|
|
|
|
কর্মীদের শো-কজ, সাসপেন্ড |
|
ধর্মঘট ‘ভঙ্গে’র দায়ে
ব্যবস্থা নিচ্ছে সিপিএম বরুণ দে • মেদিনীপুর |
|
বাম-সহ একাধিক শ্রমিক সংগঠনের ডাকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ ধর্মঘটে যাঁরা কাজে যোগ দেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ নিতে শুরু করেছে রাজ্য সরকার। এ বার ধর্মঘট ‘ভেঙে’ ওই দিন কাজে যোগ দেওয়ায় দলীয় সদস্যদের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হল সিপিএমে।
ইতিমধ্যেই মেদিনীপুর শহরে ৮ জন লোকাল কমিটির সদস্যকে ‘সাসপেন্ড’ করা হয়েছে। বেশ কয়েক জন সাধারণ পার্টি সদস্যকে ‘শো-কজ’ করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলাতেই ধর্মঘট ‘ভঙ্গ’ করার কারণ জানতে চেয়ে শো-কজ নোটিস পাঠানো হচ্ছে। কী পরিস্থিতিতে তাঁরা ধর্মঘট ভাঙলেন এবং তাঁরা দলের কোন স্তরের কর্মী, তার নিরিখে ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলে সিপিএম সূত্রের ইঙ্গিত। ফেব্রুয়ারির ওই সাধারণ ধর্মঘটের আগে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছিলেন, ধর্মঘটে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি যোগ না-দেওয়ার অধিকারও সকলের আছে। সেটাই যদি সিপিএমের অবস্থান হয়, তা হলে ধর্মঘট ‘ভঙ্গ’ করার জন্য দলীয় স্তরে ‘ব্যবস্থা’ কেন, এমন প্রশ্ন উঠছে রাজনৈতিক শিবিরে।
তবে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমের ব্যাখ্যা, “আমাদের দলের গঠনতন্ত্রেই আছে, দলের ডাকা বা সমর্থিত কোনও ধর্মঘট ভাঙা দল-বিরোধী কাজের পর্যায়ে পড়ে। সেই জন্যই প্রতি বার আমাদের ডাকা বা সমর্থিত ধর্মঘটের পরে কর্মীদের কাছ থেকে খোঁজ নেওয়া হয়। স্বেচ্ছায় তাঁরা যে তথ্য দেন, তার ভিত্তিতে একটা মূল্যায়ন করা হয়। এ বারও তা-ই হচ্ছে। তার জন্যই শো-কজ।” দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের আরও বক্তব্য, “এখন কঠিন সময়। এই পরিস্থিতিতে নানা চাপ সত্ত্বেও কারা দলীয় কর্মসূচি পালন করছেন, সেটাও বুঝে নেওয়া দরকার। এটা একান্তই দলের কর্মীদের উপরে প্রযোজ্য। কোন স্তরের কর্মীরা ধর্মঘটে যোগ দিলেন না, তাঁদের ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে সেই বিষয়ে ভাবা হবে।”
সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বের বক্তব্য, বিষয়টি এখনও কারণ দর্শানোর স্তরে আছে। তবে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় সাসপেনশনও হয়েছে। সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক দীপক সরকার ‘ব্যস্ত’ আছেন জানিয়ে এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে কয়েক জন লোকাল কমিটির সদস্যকে ‘সাসপেন্ড’ করার কথা স্বীকার করে নিয়ে মেদিনীপুর শহর জোনাল কমিটির সম্পাদক কীর্তি দে বক্সি বলেন, “এটা পার্টির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। গঠনতন্ত্র মেনে শৃঙ্খলারক্ষার প্রশ্নে একটা পদক্ষেপ করা হয়েছে।”
সিপিএম সূত্রের খবর, যে সব দলীয় সদস্য ২৮ ফেব্রুয়ারি কাজে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ নেওয়ার দাবি উঠেছিল দলের অন্দরেই। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটিরই একাংশের বক্তব্য ছিল, নেতারাই যদি ‘ধর্মঘট ভাঙেন’, তা হলে সাধারণ কর্মী-সদস্যেরা তা পালন করবেন কেন? দলীয় সূত্রে খবর, গত মার্চে জেলা স্তর থেকে নিচু তলায় নির্দেশ দেওয়া হয়, ধর্মঘটের দিন যাঁরা কাজে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা’ নিতে হবে। জানানো হয়, কোনও লোকাল কমিটির সদস্য কাজে যোগ দিলে তাঁকে ৭ দিনের জন্য সাময়িক ভাবে বহিষ্কার করতে হবে। জোনাল কমিটির সদস্যদের ক্ষেত্রে ৭ দিনের ‘সাসপেনশন’ আর জেলা কমিটির সদস্যের ক্ষেত্রে ‘সাসপেনশনে’র মেয়াদ হবে এক মাস। আর ধর্মঘটের দিন কাজে যোগ দিয়েছেন, এমন সাধারণ পার্টি সদস্যদের ‘শো-কজ’ করা হবে। সেই নির্দেশ মেনেই বিভিন্ন জেলায় ‘ব্যবস্থা’ নেওয়া শুরু হয়েছে বলে সিপিএম সূত্রের খবর।
