১৯৮৪ সালের কথা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে খুনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হল জঙ্গি-সংগঠন আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি। হুঁশিয়ারি এল, “আজকে ভাগ্য আমাদের সহায় হল না ঠিকই, কিন্তু মনে রেখো, ভাগ্য শুধু এক বার সহায় হলেই কাম তামাম আমাদের। তোমাদের কিন্তু ভাগ্যের সাহায্য পেতে হবে প্রত্যেক বার।”
হুঁশিয়ারিটা দেওয়া হয়েছিল ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের। তাঁরাই খুনের ছক আগাম জানতে পেরে তা ভেস্তে দিয়েছিলেন। এ দেশের গোয়েন্দারা প্রায়ই আফশোস করেন, যে সব সন্ত্রাসবাদী হামলার ছক আগাম ভেস্তে দেওয়া হয়, কেউ তার খবর রাখে না। কিন্ত কোথাও কোনও নাশকতা হলেই গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েন। গোয়েন্দা ব্যবস্থার ফাঁকফোকর নিয়ে চুলচেরা বিচার শুরু হয়।
এই ‘ফাঁকফোকর’ রুখতেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম প্রস্তাব দিয়েছেন, গোয়েন্দা অফিসারদের জন্য পৃথক ক্যাডার তৈরি করা হোক। প্রশাসন ও পুলিশ অফিসারদের জন্য যেমন বিভিন্ন রাজ্যে আইএএস ও আইপিএস ‘ক্যাডার’ রয়েছে, গোয়েন্দা বাহিনীর জন্যও তেমন আলাদা ‘ক্যাডার’ তৈরি হোক। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই অফিসাররা শুধু রাজ্য পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ (এসবি) বা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী (আইবি)-তে কাজ করবেন। তাদের অন্যত্র বদলি করা হবে না। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে আলোচ্যসূচিতে রাখা হয়েছিল বিষয়টি। সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে নরেন্দ্র মোদী-সহ বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের তোপের মুখে পড়েন পি চিদম্বরম। কিন্তু গোয়েন্দা বাহিনীর জন্য আলাদা ‘ক্যাডার’ তৈরির বিষয়ে তিনি অধিকাংশ মুখ্যমন্ত্রীরই সমর্থন পেয়েছেন। খোদ মোদীর কথায়, “গোয়েন্দাদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস ও পুলিশ সার্ভিসের মতো সর্বভারতীয় স্তরে ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস চালু করা হোক।’
পোড় খাওয়া গোয়েন্দা-কর্তা কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অভিজ্ঞ আমলাদের মতে, এখন রাজ্য পুলিশে যে সব অফিসারদের ভুঁড়ি হয়ে যায় বা তদন্তে নেমে কূলকিনারা খুঁজে পান না, তাদেরই এসবি-তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আইবি-তে আবার অনেকেই রাজ্য পুলিশ বা কেন্দ্রীয় বাহিনী থেকে বদলি হয়ে আসেন। কয়েক বছর পরে পদোন্নতি পেয়ে বদলি হয়ে যান। সমস্যাটা সেখানেই। প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব গোপালকৃষ্ণ পিল্লাইয়ের যুক্তি, “সন্ত্রাসবাদীদের গতিবিধির খোঁজ রাখাটাই গোয়েন্দাদের কাজ। এ জন্য তাঁদের নিজস্ব সোর্স নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হয়। কিন্তু সেটা গড়ে তোলার পরে কেউ বদলি হয়ে যাওয়ার অর্থ, সোর্স নেটওয়ার্কটাও নষ্ট হয়ে যাওয়া। সে জন্যই দরকার পেশাদার আলাদা ক্যাডার।”
আইবি-র প্রাক্তন যুগ্ম-নির্দেশক মলয়কৃষ্ণ ধর কিন্তু মনে করছেন, পৃথক ‘ক্যাডার’ গড়ে তোলাটাই একমাত্র সমাধান নয়। তাঁর যুক্তি, “ব্রিটিশ-জমানায় বা তার পরেও গোয়েন্দাদের পৃথক ক্যাডার ছিল না। আইপিএসের প্রশিক্ষণ চলাকালীনই চৌকস অফিসারদের চিহ্নিত করে, পরে আইবি-তে নিয়ে আসা হত। এখন ফের সেই ব্যবস্থাই চালু করা হোক।”
ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা ওই ব্যবস্থা তুলে দিয়ে রাজ্য পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনী বা অন্য জায়গা থেকেই অফিসারদের গোয়েন্দা শাখায় বদলি করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা চালু হয় ইন্দিরা গাঁধীর জমানায়। কিন্তু তাতে আইবি-তে স্পষ্ট দু’টি গোষ্ঠী তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এক দল ‘হার্ডকোর’ গোয়েন্দা অফিসার, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আইবি-তেই থেকে যান। অন্য দলটি বদলি হয়ে আসেন, আবার ফিরে যান। মলয়বাবুর মতে, “গোয়েন্দা শাখায় অনেকেই থাকতে চান না। উপরি আয়ের সুযোগও কম। তাই পৃথক ক্যাডার তৈরি না করে গোয়েন্দা বাহিনীতে পদোন্নতির সুযোগ ও বিশেষ ভাতার বন্দোবস্ত করাটা বেশি জরুরি। যাতে ভাল অফিসাররা গোয়েন্দা শাখায় আসতে ইচ্ছুক হন।”
আলাদা ‘ক্যাডার’ গড়ার কথা বললেও চিদম্বরমও চান রাজ্য সরকারগুলি গোয়েন্দা অফিসারদের জন্য বিশেষ ভাতা ও প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করুক। মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে সেই আবেদনও রেখেছেন তিনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মতে, গোয়েন্দা-তথ্য জোগাড়ের ক্ষেত্রে রাজ্যের গোয়েন্দা শাখাগুলি যথেষ্টই পিছিয়ে রয়েছে। তাই জাতীয় স্তরের বদলে রাজ্য স্তরেই পৃথক ক্যাডার গড়ে তোলাটা বেশি প্রয়োজন বলে পিল্লাইয়ের যুক্তি। কারণ, গোয়েন্দাদের স্থানীয় ভাষা ও এলাকা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া প্রয়োজন। ২০০৮ সালে ২৬/১১-র মুম্বই-হামলার পর থেকেই রাজ্যগুলিকে স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ বা গোয়েন্দা শাখা ঢেলে সাজার কথা বলে আসছে কেন্দ্র। মলয়বাবু ও পিল্লাই, দু’জনেরই মত, সেটারই প্রয়োজন সব থেকে বেশি। মহারাষ্ট্র-সহ কয়েকটি রাজ্য ইতিমধ্যেই গোয়েন্দা শাখার পৃথক ক্যাডার তৈরি করেছে। কিন্তু বাকি রাজ্যগুলির থেকে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে সংঘাতের মধ্যেও এই বিষয়ে কতটা সাড়া মেলে, সে দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন চিদম্বরম। |