সবার উপরে জীবন সত্য
প্রিয়াঙ্কার কথা
প্রিয়াঙ্কার বাবা একটু চুপচাপ ধরনের। অফিস থেকে ফিরে টিভির সামনে বসে থাকা তাঁর অভ্যেস। প্রিয়াঙ্কার মা ব্যস্ত থাকতেন সংসার নিয়ে, যার অনেকটাই হল মেয়ের জন্য সব কিছু গুছিয়ে রাখা। তিনি নিজে ভাল ছাত্রী ছিলেন, বিয়ের পরে পড়াশোনা হয়নি। তাঁর ইচ্ছে, প্রিয়াঙ্কা পড়াশোনায় ভাল হোক। প্রিয়াঙ্কা পড়াশোনায় খারাপ নয়, কিন্তু ওর মায়ের মনে সর্বদাই আশঙ্কা এই বুঝি মেয়ে ফাঁকি দিল, নম্বর কম পেল। সারা দিন ধরে তিনি মেয়ের জন্য ভাল খাবার তৈরি করতেন, যাতে তার পুষ্টি ঠিক হয়। মেয়ের বন্ধুদের মায়েদের ফোন করে জেনে নিতেন কে কোন টিউটরের কাছে পড়ছে সেরা শিক্ষকের হাতে দিতে হবে মেয়েকে। প্রিয়াঙ্কাকে নাচের স্কুলেও দিয়েছিলেন, নাচের প্রোগ্রামের আগে নিজে কলকাতা ঘুরে ওর সাজের উপকরণ কিনতেন।
ক্লাস সেভেন পর্যন্ত প্রিয়াঙ্কা বেশ বাধ্য, শান্ত ছিল। কিন্তু তার পর ওর রাগ ক্রমশ বেড়ে যেতে লাগল। মা যা করেন তা ওর পছন্দ হয় না। নাইনে ওঠার পর থেকে প্রিয়াঙ্কা প্রায়ই অন্যমনস্ক, খিটখিটে হয়ে থাকত। ওর শিক্ষকেরাও বলতেন যে ও অমনোযোগী হয়ে যাচ্ছে। বাবাও চিন্তিত হতে শুরু করলেন। এর মধ্যে এসে পড়ল স্কুল শেষের পরীক্ষা। প্রিয়াঙ্কা পাশ করেছে। তবে নম্বর ভাল নেই। নিজের স্কুলে পড়ার সুযোগ পেল না, পাড়ার চেনাজানা স্কুলে ভর্তি হল।
স্কুলে প্রিয়াঙ্কার বন্ধু ছিল শমিতা। যে দিন ও জানল শমিতা নিজেদের স্কুলেই ভর্তি হয়েছে সে দিন রাত্রে প্রিয়াঙ্কা আত্মহত্যার চেষ্টা করল। এক টুকরো কাগজে ও লিখে রেখেছিল, ‘মা আমি শমিতার মতো ভাল নই, তাই চললাম।’ শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছিল প্রিয়াঙ্কা। মনোবিদের চেম্বারে বসে বলেছিল, ‘আমি এতটাই অপদার্থ যে পড়াশোনা করতে পারি না, কোনও কাজও শিখিনি, এমনকী মরতেও পারি না।’ ওর মা হতবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে ছিলেন; বুঝতে পারছিলেন না কোথায় তাঁর হিসেবে ভুল হয়ে গেল।

ভাল রেজাল্ট নয়তো মৃত্যু?
ভারতে মোট আত্মহত্যার চল্লিশ শতাংশের কাছাকাছি ঘটায় বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা। বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা, শেষ পরীক্ষার ফলাফল বেরোবার পর। ভাল ফল হয়েছে, কিন্তু আশানুরূপ হয়নি বলে আত্মহত্যা করেছে, এমন নজিরও অনেক। পরীক্ষার রেজাল্টকে যখন এদের মানসিক অসুখ বা আত্মহত্যার চেষ্টার কারণ হিসেবে দেখানো হয়, তা কিছুটা ঠিক, কিছুটা ভুল। রেজাল্ট শেষ ঘটনাটাকে ঘটতে সাহায্য করে, তার জমি তৈরি থাকে অনেক আগে থেকেই। প্রিয়াঙ্কার মা-বাবা বার বার বলছিলেন, ‘রেজাল্ট খারাপ হয়েছে বলে তো আমরা ওকে বেশি বকাবকি করিনি। তবে কেন ও এমন করল?’


