‘ঘৃণ্য’ সিপিএম কর্মীদের সঙ্গে ‘সামাজিক সম্পর্ক’ রাখতে বারণ করছেন তাঁদেরই ‘বালু’ শুনে বিশ্বাস করতে পারছেন না মন্তেশ্বরের বামুনপাড়া গ্রামের মানুষ। তাঁরা শুধু অবাক নন, মর্মাহত।
সিপিএমের প্রতি ‘ঘৃণা’ জাগিয়ে রাখার ডাক দিয়ে যিনি আপাতত নিন্দা ও বিতর্কের কেন্দ্রে, রাজ্যের সেই খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকই তাঁদের ‘বালু’। বর্ধমানের ওই গ্রামেই তাঁর বাস্তুভিটে। বহু আত্মীয়-স্বজন ছড়িয়ে। যাঁদের অনেকেই সিপিএমের সক্রিয় নেতা-কর্মী। তাঁদের বাড়িতে, উৎসবে-অনুষ্ঠানে মন্ত্রীর যাতায়াতও আছে। সে সব বেমালুম ভুলে গিয়ে তিনি এমন ‘ফরমান’ দিতে পারেন, গ্রামের প্রায় কেউই সেটা ভাবতে পারছেন না।
বামুনপাড়ার সিপিএম নেতা তপন মল্লিক সম্পর্কে খাদ্যমন্ত্রীর ভাইপো। ১৯৮৩ সালে তিনি বামুনপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য হন। এর পরে টানা দশ বছর মন্তেশ্বর পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যও ছিলেন। বুধবার তিনি বলেন, “ভিন্ন দল করলে তো আর আত্মীয়তা নষ্ট হয় না! আমরা ওঁর পরিবারের সদস্য হিসেবে বিয়ে-পৈতেয় যোগ দিয়ে আসছি।” মাস দেড়েক আগে ওই গ্রামেই সহায়ক মূল্যে সরকারি ধান সংগ্রহের শিবির বসে। খাদ্যমন্ত্রী সেখানে এসেছিলেন। সেই শিবিরের পরে তপনবাবুদের বাড়িতে চা-জলখাবার খেয়ে, গল্পগুজব করেই তিনি ফেরার গাড়িতে ওঠেন। তপনবাবুর বিস্ময়, “উনি কী করে এমন ফতোয়া দিলেন, বুঝলাম না।” জ্যোতিপ্রিয়বাবু অবশ্য এই অন্তরঙ্গতার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, “সিপিএম করা কোনও আত্মীয়ের সঙ্গে আমি কথাই বলি না। আমি তো এখন মন্ত্রী। তাই সুযোগ পেয়ে অনেকেই আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা বলছে।”
জ্যোতিপ্রিয়বাবু অবশ্য এক সময়ে বারবার অভিযোগ করতেন, আটের দশক থেকে ‘সিপিএমের অত্যাচারে’ তিনি গ্রামে ঢুকতে পারতেন না। লোকসভা নির্বাচনের পরে পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে গ্রামে ঢুকতে পারেন। কয়েক মাস আগে বর্ধমানের ভাতারে ধান কেনার শিবিরে গিয়েও তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “সিপিএম আগে বারবার আমাদের জমির ধান কাটায় বাধা দিয়েছে। কিন্তু জমানা বদলে গিয়েছে। এখন শুধু আমায় কেন, গ্রামের কাউকেই ওরা আর আটকে রাখতে পারবে না।” এ দিন বামুনপাড়া পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সিপিএম প্রধান মদন ঘোষ অবশ্য পাল্টা দাবি করেন, “বালুর গোটা অভিযোগটাই মিথ্যে। মাত্র এক বার ওঁর জমির ধান কেটে নেয় কংগ্রেস সমর্থকেরা। সেই ধান পঞ্চায়েত অফিসে আটকে রেখে আমরাই ওঁর পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আমরা কোনও দিনই বালুকে বিপাকে ফেলিনি। সেই কী না এখন আমাদের সামাজিক ভাবে বয়কট করতে বলছে!” এই সব কটাক্ষ কার্যত উড়িয়ে দিয়ে জ্যোতিপ্রিয়বাবু এ দিন ফের বলেন, “আমি সিপিএমের কাউকে খুন করতে বলিনি। আমি শুধু তৃণমূল কর্মীদের বলেছি, ওদের বিয়েবাড়িতে যাবেন না। চায়ের দোকানে, বাজারে ওদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারবেন না। তা হলে আপনারা দুর্বল হয়ে যাবেন।”
গ্রামবাসীর একাংশও খাদ্যমন্ত্রীর ফতোয়ায় ‘নতুন’ কিছু দেখছেন না। তাঁদের মতে, জ্যোতিপ্রিয়বাবুর মতো মাইক ফুঁকে না বললেও সিপিএমও তাদের জমানায় মানুষজনের ব্যক্তিগত সম্পর্কে নাক গলিয়ে এসেছে। কর্মীরা কার সঙ্গে কতটা মিশবে, তা পার্টিই অনেকটা ঠিক করে দিত, এমনকী এখনও দেয়। জ্যোতিপ্রিয়বাবুরা সেই ধারাই বহন করছেন মাত্র। তবে বামুনপাড়ার বহু সাধারণ মানুষ মন্ত্রীর কথায় আঘাত পেয়েছেন। বিকাশ ঘোষ নামে এক সিপিএম সমর্থকের কথায়, “আমরা বড্ড দুঃখ পেয়েছি। এত দিনের একটা সুস্থ সুন্দর সম্পর্ক শেষে এ ভাবে নষ্ট হবে!” স্থানীয় বড়পলাশন হাইস্কুলের শিক্ষক সৌরেন মুখোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, “উনি এ সব কী যা-তা বলছেন! গোটা গ্রামের মানুষ ছি ছি করছেন। কে কার সঙ্গে মিশবে, তা কি এ ভাবে ঠিক করে দেওয়া যায়? এতে গ্রামের মানুষের মধ্যেই ভুল বোঝাবুঝি, অশান্তি বাড়বে।”
জ্যোতিপ্রিয়বাবু অবশ্য এ নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নন। তিনি বরং বলেন, “ভুল বোঝাবুঝি হলে আমার কিছু করার নেই।” |