উত্তর ২৪ পরগনার সিপিএম নেতা অমিতাভ নন্দী বলেন, “ধর্মঘটে সামিল না-হয়ে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য দলের প্রায় ১০০ জন নেতা-কর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে। যাঁদের জবাব সন্তোষজনক হবে না, তাঁদের শাস্তি হবে।” সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী জানান, জোনাল কমিটিগুলিকে এই সংক্রান্ত তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে। নদিয়ায় সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুমিত দে-র বক্তব্য, “যে সব দলীয় সদস্য ২৮ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটের ডাক উপেক্ষা করে কর্মক্ষেত্রে গিয়েছিলেন, তাঁরা কী কারণে সে কাজ করেছেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অনেকের উপরে অনেক রকম চাপ থাকে। তবে কারও ক্ষেত্রে তেমন কোনও পর্যাপ্ত কারণ না-থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না, তা আমরা ভাবনাচিন্তা করব।”
দলের মধ্যেই একটি ব্যাখ্যা হল, এ বারের ধর্মঘট মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের অবস্থান এত ‘কড়া’ ছিল যে, সেই ‘হুমকি’র মুখে অনেকে কাজে যোগ দিতে ‘বাধ্য’ হয়েছেন। সেই জন্যই ধর্মঘট ‘ভঙ্গকারী’দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত নয় বলে দলের একাংশের মত। যেমন, সিপিএম-প্রভাবিত কো-অর্ডিনেশন কমিটির জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক অপূর্ব বসু বলেছেন, “সংগঠনের সকলেই নীতিগত ভাবে ধর্মঘট সমর্থন করেছেন। কিন্তু যে কায়দায় ধর্মঘটের দিন সরকারি কর্মীদের দফতরে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং নির্দেশ না-মানলে শাস্তির হুমকি দেওয়া হয়েছিল, তাতে অনেকেই ভয় পেয়ে দফতরে গিয়েছিলেন। কেউ বা পরিবারের চাপেও অফিসে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তাই তাঁদের কারও বিরুদ্ধেই কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।” ধর্মঘটে সামিল না-হওয়া কর্মীদের তাঁদের জেলায় ‘শো-কজ’ করার কথা ভাবা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সিপিএমের দার্জিলিং জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা রাজ্যের প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যও। তাঁর বক্তব্য, “ওই দিন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল কয়েকটি ট্রেড ইউনিয়ন। পার্টির কোনও কর্মসূচি ছিল না। ফলে, শো-কজের প্রশ্ন ওঠে না। এমন ব্যবস্থা আমরা নিইনি।” তবে অশোকবাবুও জানান, পার্টির কর্মসূচিতে অংশ না-নিলে এই ধরনের কৈফিয়ত চাওয়ার কথা গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে।
উত্তর দিনাজপুরে বিভিন্ন হাই স্কুল, প্রাইমারি স্কুল এবং সরকারি দফতরে কর্মরত, এমন দলীয় কর্মীদের অন্তত ৯০ জনকে চিঠি পাঠিয়ে ধর্মঘটের দিন কাজে যোগ দেওয়ার জন্য ‘দল-বিরোধী কাজে’র অভিযোগ তোলা হয়েছে। সিপিএমের উত্তর দিনাজপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অপূর্ব পাল বলেন, “ধর্মঘটের দিন কাজে যোগ দিয়ে তাঁরা দল-বিরোধী কাজ করেছেন। কেন দল তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।”
কোচবিহারে এখনও কোনও ‘ব্যবস্থা’ না নেওয়া হলেও এমন অন্তত এক হাজার জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের অধিকাংশই উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থা (এনবিএসটিসি), বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে কর্মরত। সিপিএমের কোচবিহার জেলা সম্পাদক তারিণী রায় অবশ্য এই ব্যাপারে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চাননি। জলপাইগুড়ি জেলার আরএসপি-প্রভাবিত সরকারি কর্মী সংগঠনের নেতৃত্বও ধর্মঘটের দিন দলের ‘নির্দেশ’ না-মেনে অফিসে যাওয়ার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলা সিপিএমের সম্পাদক মণীন্দ্র গোপ ও অমিয় পাত্র বলেছেন, যে সব দলীয় কর্মী ওই দিন কাজে গিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে কারণ জানতে চাওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে অমিয়বাবু এ-ও বলেছেন, “অনেক ক্ষেত্রে তৃণমূলের হুমকিতে আমাদের দলীয় সদস্যেরা কাজে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন বলেও খবর পেয়েছি।”
মেদিনীপুর শহর জোনাল এলাকায় যে ক’জন লোকাল কমিটির সদস্যকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সুশীল চট্টোপাধ্যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুশীলবাবু শহরের ৩ নম্বর লোকাল কমিটির সদস্য। সাসপেনশনের প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “পার্টির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কিছু বলব না। তবে ওই দিন বিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম।”
(সহ প্রতিবেদন: জেলা ব্যুরো) |
|
|
|
|
|