গভীর গোপন অ-সুখ
অসুখ সুখের অভাব। আনন্দের অভাব। প্রিয়াঙ্কা কি আনন্দে ছিল? ও আদরযত্ন পেত। ওর দামি মোবাইল ছিল, ফ্যাশনেবল পোশাক ছিল, টিফিনে চিকেন চাউমিন ছিল, নাচের প্রোগ্রামে হাততালি ছিল। ভাল ছিল পড়াশোনাতেও। সবাই ভাবত ও সুখেই আছে। প্রিয়াঙ্কাও জানায়নি ওর কষ্টের কথা। কিন্তু আত্মহত্যার চেষ্টা বিফল হওয়ার পর ওকে যখন একান্তে প্রশ্ন করা হল, একটা মানসিক অবসাদের ছবি বেরিয়ে এল।
এ রকম নয় যে প্রশ্ন করা মাত্রই প্রিয়াঙ্কা তার দুঃখের কথা বলতে শুরু করে দিয়েছিল। আসলে ও নিজেই ঠিক জানত না যে ও সুখে নেই। সুখ আর দুঃখ কী, সেই ভাষাও তো আমরা বাবা-মায়ের কাছেই শিখি। প্রিয়াঙ্কা ভেবেছিল যে দামি জিনিসপত্র থাকা, বন্ধুদের সঙ্গে হইহই করাকে সুখ বলে। সে জেনেছিল তার ভূগোলের নম্বর কম হলে মা-বাবার মনে দুঃখ হয়; অঙ্কে পুরো নম্বর পেলে সুখ হয়। অথচ একটা দামি জামা কিনলে, টিভিতে পছন্দের ছবি দেখলে তার সুখ হয় বটে কিন্তু সেই সুখ অনেকক্ষণ টেকে না। আর মা-বাবার পছন্দ অনুসারে কাজ না করলে, পড়াশোনায় ফাঁকি দিলে মনে হয় অপরাধ হল, রাগ হয়, কষ্ট হয় কিন্তু এ কথা কি বলা যায় যে ‘তোমরা আমার ভাল চাও বলে আমার বিরক্ত লাগছে?’
একটা বয়সের পর প্রিয়াঙ্কার আচরণেও এই মনোভাব প্রকাশ পেত। বাবা-মা বলতেন ও ফাঁকি দিচ্ছে, অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে। আসলে ও চেষ্টা করত রূঢ়তাকে চেপে রাখার। ওর বলতে ইচ্ছে করত, ‘তোমরা আমাকে আমার মতো বাঁচতে দিচ্ছ না কেন? সুখের উপকরণ দিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতার ফাঁসে বেঁধে রেখেছ। আমার রেজাল্ট দিয়ে, কেরিয়ার দিয়ে কি এর দাম চুকোতে হবে? এই লেনদেনের ভেতর তো আমি যেতে চাইনি।’ কিন্তু জীবনের হিসেব তো জীবনের গোড়াতেই ভুল হয়ে গিয়েছে। নেওয়া হয়ে গিয়েছে; দাম তো দেওয়া গেল না। অথচ দাম দিতে পেরেছে শমিতা। নিজের এলোমেলো আবেগের জটে পথ হারিয়ে ফেলে প্রিয়াঙ্কা কিন্তু প্রিয়াঙ্কার মনে হয় পথ খুঁজে পেয়েছে ও। সুখের ছদ্মবেশধারী অ-সুখের উপকরণ থেকে চিরকালের মতো বেরিয়ে গেলেই মুক্তি।
প্রিয়াঙ্কার বাবা-মা হতবাক হয়ে যান। মেয়ের কাছে কি আমরা কিছু দাবি করেছি নাকি কোনওদিন? কবে আমরা ওকে বলেছি যে রেজাল্ট ভাল না করলে ভালবাসব না? সত্যি বোধ হয় দুজনের কথাই। ভালবাসা আছে, ভালবাসার অন্তরালে লেনদেনও আছে। সত্যি কি ওর বাবা-মা কখনও ভেবেছেন যে ও শুধু থাক, ভাল থাক? মনে হয়েছে কি, যদি ওর আনন্দ আমাদের আনন্দের সঙ্গে না মেলে তা হলে আমরা ওর দিকটাই ভাবব? যদি মনে হয়ে থাকে, সে কথা মেয়েকে কি বলেছিলেন, মুখে শুধু নয়, আচরণে?


