বিশ্ব্যবাঙ্ক সহজ শর্তে তিনশো কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করেছে। তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া আধুনিকীকরণে বিশ্বব্যাঙ্কের এই অর্থানুকূল্য দেশের মধ্যে প্রথম হাতে পেয়ে কাজেও সবার আগে নেমে পড়ল পশ্চিমবঙ্গের ব্যান্ডেল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
রাজ্যের বিদ্যুৎ-কর্তাদের দাবি: পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার মতো আরও ক’টি রাজ্য তাদের বিভিন্ন রুগ্ণ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আধুনিকীকরণের জন্য বিশ্বব্যাঙ্ক-ঋণের আবেদন করেছিল। কিন্তু প্রকল্পের সম্পূর্ণ রূপরেখা (ডিটেলড প্রজেক্ট রিপোর্ট, সংক্ষেপে ডিপিআর) সর্বাগ্রে পেশ করে এবং অন্যান্য বিভিন্ন জরুরি ছাড়পত্র দ্রুত আদায় করে অন্যান্য রাজ্যকে টেক্কা দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের এ হেন ‘পেশাদারিত্ব’ কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রককেও সন্তুষ্ট করেছে বলে কর্তারা জানিয়েছেন।
ঋণ আদায়ের এই ‘তৎপরতা’ আসল কাজের ক্ষেত্রেও বহাল আছে। বরাত নিয়ে এ মাসেই আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার বহুজাতিক সংস্থা দুসান হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন। চুক্তি মোতাবেক, ব্যান্ডেল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের রুগ্ণ ২১০ মেগাওয়াটের ইউনিটটিকে চাঙ্গা করে তারা নিগমের হাতে তুলে দেবে আগামী ৩০ মাসের মধ্যে। তিরিশ বছরের প্রাচীন ইউনিটটি এখন বয়সের ভারেই ধুঁকছে। রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত জানিয়েছেন, ব্যান্ডেলের পরে একই পদ্ধতিতে কোলাঘাট কেন্দ্রের ইউনিটগুলির আধুনিকীকরণ শুরু হবে। মন্ত্রীর বক্তব্য, আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে রাজ্যের সব তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন ক্ষমতা ও উৎপাদনের মধ্যে ভারসাম্য নিয়ে আসাই তাঁদের লক্ষ্য। |
ব্যান্ডেল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র |
ব্যান্ডেলের আধুনিকীকরণ খাতে সর্বাধিক প্রকল্প-ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ছ’শো কোটি টাকার কিছু বেশি। দফতরের খবর: এর মোটামুটি ৭৪% ঋণ হিসেবে বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে চেয়ে রেখেছে নিগম। যার মধ্যে আপাতত তিনশো কোটি মঞ্জুর হয়েছে। আরও অন্তত ১০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। বাকি ২৬ শতাংশের সংস্থান হবে নিগমের অভ্যন্তরীণ তহবিল ভেঙে এবং বাজার থেকে ঋণ তুলে। আধুনিকীকরণ প্রকল্পে কী কী কাজ হবে?
নিগম ও দুসানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, ইউনিটের পুরনো বয়লারটির কর্মক্ষমতা ১০% বাড়ানো হবে। উপরন্তু টারবাইন-সহ উৎপাদনের অন্যান্য নিয়ন্ত্রক যন্ত্র সবই বদলে ফেলা হবে, ফলে উৎপাদনক্ষমতা আরও ৫% বাড়বে। বিদ্যুৎ-কর্তাদের একাংশের দাবি, ২০১৪-র শেষাশেষি কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেলে এই ইউনিটই ২১০-২১৫ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতা নিয়ে ১৫ থেকে ২০ বছর অনায়াসে ছুটতে পারবে। আর তার পরে ব্যান্ডেলের ‘মৃতপ্রায়’ ছোট ইউনিটগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিগম কর্তৃপক্ষ।
ষাটের দশকে ব্যান্ডেলে ৬০ মেগাওয়াট করে মোট চারটি ছোট ইউনিট গড়ে তোলা হয়েছিল ধাপে ধাপে। ১৯৮২-তে আসে ২১০ মেগাওয়াটের এই ইউনিট। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যান্ডেল তাপবিদ্যুতের সার্বিক উৎপাদনক্ষমতা কমেছে। অন্য দিকে বেড়েছে দূষণের মাত্রা। প্রাচীন ইউনিটটিকে চাঙ্গা করে তোলা সহজ নয় বলে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার কয়লা থেকে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছিল। যদিও অত্যধিক খরচ ও গ্যাসের জোগানের সমস্যার দরুণ পরিকল্পনাটি ধোপে টেকেনি।
ব্যান্ডেল বাঁচাতে বিশ্বব্যাঙ্কের সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত তখনই। পরিবেশ দূষণ কমাতে বিশ্বব্যাঙ্ক এখন পুরনো তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আধুনিকীকরণে ঋণ দিতে আগ্রহী। বিশ্বব্যাঙ্কের মতে, তিন-চার দশকের পুরনো তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ঢেলে সাজা গেলে সেখানে উৎপাদন ক্ষমতা যেমন বাড়বে, তেমন আধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে দূষণেও লাগাম দেওয়া যাবে। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রকও প্রতিটি রাজ্যকে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পুরনো তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আধুনিকীকরণে উৎসাহ দিচ্ছে। কারণ, নতুন প্রকল্প গড়তে গেলে কম-বেশি সব রাজ্যেই জমি বড় সমস্যা।
বিশ্বব্যাঙ্ক ও ভারত সরকারের এই যৌথ ভাবনার ফসলই দেশে সর্বপ্রথম পেল ব্যান্ডেল। অন্তত নিগম-কর্তৃপক্ষের তেমনই দাবি। |