অপমানিত বোধ করিবার অধিকার একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। একটি নির্দোষ, বুদ্ধিদীপ্ত, চমৎকার ব্যঙ্গচিত্র দেখিয়াও কেহ মুচকি হাসিবার বদলে অগ্নিশর্মা হইতে পারেন সকলের রসবোধ সমান নয়, সমান হইবার কথাও নয়। এমনকী সেই চিত্রটি সপ্তাহের পর সপ্তাহ ইন্টারনেট-বাহিত হইয়া হাজার হাজার, হয়তো বা লক্ষ লক্ষ রসিকজনের চিত্ত আমোদিত করিবার পর সহসা এক দিন যদি নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর ভক্ত তথা অনুগামীদের মনে হয় যে, ইহাতে তাঁহার সম্মানহানি ঘটিয়াছে, তাহাতে কিঞ্চিৎ বিস্ময় জাগিতে পারে, কিন্তু আপত্তির কিছু নাই কে কবে কোন ব্রাহ্মমুহূর্তে অপমানিত বোধ করিবেন, তাহা স্থির করিবার মৌলিক অধিকারও তাঁহার বা তাঁহার ভক্ত তথা অনুগামীদের আছে বইকী। ব্যঙ্গ, কটাক্ষ বা সমালোচনায় ক্রুদ্ধ না হইয়া আমোদিত হইতে পারিলে মন ভাল থাকে, সুতরাং শরীরও ভাল থাকে, কাজের উৎসাহ বাড়ে, উন্নয়নের দৌড়ে আরও দ্রুত পদনিক্ষেপ করা যায়, এ সকল উপদেশও মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁহার ভক্ত তথা অনুগামীদের শুনাইবার প্রয়োজন নাই, তাঁহারা অনেক ভোটে জিতিয়া মহাকরণে আসিয়াছেন, অন্যের কথা শুনিতে যাইবেন কেন? অতএব সহসা এক দিন প্রভাতে ঘুম ভাঙিয়া একটি অনেক দিনের পুরানো এবং বহুলপ্রচারিত নির্দোষ রসিকতায় তাঁহাদের গাত্রদাহ ও মর্মবেদনা হইয়াছে, এই অবধি কোনও গোল নাই।
কিন্তু মানহানি অনুভব করিলে, এবং আপন রসবোধ ও ক্ষমাপরায়ণতার মাধুরী প্রলেপ করিয়া সেই মানহানির জ্বালা মিটাইতে না পারিলে বা না চাহিলে কী করণীয়? সাধারণ বুদ্ধি বলিবে, মানহানির মামলা। সে জন্য দেশে আইন আছে, আদালত আছে। মুকুল রায়ের চিহ্নিত দুষ্টু লোককে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ভ্যানিশ’ করিয়া দিলেন এই চিত্র কেন তাঁহার পক্ষে অপমানসূচক, সেই অত্যন্ত কঠিন এবং গূঢ় প্রশ্নের বিচার না হয় আদালত করিতেন, প্রয়োজনে সে জন্য মনস্তাত্ত্বিকের সাহায্যও লইতেন। কিন্তু মানহানির অভিযোগ পুলিশের কাছে কেন দায়ের করা হইবে? পুলিশ কেন সেই অভিযোগ গ্রহণ করিবে? সর্বোপরি, অভিযুক্তকে কেন এই অপরাধে হাজতবাস করিতে হইবে? প্রশ্নটি নিছক আইনের নয়। আইনে অনুমোদিত হইলেও স্বাভাবিক ন্যায়ের, বস্তুত কাণ্ডজ্ঞানের যুক্তিতেই পুলিশের আচরণ, এক কথায়, ভয়ঙ্কর।
কেন পুলিশ এমন অন্যায় এবং অনৈতিক কাণ্ডটি সম্পাদন করিল? প্রদোষ মিত্রের প্রয়োজন নাই, তাঁহার বুদ্ধিমান সহকারী ঊনষাট সেকেন্ডে অঙ্ক মিলাইয়া দিবে। যে পুলিশ বহু ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগও গ্রহণ করিতে চায় না, সেই পুলিশ যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এফ আই আর নথিভুক্ত করিয়া অভিযুক্তদের গ্রেফতার করিয়া হাজতে পাঠাইয়া দিল, ‘উপরমহল’-এর নির্দেশ ভিন্ন কি ইহা ঘটিতে পারে? পুলিশে যাইবার পূর্বেই যাহারা অভিযুক্ত অধ্যাপকের লাঞ্ছনা করিয়াছে তাহাদের পরিচয়, এবং অভিযোগ দায়ের করিবার ব্যাপারে তাহাদের দ্রুত-সফল তৎপরতা একটি সহজ কার্যকারণসূত্রের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। বিপজ্জনক ইঙ্গিত। দল ও দলনেতৃত্বের নির্দেশে প্রশাসন অন্যায় আচরণ করিতেছে, ইহার বহু দৃষ্টান্ত পশ্চিমবঙ্গ গত সাড়ে তিন দশকে দেখিয়াছে। কিন্তু সম্পূর্ণ অকারণে নাগরিকের উপর এই ভাবে চড়াও হইবার নজির পশ্চিমবঙ্গেও নিতান্ত বিরল। অবশ্য বিলম্বে হইলেও পুলিশ কিছু কর্তব্যজ্ঞান দেখাইয়াছে। অভিযুক্ত অধ্যাপককে যে বা যাহারা নিগ্রহ করিয়াছিল, তাহাদের ধরা হইয়াছে। রাজ্যের প্রশাসনের কর্ণধার হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য ছিল অবিলম্বে পুলিশ প্রশাসনের এই ভয়ানক অন্যায়ের নৈতিক দায় স্বীকার এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্তাদের নিয়মানুগ শাস্তির বিধান দেওয়া। প্রথমে তিনি উচ্চকণ্ঠে কার্যত এই অন্যায় গ্রেফতারির পক্ষেই মত দিয়াছিলেন। পরে অবশ্য তিনি সম্পূর্ণ বিষয়টি হইতে একটি দূরত্ব রচনা করিবার ইঙ্গিত দিয়াছেন। ইহা, ঈষৎ হইলেও, স্বস্তিকর। কারণ, সম্পূর্ণ ঘটনাটি যে রূপে চলিয়াছে, তাহা রাজধর্ম হইতে বিপজ্জনক বিচ্যুতি। গণতন্ত্রের চরম অপমান। |