কেন এ রকম করি?
‘জানি, চাপ দেওয়া ঠিক নয়, তবু চাপ দিয়ে ফেলি কেন এ রকম করি?’ এই কেন-র উত্তর অনেক। দোষ সর্বদা বাবা-মায়ের নয়, বরং বেশি সমাজের, শিক্ষা ব্যবস্থার। যে শিক্ষা ব্যবস্থা আশৈশব সৃষ্টিশীলতার বদলে, নিজস্ব ভাবনাচিন্তা গঠনের বদলে, বাধ্যতা, গতানুগতিকতা আর অনুকরণ শেখায়, যে সমাজ বড় বড় কথা বলেও শেষ পর্যন্ত সকলের জন্য সমমানের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে না, অথচ নম্বরের ভিত্তিতে বেঁচে থাকার মূল্য নির্ধারণ করে, দোষ তাদের। দোষ সেই সব বিজ্ঞাপনের, পুরস্কারের নীতির, যা গুণগত বৈচিত্র্যকে অবহেলা করে এমন ছবি তুলে ধরে যেন স্কুলের রেজাল্ট ভাল হওয়ার উপরে জীবনের সব কিছু নির্ভর করছে। বাবা-মায়েরা, ছেলেমেয়েরাও সহজে সেই ভাবনার বাইরে যেতে পারেন না।
কিন্তু এগুলি তো আমাদের হাতের বাইরে। তা হলে কী উপায়? ধরা যাক, আমি এমন জায়গায় বাস করি, যেখানে অনেকে দূষিত খাদ্যকে ভাল বলে মনে করেন। আমি কি আমার শিশুকে শেখাব যে এই খাদ্যই পুষ্টিকর? বরং আমি চেষ্টা করব তাকে যথার্থ পুষ্টিকর খাবার দিতে। বাবা-মা শিশুকে শেখান কাটা ফল, রঙিন জল খেতে নেই। পরিবর্ত খাবার দেওয়ার জন্য তাঁরা চেষ্টা করেন। সেই বাবা-মায়েরাই পড়াশুনোর বেলা এ কথা বলেন যে, ‘আসলে অত নামী স্কুল, বড্ড কড়া, তাই উচিত হচ্ছে না বুঝেও চাপ দিতে হয়’।
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমরা, বাবা-মায়েরা উদ্বেগে ভুগি। সমাজের দিশাহারা পরিস্থিতিতে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনচর্চার উদ্বেগ, অপূর্ণ আশার দুঃখ, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অস্পষ্টতা সব মিলিয়ে ভাবলে সুবিধা হয় যে শিশুটিই সব সমস্যার সমাধান। কিন্তু, প্রিয়াঙ্কা যেমন বলেছিল, শিশুটিকে তো কেউ এই শর্ত আগে বলে দেয়নি, সে হয়তো একটা ফাঁদে পড়ে গিয়েছে যে ফাঁদের নাম জীবন।


জীবনের ফাঁদ থেকে বেরোবার জন্য
পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না হওয়ার পরে আবেগের এই পুরো ইতিহাসটি মনের মধ্যে পুনরাবৃত্ত হতে পারে। এর সঙ্গে জড়িয়ে যায় সম্পর্কের টানাপোড়েন, পারিবারিক সমস্যা, একাকিত্বের কষ্ট। প্রিয়াঙ্কার মতো কেউ কেউ ভেবে বসে ‘চললাম’। ‘চললাম’ বলে চলা অবশ্য তত সহজ নয়। জীবন আমাদের টানে, সব বয়সেই। তাই দেখা যায় যে, যারা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, তাদের অনেকেই প্রিয়জনদের কাছে নিজের যন্ত্রণা, চরম সিদ্ধান্তের দিকে যাবার চিন্তা পৌঁছে দেবার চেষ্টা করে। এ যেন সাহায্যের জন্য একটা আকুতি কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা অনেক সময় এই ডাক শুনতেই পাই না। সামান্য কিছু ক্ষেত্রে আত্মহত্যা আকস্মিক হতে পারে বটে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘদিনের দুঃখ কোনও ঘটনার সঙ্গে মিশে যায়, তার পর আসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর্যায়, অবশেষে আত্মহত্যা। আত্মহত্যা একটা প্রক্রিয়া, যার শেষে পৌঁছনোর আগে সময় থাকে ফেরবার, ফেরাবার।

কেমন করে বুঝব ওর মনের কথা?
