কেন্দ্রের সঙ্গে এখনই সংঘাতের পরিস্থিতি এড়াতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের বিভিন্ন দাবিদাওয়া ও আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই নিয়ে ইউপিএ-সরকার তথা কংগ্রেস নেতৃত্ব কোন পথে এগোবেন, তা আগে দেখে নিতে চাইছেন মমতা। সেই অনুযায়ীই কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কের পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবেন তিনি। আর সেই কারণেই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ে আগামিকালের মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনে তিনি উপস্থিত থাকছেন না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এই অনুপস্থিতি অবশ্য পূর্ব-নির্ধারিত বলেই প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। তাঁর পরিবর্তে রাজ্যের তরফে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ওই সম্মেলনে হাজির থাকবেন। সূত্রের খবর, আগামিকালের বৈঠকে হাজির না থাকলেও কলকাতায় বসেই মমতা অন্য মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র (এনসিটিসি) নিয়ে ৫ মে-র বৈঠকে অবশ্য মমতা হাজির থাকবেন বলে জানা গিয়েছে।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ে সম্মেলন ডাকা হলেও যুক্তরাষ্ট্রীয়
কাঠামো নিয়ে আগামিকালের বৈঠক যথেষ্ট উত্তপ্ত হতে চলেছে। এক দিকে বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা সার্বিক ভাবে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলবেন। আঞ্চলিক দলের মুখ্যমন্ত্রীরাও তাতে সমর্থন জানাবেন। অন্য দিকে রয়েছে এনসিটিসি নিয়ে তৈরি হওয়া কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতের পরিস্থিতি। মূলত মমতার দাবি মেনেই এনসিটিসি নিয়ে ৫ মে পৃথক বৈঠক ডেকেছে কেন্দ্র। কিন্তু তার পরেও আগামিকালের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মিলিত রোষের মুখে পড়তে চলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। ইতিমধ্যেই তার জমি তৈরি করে রেখেছেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিএসএফ আইনে সংশোধনী এনে কেন্দ্র রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে বলে অভিযোগ তুলে গতকালই প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন তিনি।
এই পরিস্থিতিতে চিদম্বরমের কৌশল হল, সন্ত্রাস দমনে রাজ্যগুলির গাফিলতি তুলে ধরে এনসিটিসি-র মতো একটি সংস্থার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তৈরি ৬৭ পৃষ্ঠার ‘অ্যাজেন্ডা নোটে’ কেন্দ্র ও রাজ্যের গোয়েন্দা ব্যবস্থার মধ্যে আসমান-জমিন ফারাকের কথা তুলে ধরা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের যুক্তি, গোয়েন্দা তথ্য আদানপ্রদানের জন্য যে ‘মাল্টি-এজেন্সি সেন্টার’ বা ‘ম্যাক’ তৈরি হয়েছে, সেখানে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলিই ৯৭% তথ্য জোগান দিচ্ছে। সব রাজ্য মিলিয়ে আসছে বাকি তিন ভাগ! এনসিটিসি তৈরি হলে এই ‘ম্যাক’ তার মধ্যে মিশে যাওয়ার কথা। এমনিতেই যেখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যগুলির সংঘাত চলছে, সেখানে চিদম্বরমের এই অবস্থান মুখ্যমন্ত্রীদের আরও চটিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট বলেই মনে করছেন অনেকে। তৃণমূল সূত্রের খবর, সংঘাতের এই আবহটাই এড়াতে চাইছেন মমতা। এনসিটিসি নিয়ে কেন্দ্রের অবস্থানের বিরোধিতার পরেও দিল্লিতে এসে যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষ মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে রাজ্যের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ যোজনা বরাদ্দ আদায় করেছেন তিনি। কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর বাবদ ক্ষতিপূরণ মিটিয়ে দেওয়ার জন্যও কেন্দ্রের কাছে চিঠি লিখেছেন তিনি। তাঁর অভিযোগ, পণ্য-পরিষেবা কর চালু করার জন্য বিক্রয় কর কমানোর ফলে রাজ্যের যে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, অর্থ মন্ত্রক একতরফা ভাবে তা না মেটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে কেন্দ্র কী অবস্থান নেয়, তা দেখে নিতে চান মমতা।
আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে কংগ্রেস কী মনোভাব দেখায়, সে দিকেও নজর রাখছেন তৃণমূলনেত্রী। রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী বাছাই নিয়ে মমতার সঙ্গে কংগ্রেসের কেউ এখনও কোনও আলোচনা করেননি বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। সংসদে ও বিধানসভায় শক্তির নিরিখে এ বারের রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে তৃণমূল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কাজেই কংগ্রেস তাঁর সঙ্গে কথা বলে কি না, বা তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দেয় কি না, তা দেখে নিতে চান মমতা।
সোমবারের মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনে রাজ্যের মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি-র হাজির থাকার কথা। আদিবাসীদের মধ্যে মাওবাদীদের প্রভাব কমাতে তফসিলি জাতি-উপজাতির উপর নির্যাতন বন্ধ করতে চাইছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। রাজ্যে রাজ্যে তফসিলি জাতি-উপজাতি নির্যাতন প্রতিরোধ আইন কতটা কার্যকর হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে মঙ্গলবার রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতর মমতারই হাতে। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, নিজে না এলেও সেই বৈঠকে রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণি উন্নয়ন মন্ত্রী উপেন বিশ্বাসকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
মমতা না থাকলেও আগামিকালের বৈঠকে নবীন পট্টনায়ক, নীতীশ কুমার, জয়ললিতা, নরেন্দ্র মোদীরা হাজির থাকবেন বলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে জানানো হয়েছে। ৫ মে-র বৈঠকের দিকে তাকিয়ে এখনও এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তিনি। বস্তুত মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনের তুলনায় ওই বৈঠককেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন মমতা। পরিস্থিতি বুঝে সে দিনই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সুর চড়াতে চান তিনি। |