আক্রমণ, প্রতিক্রিয়া কোনওটাই নতুন নয়
‘আক্রমণ’ প্রথম নয়, প্রথম নয় প্রশাসনিক ‘পদক্ষেপ’ও।
সাইবার দুনিয়ায় রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের প্রতি ব্যঙ্গবিদ্রুপ, ব্যক্তিগত আক্রমণ, কুৎসার প্রচার ইন্টারনেট জমানার শুরু থেকেই আছে। এবং তার গতি দিনদিন বাড়ছে। ইন্টারনেটের প্রচার নিয়ে এ দেশের মন্ত্রী-সান্ত্রীদের ‘প্রতিক্রিয়া’ও নতুন কিছু নয়। এ রাজ্যেই জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে সাইবার কুৎসার দায়ে জেল খাটার নজির রয়েছে। তাঁর উত্তরসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অবশ্য নেট দুনিয়ার আক্রমণের মুখে পদক্ষেপ করেননি কখনও। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ হলেন।
নয়ের দশকের শেষ দিককার কথা। একটি ওয়েবসাইটে এক অবাঙালি যুবা তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কুৎসা ছড়িয়েছিল। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সাজা ভোগ করতে হয় যুবাকে। গত ডিসেম্বরেই ইন্টারনেটে সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহের ‘অপমানকর’ ছবি প্রচারের প্রতিবাদে ফেসবুক-গুগ্ল সহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘সেন্সরশিপ’ চালুর পক্ষে সওয়াল করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কপিল সিব্বল। তাঁর দাবি ছিল, নেটের কিছু কিছু ছবি বা লেখা দেশে অশান্তির সৃষ্টি করতে পারে। গুগ্ল, ইয়াহু প্রমুখ বিভিন্ন ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারীদের তরফে ‘সরকারি বিধিনিষেধ’ মানতে অস্বীকার করা হলেও এ দেশের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়।
১৪১৮ বঙ্গাব্দের শেষ দিনে অবশ্য বিতর্কের কেন্দ্রে বাংলার আর এক মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে নিয়ে কমিক-স্ট্রিপের ধাঁচে তৈরি এক ‘ব্যঙ্গচিত্র।’ যাতে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ ছবির একটি দৃশ্যের আদলে মুখ্যমন্ত্রী, প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী ও বর্তমান রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ের মধ্যে কাল্পনিক সংলাপ। ফেসবুকে বহুল প্রচারিত ওই ছবি ই-মেল করে পুলিশের খাতায় অভিযুক্ত হয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক।
ইন্টারনেট ব্যবহারের নিরিখে ভারত এখন গোটা বিশ্বে তৃতীয়। দশ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর এই দেশে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে রাজনৈতিক বাগ্বিতণ্ডা বা রসিকতার প্রবণতা লক্ষণীয় ভাবে বেড়েছে গত লোকসভা ভোটের প্রাক পর্ব থেকে। এ রাজ্যেও বাম জমানার শেষ পর্ব থেকে শুরু করে ‘পরিবর্তন’-এর পরেও যাবতীয় রাজনৈতিক ঘটনাবলির ছায়া পড়ছে সাইবার-দেওয়ালে। রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের ওয়েবসাইট সাজিয়ে-গুছিয়ে বা ফেসবুক-টুইটারে সামিল হয়ে নেট-প্রচারে জোর দিচ্ছে। ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতের সরাসরি প্রচার তো আছেই। পাশাপাশি রাজনীতি বা বিনোদন জগতের কোনও ঘটনাকে মজাদার দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে ছবিতে-ছড়ায় ফুটে উঠছে শ্লেষ বা নিখাদ হাস্যরস।