কিশোরীটি নিজেই হয়তো বলে, ‘এ ভাবে বেঁচে থাকার মানে নেই’, কিংবা আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে’। কখনও তার কথার মধ্যে এমন ভবিষ্যতের আভাস থাকে, যখন সে থাকবে না। কথার কথা, মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বলা ভেবে এগুলি আমরা অবহেলা করি। এটা কথার কথা হতেও পারে, কিন্তু তবুও এই ধরনের কথা শুনলে সাবধান হওয়া দরকার। যদি বিচারে ভুল হয়ে যায়, তবে ফেরার পথ না থাকতেও পারে।
অনেক সময় আমাদের মনে হয় আমাদের সন্তানটি নিজের মনে ভালই আছে। কিন্তু আসলে হয়তো ও একা। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সহানুভূতির চেয়ে অনেক সময় বড় হয়ে ওঠে প্রতিযোগী মনোভাব। সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে মুখ ডুবিয়ে বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা কম্পিউটারের পর্দার বাইরে বেরোয় না। যে আত্মহত্যার কথা ভাবছে, সে এই সময় আরও বেশি গুটিয়ে যায়। আমরা হয়তো ভাবি রেজাল্ট খারাপ হয়েছে বলে ওর মন খারাপ। তখনই হয়তো ওর মনের মধ্যে চলছে চূড়ান্ত টানাপোড়েন। কখনও দেখা যায় কিশোরটির অভ্যস্ত ব্যবহারের একটু বদল। হয়তো প্রিয় জিনিসগুলি বিলিয়ে দিল, খাওয়ায়, ঘুমে বদল, অভ্যাসের বদল, পছন্দের কাজে অনীহা, কখনও বেশি রাগের প্রকাশ, কখনও ভিতরে একটু বৈরাগ্যের আভাস। এগুলি খারাপ রেজাল্টের ফলে তাৎক্ষণিক দুঃখ হতে পারে, কিন্তু হতে পারে গভীর বিষাদের চিহ্ন। যে আত্মহত্যার প্ল্যান করছে, সে স্পষ্ট বলে না কিন্তু যাচাই করে দেখে জীবন এখনও ওকে চায় কি না। কথাবার্তায় আশাহীনতা, অপরাধবোধ, জীবনের অর্থহীনতার আভাস ভেসে আসে। ওর কথার সুরটুকু শুনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই।
সঠিক ভাবে বোঝা যায় না সব সময়। ছোটদের বিষণ্ণতা, অবসাদের প্রকাশ বড়দের মতো নয়। তাই সন্তানের আত্মহত্যার পর প্রায়ই বাবা-মায়েদের মনে বেদনার পাশাপাশি থাকে বিস্ময় আর গ্লানি। কী হয়েছিল ওর? আমি কি এত স্বার্থপর ছিলাম যে ওর মনটাকে দেখতে পাইনি?


আত্মহত্যা কি সমাধান?
