বহরমপুরে অমিল সাবস্টেশনের ৩০ একর |
রাজ্যের জমি-জটে বিপন্ন ঢাকা-দিল্লি বিদ্যুৎ চুক্তিও |
পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানির ব্যাপারে দিল্লি যে চুক্তি সই করেছে ঢাকার সঙ্গে, পশ্চিমবঙ্গের জমি-সমস্যার ফাঁসে এ বার তা-ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।
চুক্তি অনুযায়ী, বিদ্যুৎ রফতানি সংক্রান্ত যাবতীয় পরিকাঠামো তৈরির কাজ ২০১৩ সালের মধ্যে সেরে ফেলতে হবে। ঠিক হয়েছিল, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পাঠানোর জন্য মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে চারশো কেভি-র একটা সাবস্টেশন বানাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন।’ জটিলতা দেখা দিয়েছে এই প্রকল্পটিকে ঘিরেই, যার মূলে সেই জমি। সাবস্টেশন তৈরির জন্য যে ৩০ একর জমি দরকার, ক্ষতিপুরণের অঙ্ক নিয়ে টানাপোড়েনে গ্রিড কর্পোরেশন তা হাতে পাচ্ছে না। এবং সমস্যা এখনও না-মেটায় কর্পোরেশন কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রককে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ওই সাবস্টেশন তৈরি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে পুরো পরিকল্পনাটিই ঘোর সঙ্কটে পড়ে গিয়েছে। এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তির দরুণ তিস্তার জলবণ্টন চুক্তিটি আলোচনার স্তরে আটকে রয়েছে। থমকে আছে ছিটমহল হস্তান্তরও। এ বার বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানি চুক্তি নিয়েও এ হেন অনিশ্চয়তায় খানিকটা হলেও অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সুরাহার কী উপায়?
বিদ্যুৎ মন্ত্রক সূত্রের খবর: গ্রিড কর্পোরেশন পুরো বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানিয়ে তাঁর সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। সমাধান-সূত্র খুঁজতে আসরে নামতে হয়েছে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্ডেকে। এ নিয়ে আলোচনায় বসার জন্য মমতার সময় চেয়ে চিঠি দিয়েছেন তিনিও। বিদ্যুৎ মন্ত্রকের খবর: ঢাকা-দিল্লি বিদ্যুৎ-চুক্তিটি দ্রুত কার্যকর করার উপরে জোর দিয়ে গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বাংলাদেশ সফরকালে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল। যার সূত্র ধরে গত ফেব্রুয়ারিতে এনটিপিসি-র সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন পর্ষদের একটি চুক্তি হয়েছে। সেই চুক্তি মোতাবেক এনটিপিসি বাংলাদেশে আড়াইশো মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রফতানি করবে। পাশাপাশি ভারতের বাজার থেকে নিজেদের প্রয়োজনমতো আরও আড়াইশো মেগাওয়াট কিনতে পারবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ পর্ষদ, বাজারের দরে।
পাশাপাশি বাংলাদেশে ভারতীয় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এ-পারের বহরমপুরে এবং ও-পারের ভেড়ামারায় দু’টো সাবস্টেশন গড়ে তোলার পরিকল্পনা হয়েছিল। দু’টির মধ্যে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংবহনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি হাই-ভোল্টেজ লাইন টানার কথা। সাবস্টেশন তৈরির জন্য গ্রিড কর্পোরেশন বহরমপুরের কাছে নবগ্রাম ব্লকের দক্ষিণগ্রাম মৌজায় প্রায় ৩০ একর জমি চিহ্নিতও করে ফেলেছিল। তার পরেই বিপত্তি দেখা দেয়। কী রকম? মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর: ২০১০-এর এপ্রিলে ওই অঞ্চলে জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি বোরোয়। কিন্তু সরকারি পদ্ধতি মেনে ১৩৪ জন জমি-মালিকের জন্য একরপিছু যে ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়েছিল, তার অনেক বেশি টাকার দাবি ওঠে। এর ফয়সালা এখনও হয়নি। গত দু’বছরে
জমি-মালিকদের সঙ্গে বারবার বৈঠক করেও এক ছটাক জমি কেনা যায়নি। গ্রিড কর্পোরেশন এ বার হাল ছেড়ে দিয়েছে। মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত জেলাশাসক অজয় ঘোষও জানিয়েছেন, ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত জটিলতায় জমি কেনা আটকে রয়েছে।
প্রশাসন কী করছে?
জেলাশাসক জানিয়েছেন, জমি-মালিকদের সঙ্গে সঙ্গে ফের বৈঠক ডাকা হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল, মুর্শিদাবাদে ওই জমি না-পেলে সাবস্টেশন করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশেও প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে না। সব মিলিয়ে পুরো উদ্যোগটাই বিশ বাঁও জলে চলে যেতে পারে বলে প্রশাসন ও বিদ্যুৎ-কর্তাদের অনেকের আশঙ্কা।
শুধু বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানি নয়। জমি-সমস্যার জেরে ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ নিয়ে আসার পরিকল্পনাতেও জটিলতা দেখা দিয়েছে। ভুটানে এখন বেশ ক’টা বড় মাপের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে উঠছে, যেগুলোয় উৎপাদিত বিদ্যুতের ৯০ শতাংশ ভারতে আমদানি করা হবে। এ জন্য আলিপুরদুয়ারের মরিচবাড়ি ও পোরোরপাড়ে সাবস্টেশন তৈরির ২৫-৩০ একর জমি চিহ্নিত করেছে গ্রিড কর্পোরেশন। কিন্তু সেখানেও ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের আপত্তির কারণে ওই জমি এখনও কর্পোরেশনের হাতে আসেনি। এতে ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আনার আন্তর্জাতিক চুক্তিটিও ধাক্কা খেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রকের একটি মহল।
এই পরিস্থিতিতে দিল্লির কী অবস্থান?
মন্ত্রকের এক কর্তা জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার জোর করে জমি নেওয়ার বিরুদ্ধে। এটা সরকারের ঘোষিত নীতি। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কথা ভেবে রাজ্য এখন কী সিদ্ধান্ত নেয়, কেন্দ্র সে দিকেই তাকিয়ে আছে। ওই কর্তার আক্ষেপ, “রায়গঞ্জেও গ্রিডের একটা সাবস্টেশন তৈরির পরিকল্পনা ছিল। তার মারফত সিকিমের জলবিদ্যুৎ বিভিন্ন
রাজ্যে পাঠানোর কথা। জমি-জটে আটকে গিয়েছে সেটাও।” |