যেমন, বিধানসভা ভোটের আগে উত্তম-সুচিত্রার ‘পথ যদি না শেষ হয়’ গানের কালজয়ী দৃশ্যের অনুকরণে বুদ্ধ-মমতার মুখ বসিয়ে মজার বার্তা ছড়িয়েছিল নেটে। বুদ্ধবাবু তা নিয়ে কোনও হেলদোল দেখাননি। আবার বামের ভরাডুবির পরে এক কার্টুনে দেখা গিয়েছিল, মার্ক্স-লেনিনের সমাধিতে তৃণমূলের জোড়া ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন বঙ্গজ সিপিএম নেতারা! সাম্প্রতিক আইপিএলের মরসুমে যে কার্টুন নেট কাঁপাচ্ছে, তাতে কেকেআরের ক্যাপ্টেন বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান গৌতম গম্ভীরকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ: পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে ‘বাম’-নির্ভরতা চলবে না! গৌতমের হতভম্ব উত্তর: আমি তো বরাবর বাঁ হাতেই ব্যাট করেছি! পত্র-পত্রিকার নজরকাড়া কার্টুন বা ভোট-প্রচারের দেওয়াল-লিখন একদা বঙ্গজীবনে যে নির্মল হাসির আমদানি করত, অধুনা ফেসবুক-টুইটারের সাইবার-দেওয়ালে তারই ছায়া দেখছেন অনেকে।
তবে ইমেল পাঠানোর দায়ে শিক্ষকের গ্রেফতারির এই ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নেট-দুনিয়ায় দেশে-বিদেশে বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। ‘গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের’ অভিযোগও উঠেছে। কার্টুন আঁকা নিয়ে পুলিশি ধরপাকড়ে পশ্চিমবঙ্গে মতপ্রকাশের অধিকার বিপন্ন বলে সুইডেনে বসে কড়া সুরে ‘টুইট’ করেছেন তসলিমা নাসরিন। মুখ্যমন্ত্রী নিজে ওই শিক্ষকের গ্রেফতারি সমর্থনই করেছেন।
ইন্টারনেটে প্রচারিত ‘বিষয়’ বা ‘ছবি’ নিয়ে প্রশাসনের তরফে কোনও রকম তৎপরতা মানেই কি বাড়াবাড়ি? বিপণন-বিশেষজ্ঞ শিলু চট্টোপাধ্যায় কিন্তু তা মনে করেন না। তাঁর কথায়, “গোটা সমাজটাই তো সাংঘাতিক পরিণতমনস্ক হয়ে ওঠেনি। ইন্টারনেটে প্রচারিত কিছু ছবি-লেখা দেখে মনে হয়, নিয়ন্ত্রণের উপায় থাকলে ভালই হত।” ‘অ্যাড-গুরু’ রাম রায়ের চোখে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট এক ধরনের ‘সীমানাহীন কমন-রুম’। তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যে কোনও সামাজিক ক্ষেত্রের মতো এখানেও কিছু ব্যবহারিক আদবকায়দা আছে। তবে যে ব্যঙ্গ-কোলাজ প্রচারের জেরে পুলিশি ‘সক্রিয়তা’ ঘিরে আপাতত বাঙালি উত্তাল, তার মধ্যে দোষ দেখছেন না রাম।
সত্যজিতের ছবির দৃশ্যের ‘প্যারডি’র মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে রসিকতায় আপত্তিকর কিছু খুঁজে পাননি বক্স-অফিস মাত করা হাসির বাংলা ছবি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর পরিচালক অনীক দত্তও। তাঁর মতে, ইন্টারনেটে প্রচারিত হাজারো বিষয় নিয়ে ‘জ্যাঠামশাইগিরি’র কোনও মানে হয় না। “কিছু কিছু বিষয় নিয়ে আমরা অহেতুক স্পর্শকাতর হয়ে পড়ি। তুকতাক-কুসংস্কার নিয়ে ঢালাও প্রচারও তো কয়েক জনের খারাপ লাগতে পারে! যেখানে স্পর্শকাতর হওয়ার দরকার, সেখানে কেন আমরা হই না?”-পাল্টা প্রশ্ন অনীকের।
মুখ্যমন্ত্রীর ছবি নিয়ে নেট-রসিকতা দমনে ‘পুলিশি তৎপরতা’র জবাবটা অবশ্য শুক্রবার দিনভর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে আরও জোরালো রসিকতার মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়েছে। ‘বিতর্কিত’ ছবিটি বারবার নিজেদের মধ্যে ‘শেয়ার’ করে অনেকেই মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রশাসনকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন। বলেছেন, ‘এ বার তা হলে আমাকেও এসে ধরুন।’ আর পশ্চিমবঙ্গে ‘হাসি-নিষেধের’ বিরুদ্ধে ফরমান জারি হয়েছে বলে ‘কটাক্ষ’ করে প্রয়াত কার্টুনিস্ট কুট্টির ছবি দিয়ে তাঁর জবানিতেই এ দিন ফেসবুকের মন্তব্য, ‘‘এই পশ্চিমবঙ্গে থাকলে আমাকেও মুশকিলে পড়তে হত!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.