দেখা যাক চিরকালের মতো লাঞ্ছনার বাইরে পালিয়ে যেতে ইচ্ছুক খারাপ রেজাল্ট করা কিশোর মনটিকে। আমরা যে বয়সে যে ঘটনার ভেতরে থাকি, সেটাকেই বড় মনে হয়। চল্লিশ বছর বয়সে বোঝা যায় কুড়ি বছরের আবেগগুলির তত মূল্য ছিল না। আজকের খারাপ রেজাল্ট আজকের দিনে যতটা গ্লানি এনে দিচ্ছে, আগামী দিনে তা দেবে না। বরং সত্যি যদি উঠে দাঁড়ানো যায় এই পর্যায় থেকে, তার গৌরব হবে বেশি। যদি রেজাল্ট ভাল না হয়? তা হলেও খোলা আছে অন্য পথ। এমনকি গতানুগতিক ধারায় চাকরি পাবার পথও স্কুলের রেজাল্টের ভিত্তিতে বন্ধ হয় না। নানা ধরনের বৃত্তিমূলক কাজ শেখারও অবকাশ আছে, আছে ব্যবসার পরিসর। তাই একটা রেজাল্টে জীবনের, সমাজের দরজা বন্ধ হয়ে যায় না।
আত্মহত্যার চিন্তা, বিষাদ, বাবা-মায়ের বকাঝকা সবই মনকে গ্রাস করতে পারে। কিন্তু কোথাও কি কিশোরটিরও দায়িত্ব থাকে না বাবা-মার কাছে নিজেকে মেলে ধরার, স্পষ্ট করে বলার ‘আমার কষ্ট হচ্ছে, আমাকে একটু আদর কর’। সম্পর্ক, ভালবাসা এগুলি সবই দ্বিমুখী ভালবাসা প্রকাশ করার, চাওয়ার দায়িত্ব দু’জনেরই।


ভালবাসাই সমাধান
যদি বোঝা যায় যে, সন্তানের মনের মধ্যে আত্মঘাতী ইচ্ছা বাসা বাঁধছে, তা হলে তখনই কিছু করতে হবে। অনেক সময় বাবা-মায়েদের মনে হয় যে সন্তানের আত্মহননের চিন্তা তাঁদের ভালবাসার প্রতি নেতিবাচক ইঙ্গিত, তাই সেই সত্যকে চোখ মেলে দেখতেও চান না। কিন্তু সন্তানের সম্পর্কও ধীরে ধীরে গড়ে তোলার জিনিস আশৈশব খুলে রাখা দরকার আন্তরিক কথোপকথনের জানলাগুলি, যাতে দুঃখে, ভয়ে, রাগে বাবা-মায়ের কাছে মন খুলে নিজেকে প্রকাশ করতে তার দ্বিধা না হয়।
যদি মনে হয় সন্তানের মনে আত্মঘাতী চিন্তার ছায়া পড়ছে, তবে তার সঙ্গে স্পষ্ট করে কথা বলতেই হবে ভয় পেলে চলবে না। তাকে জানাতে হবে যে তাকে, তাকেই আমরা ভালবাসি তার রেজাল্টকে নয়। প্রয়োজনে কথা বলতে হবে তার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, অনেক সময় তাদের কাছে তথ্য থাকে।
অনেকে ভাবে, যারা বারবার আত্মহত্যার কথা বলে, চেষ্টা করে, তারা শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে না। এই ধারণাটি ভুল। যাদের বিষাদের ইতিহাস আছে, যারা একাধিক বার আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা করেছে, তাদের মধ্যেই আত্মহত্যার সম্ভাবনা বেশি। তাই জেনে নিতে হবে, ও আগে এ রকম ভেবেছে কি না, চেষ্টা করেছে কি না। প্রয়োজনে কথা বলতে হবে স্কুলের সঙ্গেও। যে সব স্কুল নিখুঁত ছাত্র বানাতে গিয়ে অতিরিক্ত চাপ দেয়, সেখানে প্রয়োজনে ‘পেরেন্ট টিচার মিটিং’-এ সরব হতে হবে একটি ছাত্রকে হারিয়ে তার পর স্কুলের নীতি বদলানোর চেয়ে সম্ভাবনাকেই রোধ করা যে ভাল, এটা স্কুলেরও বোঝার দরকার।
আসলে, আমরা বেঁচে থাকি ভালবাসার জন্যই। শরীরে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য দরকার, মনে বেঁচে থাকার জন্য দরকার ভালবাসা। বাবা-মা হিসেবে আমাদের একটিই প্রার্থিত হোক আমার সন্তান যেন ভালবাসা পায়, সেই ভালবাসাকে গ্রহণ করে, আর অন্যকে ভালবাসার ক্ষমতা রাখে। কোনও রেজাল্টের মূল্য এই চাওয়ার চেয়ে বেশি নয়।


জীবনের ফাঁদ থেকে বেরোবার জন্য
পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না হওয়ার পরে আবেগের এই পুরো ইতিহাসটি মনের মধ্যে পুনরাবৃত্ত হতে পারে। এর সঙ্গে জড়িয়ে যায় সম্পর্কের টানাপোড়েন, পারিবারিক সমস্যা, একাকিত্বের কষ্ট। প্রিয়াঙ্কার মতো কেউ কেউ ভেবে বসে ‘চললাম’। ‘চললাম’ বলে চলা অবশ্য তত সহজ নয়। জীবন আমাদের টানে, সব বয়সেই। তাই দেখা যায় যে, যারা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, তাদের অনেকেই প্রিয়জনদের কাছে নিজের যন্ত্রণা, চরম সিদ্ধান্তের দিকে যাওয়ার চিন্তা পৌঁছে দেবার চেষ্টা করে। এ যেন সাহায্যের জন্য একটা আকুতি কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা অনেক সময় এই ডাক শুনতেই পাই না। সামান্য কিছু ক্ষেত্রে আত্মহত্যা আকস্মিক হতে পারে বটে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘদিনের দুঃখ কোনও ঘটনার সঙ্গে মিশে যায়, তার পর আসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর্যায়, অবশেষে আত্মহত্যা। আত্মহত্যা একটা প্রক্রিয়া, যার শেষে পৌঁছনোর আগে সময় থাকে ফেরবার, ফেরাবার।

কেমন করে বুঝব ওর মনের কথা?
