত্রিসভার বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। উন্নয়নের কাজে গতি আনতে টাকা খরচের পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রস্তাব পাশ হয় সেখানে। প্রথম দফায় রাজ্যের বড় ছ’টি দফতরে ইন্টারনাল ফিনান্সিয়াল অফিসার নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য মন্ত্রিসভা। ওই বৈঠকে ঠিক হয়েছে, ১ মে থেকে স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, পঞ্চায়েত, জনস্বাস্থ্য, পূর্ত ও নগরোন্নয়ন দফতরে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ভবিষ্যতে আরও অনেক দফতরেই এই নয়া ব্যবস্থা চালু হবে।” টাউন হলের বৈঠকে মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্তের কথা জানান মুখ্যসচিব সমর ঘোষ।
এই নতুন ব্যবস্থায় কী সুবিধে হবে? অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, এত দিন প্রতিটি দফতরকে তাদের বাজেট বরাদ্দের টাকা খরচের জন্য প্রকল্প অনুযায়ী অর্থ দফতরের অনুমোদন নিতে হত। এর ফলে, অর্থ দফতরে ফাইলের পাহাড় জমে যেত।
অনুমোদিত প্রকল্পগুলির কাজ শুরু করতে দেরি হত এবং সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ থাকলে রাজ্যের দেয় টাকা ঠিক সময় না মেলায় তার বেশির ভাগটাই ফিরে যেত বলে একাধিক সচিবের অভিযোগ।
ইন্টারনাল ফিনান্সিয়াল অফিসার নিয়োগ হলে টাকা চেয়ে আর অর্থ দফতরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না বিভিন্ন দফতরকে। তাঁরাই বাজেট অনুযায়ী খরচ যাচাই করে প্রকল্প অনুমোদন করবেন এবং ঠিক সময়ে অর্থ বরাদ্দ সুনিশ্চিত করবেন। টাউন হলের বৈঠকে এ দিন মন্ত্রী-আমলাদের জানানো হয়, অন্য দফতরের বিভিন্ন প্রকল্পের উপরে অর্থ দফতরের নিয়ন্ত্রণ ‘শিথিল’ করতে আরও একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। এত দিন তিন কোটি টাকা মূল্যের প্রকল্প অনুমোদন করতে পারত সংশ্লিষ্ট দফতরের ‘অ্যাপ্রুভাল কমিটি’। সেই পরিমাণ বাড়িয়ে পাঁচ কোটি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সচিবদেরও প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা বাড়িয়েছে অর্থ দফতর। এ বার ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত প্রকল্প সরাসরি অনুমোদন করতে পারবেন সচিবেরা।
পূর্ত দফতরের অফিসারদের অভিযোগ ছিল, এক শ্রেণির অসাধু ঠিকাদার ‘পাওনা’ দেখিয়ে ‘সালিশি’র (আরবিট্রেশন) মাধ্যমে সরকারের থেকে টাকা আদায় করে নিতেন। মাস তিনেক আগে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ওই ‘প্রথা’ তুলে দেয় পূর্ত দফতর। এ দিনের বৈঠকে আবাসন ও সেচ দফতরও ওই পথে হাঁটার আর্জি জানায়। তাদের বিস্তারিত রিপোর্ট-সহ প্রস্তাব জমা দিতে বলা হয়েছে।
এইচআরবিসি কিংবা কেএমডিএ-র মতো বিভাগগুলি বিভিন্ন দফতরের কাজ করার জন্য এক-এক রকম ‘সার্ভিস চার্জ’ নেয়। এক জন আমলা অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সার্ভিস চার্জে সামঞ্জস্য আনার প্রস্তাব দেন। একাধিক আমলা টেন্ডার নিয়মের সরলীকরণ করারও প্রস্তাব দেন। সেই সব প্রস্তাব খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন মুখ্যমন্ত্রী। |