কিশোরীটি নিজেই হয়তো বলে, ‘এ ভাবে বেঁচে থাকার মানে নেই’, কিংবা ‘আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে’। কখনও তার কথার মধ্যে এমন ভবিষ্যতের আভাস থাকে, যখন সে থাকবে না। কথার কথা, মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বলা ভেবে এগুলি আমরা অবহেলা করি। এটা কথার কথা হতেও পারে, কিন্তু তবুও এই ধরনের কথা শুনলে সাবধান হওয়া দরকার। যদি বিচারে ভুল হয়ে যায়, তবে ফিরে আসার পথ না থাকতেও পারে।
অনেক সময় আমরা ভাবি, আমাদের সন্তানটি নিজের মনে ভালই আছে। কিন্তু আসলে হয়তো ও একা। বন্ধুবান্ধবদের ক্ষেত্রে সহানুভূতির চেয়ে অনেক সময় বড় হয়ে ওঠে প্রতিযোগী মনোভাব। সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে মুখ ডুবিয়ে বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা কম্পিউটারের পর্দার বাইরে বেরোয় না। যে আত্মহত্যার কথা ভাবছে, সে এই সময় আরও বেশি গুটিয়ে যায়। আমরা হয়তো ভাবি রেজাল্ট খারাপ হয়েছে বলে ওর মন খারাপ। তখনই হয়তো ওর মনের মধ্যে চলছে চূড়ান্ত টানাপোড়েন। কখনও দেখা যায় কিশোরটির অভ্যস্ত ব্যবহারের একটু বদল। হয়তো প্রিয় জিনিসগুলি বিলিয়ে দিল, খাওয়ায়, ঘুমে বদল, অভ্যাসের বদল, পছন্দের কাজে অনীহা, কখনও বেশি রাগের প্রকাশ, কখনও ভিতরে একটু বৈরাগ্যের আভাস। এগুলি খারাপ রেজাল্টের ফলে তাৎক্ষণিক দুঃখ হতে পারে, কিন্তু হতে পারে গভীর বিষাদের চিহ্ন। যে আত্মহত্যার প্ল্যান করছে, সে স্পষ্ট বলে না কিন্তু যাচাই করে দেখে জীবন এখনও ওকে চায় কি না। কথাবার্তায় আশাহীনতা, অপরাধবোধ, জীবনের অর্থহীনতার আভাস ভেসে আসে। ওর কথার সুরটুকু শুনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই।
সঠিক ভাবে বোঝা যায় না সব সময়। ছোটদের বিষণ্ণতা, অবসাদের প্রকাশ বড়দের মতো নয়। তাই সন্তানের আত্মহত্যার পর প্রায়ই বাবা-মায়েদের মনে বেদনার পাশাপাশি থাকে বিস্ময় আর গ্লানি। কী হয়েছিল ওর? আমি কি এত স্বার্থপর ছিলাম যে ওর মনটাকে দেখতে পাইনি?


আত্মহত্যা কি সমাধান?
দেখা যাক চিরকালের মতো লাঞ্ছনার বাইরে পালিয়ে যেতে ইচ্ছুক খারাপ রেজাল্ট করা কিশোর মনটিকে। আমরা যে বয়সে যে ঘটনার ভেতরে থাকি, সেটাকেই বড় মনে হয়। চল্লিশ বছর বয়সে বোঝা যায় কুড়ি বছরের আবেগগুলির তত মূল্য ছিল না। আজকের খারাপ রেজাল্ট আজকের দিনে যতটা গ্লানি এনে দিচ্ছে, আগামী দিনে তা দেবে না। বরং সত্যি যদি উঠে দাঁড়ানো যায় এই পর্যায় থেকে, তার গৌরব হবে বেশি। যদি রেজাল্ট ভাল না হয়? তা হলেও খোলা আছে অন্য পথ। এমনকি গতানুগতিক ধারায় চাকরি পাবার পথও স্কুলের রেজাল্টের ভিত্তিতে বন্ধ হয় না। নানা ধরনের বৃত্তিমূলক কাজ শেখারও অবকাশ আছে, আছে ব্যবসার পরিসর। তাই একটা রেজাল্টে জীবনের, সমাজের দরজা বন্ধ হয়ে যায় না।
আত্মহত্যার চিন্তা, বিষাদ, বাবা-মায়ের বকাঝকা সবই মনকে গ্রাস করতে পারে। কিন্তু কোথাও কি কিশোরটিরও দায়িত্ব থাকে না বাবা-মার কাছে নিজেকে মেলে ধরার, স্পষ্ট করে বলার ‘আমার কষ্ট হচ্ছে, আমাকে একটু আদর কর’। সম্পর্ক, ভালবাসা এগুলি সবই দ্বিমুখী ভালবাসা প্রকাশ করার, চাওয়ার দায়িত্ব দু’জনেরই।

ভালবাসাই সমাধান
যদি বুঝতে পারা যায় যে, সন্তানের মনের মধ্যে আত্মঘাতী ইচ্ছা বাসা বাঁধছে, তা হলে তখনই কিছু করতে হবে। অনেক সময় বাবা-মায়েদের মনে হয় যে সন্তানের আত্মহননের চিন্তা তাঁদের ভালবাসার প্রতি নেতিবাচক ইঙ্গিত, তাই সেই সত্যকে চোখ মেলে দেখতেও চান না। কিন্তু সন্তানের সম্পর্কও ধীরে ধীরে গড়ে তোলার জিনিস আশৈশব খুলে রাখা দরকার আন্তরিক কথোপকথনের জানলাগুলি যাতে দুঃখে, ভয়ে, রাগে বাবা-মায়ের কাছে মন খুলে নিজেকে প্রকাশ করতে তার দ্বিধা না হয়।
যদি মনে হয় সন্তানের মনে আত্মঘাতী চিন্তার ছায়া পড়ছে, তবে তার সঙ্গে স্পষ্ট করে কথা বলতেই হবে ভয় পেলে চলবে না। তাকে জানাতে হবে যে তাকে, তাকেই আমরা ভালবাসি তার রেজাল্টকে নয়। প্রয়োজনে কথা বলতে হবে তার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, অনেক সময় তাদের কাছে তথ্য থাকে।
অনেক ভাবে, যারা বার বার আত্মহত্যার কথা বলে বা চেষ্টা করে বিফল হয়, তারা শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে না। এই ধারণাটি ভুল। যাদের বিষাদের ইতিহাস আছে, যারা একাধিক বার আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা করেছে, তাদের মধ্যেই আত্মহত্যার সম্ভাবনা বেশি। তাই জেনে নিতে হবে, ও আগে এ রকম ভেবেছে কি না, চেষ্টা করেছে কি না।
প্রয়োজনে কথা বলতে হবে স্কুলের সঙ্গেও। যে সব স্কুল নিখুঁত ছাত্র বানাতে গিয়ে অতিরিক্ত চাপ দেয়, সেখানে প্রয়োজনে ‘পেরেন্ট টিচার মিটিং’-এ সরব হতে হবে একটি ছাত্রকে হারিয়ে তার পর স্কুলের নীতি বদলানোর চেয়ে সম্ভাবনাকেই রোধ করা যে ভাল, এটা স্কুলেরও বোঝার দরকার।
আসলে, আমরা বেঁচে থাকি ভালবাসার জন্যই। শরীরে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য দরকার, মনে বেঁচে থাকার জন্য দরকার ভালবাসা। বাবা-মা হিসেবে আমাদের একটিই প্রার্থিত হোক আমার সন্তান যেন ভালবাসা পায়, সেই ভালবাসাকে গ্রহণ করে, আর অন্যকে ভালবাসার ক্ষমতা রাখে। কোনও রেজাল্টের মূল্য এই চাওয়ার চেয়ে বেশি নয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.